স্পোর্টস ডেস্ক : একই সঙ্গে আজকে তিন তিনটা টেস্ট ম্যাচ হচ্ছে। ভারতে ইংল্যান্ড তাড়া করছে বিশাল এক লক্ষ্য, শ্রীলঙ্কায় আফগানিরা বুক চিতিয়ে লড়ছে অনেকটা পিছিয়ে গিয়েও, আর দক্ষিণ আফ্রিকার একদল আন কোড়া খেলোয়াড় মুখোমুখি স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের।
একই দিনে দুনিয়ার তিন প্রান্তে তিনটা টেস্ট হওয়া নতুন কিছু না, চার বা পাঁচটাও হতে পারে। তবে, আজকের তিনটা ম্যাচ, ম্যাচগুলোর অবস্থা টেস্ট ক্রিকেটের বর্তমান হালচাল বোঝার জন্য আদর্শ।
ভারতে হওয়া ম্যাচটার কথাই ধরা যাক। এই সিরিজের প্রথম ম্যাচটা ইংল্যান্ড জিতে গেল। ভারতের মাটিতে এই ধরনের সাফল্য দারুণ অর্জন। এই টেস্টে তাঁরা প্রায় চার শ রানের লক্ষ্যে ছুটছে কিন্তু সেই ছোটাটা হচ্ছে তাঁদের ‘বাজবল’ দর্শনে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটের মানসিকতা ব্যাটারদের নিত্যনতুন শট খেলা এবং ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এরই এক বিবর্তন ইংলিশদের চিত্তাকর্ষক, সাহসী ক্রিকেট।
হয়তো ইংল্যান্ড শেষতক হেরেই যাবে, কিন্তু তাঁদের সাহসী ব্যাটিং ভারতের বুক কাঁপিয়ে দিয়েছে অনেকক্ষণ। আর ইংল্যান্ড বারংবার দেখিয়েছে, যে দুই একদিন তাঁরা হারতেই পারে, কিন্তু বীর ভোগ্য বসুন্ধরা এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়াতে তাঁরা হারার চেয়ে জিতেই বেশি।
ইংল্যান্ডের এই খেলা ক্রিকেটের বিবর্তনের দারুণ এক গল্প। টেস্ট ক্রিকেট শতবর্ষীয় হোক কিংবা আরও বেশি, আধুনিকতা আর বিবর্তন এই খেলাকে আরও বেশি উত্তেজক, আকর্ষণীয় করে। খেলার ফলাফলের অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দেয়, যা যে কোন খেলারই অন্যতম আকর্ষণ। ইংল্যান্ড দেখাচ্ছে, টেস্ট অত্যাধুনিক হতে পারে।
অন্যদিকে আফগানিস্তানের গল্পটা পুরাই ভিন্ন। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশের টেস্ট খেলার ঐতিহ্য বা কাঠামো তেমন একটা নেই। তদুপরি শ্রীলঙ্কার মাটিতে প্রথম ইনিংসে ২০০ রানের বেশি পিছিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে নেমেছে। কিন্তু, সেখান থেকেই তাঁরা আফগানি সাহস আর না হারার মন্ত্রে লড়াই করছে। এই লড়াই ইংল্যান্ডের মতো আগ্রাসী নয়, বরং ধ্রুপদি। প্রচণ্ড ধৈর্য এবং দৃঢ়তা নিয়ে তরুণ জাদরান সেঞ্চুরি করেছেন, আড়াই শোর বেশি বল মোকাবিলা করেছেন। দারুণ এক উদ্বোধনী জুটি গড়েছেন চাচা নুর আলী জাদরানের সঙ্গে। আফগানিস্তানের এই লড়াই উপভোগ্য। খেলার ফলাফল যাই হোক, আফগানিস্তান মনে করিয়ে দিচ্ছে, এইরকম মাটি কামড়ানোর লড়াই টেস্ট ক্রিকেটের সৌন্দর্য।
অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার গল্পটা মাঠের চেয়ে মাঠের বাইরের বেশি। ক্রিকেট অর্থনীতি, রাজনীতি আর বিশ্বায়নের। টি-টোয়েন্টি লীগগুলো রমরমা হয়ে যাওয়ার পর, দুনিয়ার সেরা খেলোয়াড়দের জন্য প্রায়শই যেই কঠিন প্রশ্নটা হাজির হয় তা হচ্ছে- দেশ নাকি অর্থ? গৌরব নাকি জীবিকা? আমরা খেলোয়াড়দের যতই দোষ দিই, দিন শেষে বর্তমান দুনিয়ার সামাজিক আর আর্থিক ব্যবস্থায় লক্ষ্মী দেবীকে সরিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব। তাঁর ওপর যুক্ত হয়েছে ক্রিকেট মানচিত্রে অসাম্য।
ভারত, ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া, তিন মোড়ল নামে পরিচিত এই ধনী বোর্ডগুলো নিজেদের খেলোয়াড়দের বিপুল বেতন দিয়ে দেশের জন্য খেলা নিশ্চিত করতে পারে। এমনকি তাঁদের অঙ্গুলি হেলনেই ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগ আর টেস্টের সূচি নির্ধারিত হয়। ফলে তাঁদের সেরা খেলোয়াড়রাই টেস্ট খেলতে পারেন। আর এর ফলে টেস্ট আয়োজন করা তাঁদের জন্য লাভজনকও হয়।
অন্যদিকে, বাকি বেশির ভাগ দেশের খেলোয়াড়দের জন্য টেস্ট বাদ দিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি খেলাটাই যৌক্তিক হয়ে পড়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ বহু বছর ধরে এই ঘটনার জেরে জর্জরিত। এর প্রভাবটা টের পেল দক্ষিণ আফ্রিকা।
সে দেশে ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি এবং নিউজিল্যান্ডের সফর একই সময় পড়ে যাওয়ায় সব সেরা খেলোয়াড় প্রথমটিই বেছে নেন। আর টেস্ট খেলছেন কারা? বাপে তাড়ানো মায়ে খেদানো, এমনকি ফ্র্যাঞ্চাইজি দল না পাওয়া একদল আনকোরা খেলোয়াড়। ক্রিকেট অর্থনীতি আর রাজনীতির প্রবল চাপে নিউজিল্যান্ডে তাঁদের নির্মম বধ হওয়ার দৃশ্যই দেখতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কিন্তু, এখানেই জীবনের মতো, টেস্ট ক্রিকেটের চমক। এই কদ্দিন আগে এর চেয়ে অনেক বেশি অসাম্যর এক যুপকাষ্টে পতিত হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের তরুণেরা। টেস্ট খেলতে নেমেছিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, প্রবল প্রতাপশালী অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। তাঁদেরই মাঠে।
শামার যোসেফরা সেই অসম্ভব লড়াইয়ে জিতে রূপকথার জন্ম দেয়। নীল ব্র্যান্ডের দল নিশ্চয়ই তা থেকে উজ্জীবিত হবেন।
টেস্ট ক্রিকেটেই এই সব জীবনের গল্প লেখা সম্ভব। অনেক পিছিয়ে থেকে লড়াই করা সম্ভব। অসম্ভবকে জয় করে রূপকথা লেখা সম্ভব। এমনকি হেরে গেলেও মহাকাব্যর নায়ক হওয়া সম্ভব।
টেস্ট ক্রিকেট টিকে থাকুক আজীবন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।