নিজস্ব প্রতিবেদক : একটি হল রুমে সারি সারি চেয়ার পাতা। সেখানে উচ্ছ্বল, উদ্যোমী তরুণ-তরুণীরা বসা। সবার সামনে কিবোর্ড, মাউস, মনিটর। এই তরুণ-তরুণীরা বিনা মূল্যে কম্পিউটার শিখছেন। শেখাচ্ছে তৌহিদ ফাউন্ডেশন।
আরেকটি হলেও সারি করে চেয়ার-টেবিল পাতা। এখানে আছেন নানা বয়সী নারী-পুরুষ। তবে এনাদের সামনে কম্পিউটার নেই। বদলে আছে সেলাই মেশিন। এই পরিশ্রমী নারী-পুরুষেরা সম্পূর্ণ ফ্রিতে সেলাই শিখছেন। এনাদেরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে একই প্রতিষ্ঠান।
শুধু কম্পিউটার বা সেলাই প্রশিক্ষণই নয়, মানবতার সেবায় এমন নানা কাজে জড়িত তৌহিদ ফাউন্ডেশন। সম্পূর্ণ অলাভজনক ও অরাজনৈতিক এই প্রতিষ্ঠানটি চলছে মো. তৌহিদুল ইসলাম নামের এক দানবীরের নিজস্ব অর্থায়নে।
২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ফাউন্ডেশনটি এ পর্যন্ত ২ হাজার ২০ জন তরুণ-তরুণীকে কম্পিউটার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ১৯৩ জনকে। এ ছাড়া বর্তমানে ৫ হাজারের বেশি তরুণ-তরুণী কম্পিউটার প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে অপেক্ষমান রয়েছেন৷ ২ হাজার জনের বেশি নারী-পুরুষ সেলাই প্রশিক্ষণের জন্য অপেক্ষমান রয়েছেন। তাঁদের পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
প্রতিষ্ঠানটি শুধু প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিই তৈরি করছে না। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এটি অসহায় ও দুস্থ ব্যক্তিদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতাও করে আসছে। তৌহিদ ফাউন্ডেশন বিনা খরচে অ্যাম্বুলেন্স সুবিধা দেওয়া থেকে শুরু করে লাশ দাফন ও গোসলের ব্যবস্থা করে। এটি দুস্থ ব্যক্তিদের চোখের চিকিৎসা করায়। নুরানী পদ্ধতিতে কোরান শিক্ষাদানসহ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের শিক্ষাভাতা দেয়। মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানায় নগদ অনুদানপ্রদানসহ প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে অসহায় নারী-পুরুষের মাঝে ত্রাণও বিতরণ করা হয়। এছাড়া, পবিত্র রমজান মাসে প্রতিদিন এক হাজারেরও বেশি মুসল্লির জন্য ইফতারের আয়োজন করে থাকে ফাউন্ডেশনটি।
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও তরুণ লেখক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, তাঁর নামেরই আরেক ব্যক্তি সমাজের জন্য এত কিছু করে যাচ্ছেন, জেনে খুব ভালো লাগল। এমন মানুষ সমাজের জন্য আসলেই আশীর্বাদ।
প্রতিষ্ঠার সময় থেকে ঢাকার মিরপুর ১–এর টোলারবাগে ফাউন্ডেশনটির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তৌহিদুল ইসলামের আবাসিক ভবনে সংগঠনটির অস্থায়ী কার্যালয় পরিচালিত হচ্ছিল। বর্তমানে মিরপুর ১–এর দক্ষিণ বিশিল এলাকায় সভাপতির নিজস্ব স্থাপনায় বিনা ভাড়ায় ফাউন্ডেশনটির যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, ফাউন্ডেশনটি থেকে ৪টি অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে অসুস্থ রোগীদের জরুরিভিত্তিতে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সম্প্রতি এই বহরে ২টি লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িও যুক্ত হয়েছে। দরিদ্র ও অসহায় ব্যক্তিদের এসব সেবা বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। তবে সামর্থবানদের কাছ থেকে শুধু প্রকৃত খরচ নেওয়া হয়ে থাকে।
ফাউন্ডেশনটি থেকে অসহায় মানুষের কাফন-দাফন ও গোসল বিনা মূল্যে করানো হয়। এ পর্যন্ত ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ১ হাজার ৪৮০ জনের লাশ গোসল করানো হয়েছে।
এই প্রতিষ্ঠান থেকে ২৪৬ জন নারী-পুরুষকে বিনা মূল্যে চোখের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ১৭৪ জনের চোখের ছানি অপারেশনসহ লেন্স প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
চোখের সমস্যায় ভোগা বাচ্চু ব্যাপারী নামের এক ব্যক্তি বলেন, চোখ মানুষের অমূল্য সম্পদ। অনেক সময় এই সম্পদ অবহেলার শিকার হয়। তখন অনেক চেষ্টা করেও সঠিক চিকিৎসা পাওয়া যায় না। তৌহিদ ফাউন্ডেশন বিনা মূল্যে চোখের চিকিৎসা দিলে অনেকেই উপকৃত হবেন।
প্রতিষ্ঠান সূত্রে আরও জানা যায়, এই ফাউন্ডেশন থেকে মাদ্রাসার গরীব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রতি মাসে লেখাপড়ার খরচ দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের এভাবে মাওলানা (দাওরা) পর্যন্ত পড়ার খরচ দেওয়া হবে।
এই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সমাজের সকল বয়সী নারীদের মহিলা ক্বারী প্রশিক্ষক দ্বারা ২১ দিনব্যাপী বিনা মূল্যে নূরানী পদ্ধতিতে পবিত্র কুরআন শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে প্রশিক্ষণার্থীদের ৪৫০টি কুরআন শরীফ হাদিয়া হিসেবে দেওয়া হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি থেকে রমজান মাসে ৩ জন কুরআনে হাফেজ দ্বারা নারীদের জন্য জামাতে খতম তারাবীহ নামাজের ব্যবস্থা করা হয়। এই নামাজে অংশগ্রহণকারীদের ১টি করে জায়নামাজ হাদিয়া হিসেবে দেওয়া হয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী আসমাউল হুসনা বলেন, সমাজে নারীদের জামাতে অংশগ্রহণ অনেক কম। এভাবে পবিত্র কুরআন প্রশিক্ষণ ও তারাবীহের ব্যবস্থা করায় নারীদের এসব ধর্মীয় কাজে অংশগ্রহণ বাড়বে।
ফাউন্ডেশন থেকে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানায় নগদ অর্থ নিয়মিত অনুদান দেওয়া হয়। এ ছাড়া করোনার সময় রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফাউন্ডেশনটির পক্ষ থেকে ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা চালানো হয়।
প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, তৌহিদ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তৌহিদুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে অসহায় ও দরিদ্র মানুষদের চিকিৎসা ব্যয়সহ মসজিদ মাদ্রাসায় দান করে আসছেন। তাঁর এই দান ও সেবার বিষয়টির প্রতিষ্ঠানিক রূপ দিতেই ‘তৌহিদ ফাউন্ডেশন’ গঠন করা হয়। তৌহিদুল ইসলামের বাড়ি/ফ্লাট ভাড়া এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আয়ের একটি অংশ দিয়ে এই ফাউন্ডেশনের তহবিল গঠিত এবং এর ব্যয় নির্বাহ করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠাতার অবর্তমানে যেন ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম ব্যাহত না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে তৌহিদ ফাউন্ডেশনের নিজস্ব আয়ের উৎস তৈরি করা হচ্ছে।
তৌহিদ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক মোঃ শহিদুল ইসলাম জানান, ফাউন্ডেশনটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, অলাভজনক ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। শুধু মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের রাজী ও খুশির জন্য আর্তমানবতার সেবার মানসে এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এটি এ কারণে ব্যতিক্রমী যে, এটির সম্পূর্ণ ব্যয় প্রতিষ্ঠাতার পক্ষ থেকে এককভাবে নির্বাহ করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানে সরকারি-বেসরকারি, দেশি-বিদেশি, সামাজিক বা ব্যক্তিগত কোনো অনুদান নেওয়া হয় না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।