ঋণের ফাঁদ থেকে কোনোভাবেই বের হতে পারছিলেন না মিঠুন দাস (২৮)। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির চাকরি আর সিসি ক্যামেরা বসানোর ব্যবসা থেকে যা আয় হতো, তার প্রায় সবটুকুই চলে যেত শুধু সুদের টাকা মেটাতে। চরম মানসিক চাপের মধ্যে বাসে যাত্রাকালে তার কাছে থাকা ব্যাগ থেকে চুরি হয় কোম্পানির প্রায় তিন লাখ টাকা। সেই আঘাত সহ্য করতে পারেননি মিঠুন।
গত মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ফেসবুকে লাইভে দুঃখের কথাগুলো বলে রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়েন মিঠুন। এভাবেই অবসান ঘটে তার জীবনের।
মিঠুনের জীবনের অবসান হলেও তিনি রেখে গেছেন প্রায় পাঁচ লাখ টাকার ঋণের বোঝা। তার সংসারে এখন উপার্জন করার কেউ নেই। একমাত্র সন্তান হারিয়ে শোকে ভেঙে পড়া মিঠুনের মা শ্রীমতি রানী দিশেহারা হয়ে পড়েছেন—ঋণ শোধ করবেন কীভাবে, সেই দুশ্চিন্তায়।
মিঠুনের বাড়ি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বনকিশোর গ্রামে। বাবা প্রেমানন্দ দাস পেশায় ভ্যানচালক ছিলেন, বর্তমানে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। ১৪ মাস আগে নাটোরের মেয়ে বিউটি দাসকে বিয়ে করেছিলেন মিঠুন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি থাকতেন কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরিপুর এলাকায়। সেখানেই সিসি ক্যামেরা বসানোর ব্যবসা করতেন। তিন মাস আগে যোগ দেন একটি ওষুধ কোম্পানিতে, বেতন ছিল ১০ হাজার টাকা।
মারা যাওয়ার আগে ফেসবুক লাইভে মিঠুন বলেন, “কোনদিন ভাবিই নাই এ সিদ্ধান্ত নিব। এর আগে সিদ্ধান্তটা নিলে ক্ষতিটা হইত না। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। ডিসেম্বর মাস থেকে বিপদ পিছু ছাড়ছে না। কোম্পানির তিন লাখ টাকার মতো হারাই ফেলছি। জানি, আমার পরিবারটাকে দেখার কেউ নাই। কিন্তু এই মুখ নিয়ে মা-বাবাকে কীভাবে জানাব?”
একটু থেমে তিনি আরো বলেন, “আমি চলে যাইতেছি। যারা আমার কাছ থেকে টাকা পান, ক্ষমা করে দিয়েন আমাকে। আমি আমার নিজের চোখে পরিবারটাকে শেষ হতে দেখতে পারি না। সরকারের কাছে একটাই আবেদন—পরিবারটাকে ঋণমুক্ত কইরেন, পরিবারটাকে বাঁচায়ে রাইখেন। মা-বাবা ক্ষমা করে দিও। বিউটিকে একটা ভাল ছেলে দেইখে বিয়ে করাইও।”
রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে বনকিশোর গ্রামে বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় গেলে দেখা যায়, বাড়ির আঙিনায় বসে আছেন মিঠুনের মা শ্রীমতি রানী। তাকে ঘিরে প্রতিবেশী নারীরা। শোকে কাতর রানী জানান, মঙ্গলবার দুপুরে ছেলে ফোন করে শুধু জিজ্ঞেস করেছিল—‘মা, ভালো আছো?’ এরপর আর কোনো কথা বলেননি। রাতেই ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার খবর আসে। বুধবার রাত ১টার দিকে লাশ আসে। রাতেই বাড়ির পাশের বড়াল নদের তীরে দাফন করা হয়।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, আগে শুধু সিসি ক্যামেরা বসানোর কাজ করতেন মিঠুন। আগাম টাকা নিয়ে অর্ডার দেওয়া ক্যামেরা কিনে লাগিয়ে দিতেন। গত ডিসেম্বরে এক বন্ধুকে দেড় লাখ টাকা দিয়েছিলেন ক্যামেরা কেনার জন্য। কিন্তু ওই বন্ধু টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে ধারদেনা করে ক্যামেরা কিনে দিতে গিয়ে বিপাকে পড়েন। ভুল সংযোগ দেওয়ায় সব ক্যামেরা পুড়ে যায়, আবার জরিমানার টাকা গুনতে হয়। এক কাজেই ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে তিন লাখ টাকা।
এরপর দাউদকান্দির তিনটি এনজিও থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা ঋণ নেন। মায়ের ননদও ২ লাখ টাকা ধার দেন। আরেকটি সংস্থা থেকে ৪০ হাজার টাকা, ব্যবসার জন্য সুদে আরও ৫০ হাজার টাকা নেন মিঠুন। রাজশাহীতে স্বর্ণকারের দোকানে গয়না বন্ধক রেখে মা রানীও ছেলেকে দেন ৫০ হাজার টাকা। এই টাকার সুদ ছিল মাসে হাজারে ১০০ টাকা, অর্থাৎ মাসিক ১০ হাজার টাকা।
ঋণের কিস্তি মেটাতে না পেরে মিঠুন যোগ দেন ওষুধ কোম্পানিতে। কিন্তু সেখানকার কালেকশন করা টাকা চুরি হয়ে গেলে ভেঙে পড়েন তিনি।
মিঠুনের মা শ্রীমতি রানী বলেন, “আমার আর কোনো ছেইলে নাই। ওর বাপ আগে ভ্যান চালাইত, এখন অসুস্থ হয়ে শুইয়া আছে। মাথার ওপর এতগুলো ঋণ। আমার বাকি দিনডা চালাইবে কে?”
স্ত্রী বিউটি দাস নির্বাক বসেছিলেন। শুধু বললেন, “মঙ্গলবার শেষবার সে ফোনে বলল, চট্টগ্রামে আছে, কাজে ব্যস্ত। পরে কথা বলবে। আর কথা হলো না।”
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।