জুমবাংলা ডেস্ক : গভীর রাত। ফেসবুকে নোটিফিকেশন আসে মানসুরার। সেখানে ‘লিসা মার্টিনেজ’- নামে একটি ফেসবুক আইডি থেকে তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো হয়। আইডিতে গিয়ে দেখা যায় তিনি নিউ ইয়র্ক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে কর্মরত। নিউ ইয়র্কের নিউ সিটিতে বসবাস করেন। এই নারীর সম্পর্কে আরও জানতে তাকে বার্তা পাঠান মানসুরা। এরপরই ওপাশ থেকে একটি বার্তা আসে। এই বার্তার মাধ্যমে শুরু হয় কথোপকথন। চান হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর। ধীরে ধীরে ফাঁদ পাততে শুরু করেন প্রতারণার।
প্রলোভন দেন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকে পড়ে থাকা কোটি কোটি টাকার। এই টাকা একজন মৃত বাংলাদেশি নাগরিকের। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতেন। ২০১১ সালে শিকাগোতে অগ্নিদুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। তবে ডলার ভর্তি এই বাক্স কুরিয়ার কোম্পানির কাছ থেকে আনতে মানসুরাকে গুনতে হবে ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। বিদেশি এই চক্রের ফাঁদ বুঝতে পারেন মানসুরা। তিনি সিআইডি সাইবার পুলিশ সেন্টারের পেজে অভিযোগ জানান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি বিদেশিদের একটি অনলাইন প্রতারণার ফাঁদ। এই চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশিরাও কখনো কখনো জড়িত থাকে।
মানসুরা বলেন, চক্রটি খুব কৌশলী। ‘লিসা মার্টিনেজ’ এর পাঠানো বার্তায় যা ছিল- ‘আমি নিউ ইয়র্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্টের লিসা মার্টিনেজ।’ এরপর তিনি আমার সম্পর্কে জানতে চান। আমি তাকে আমার সম্পর্কে বলি। এরপর আরেকটি বার্তা পাঠান। তাতে লেখেন- আমি নিউ ইয়র্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাকাউন্ট অডিটর হিসেবে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে কাজ করি। আমি সবসময় চেয়েছিলাম বাংলাদেশে একজন বন্ধু থাকুক। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী। পরবর্তীতে তিনি আমার পেশা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে চান। এরপর মেসেঞ্জারে আরেকটি দীর্ঘ বার্তা পাঠান। তাতে লিখেন- ‘আমি আপনার জন্য একটি দুর্দান্ত খবর নিয়ে এসেছি, আমাদের একজন ধনী গ্রাহক যিনি আপনার দেশের কিন্তু এখানে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে) তার জীবন কাটিয়েছেন। ৬ মিলিয়ন মার্কিন ইউএসডি রেখে মারা গেছেন। তার নাম মোহাম্মদ ইউসুফ। তিনি ২০১১ সালের ২রা জানুয়ারি শিকাগোতে তার বাড়িতে অগ্নি দুর্ঘটনায় মারা যান। তার স্ত্রীও অগ্নিকাণ্ডে মারা যান। তার কোনো আত্মীয় নেই। আমি আপনার সঙ্গে এ কারণে যোগাযোগ করছি কারণ আপনি কিছু আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই ভাগ্যের উত্তরাধিকারী হতে পারেন। প্রয়োজনীয় আইনি নথি যা ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় আপনাকে উল্লিখিত পরিমাণ টাকা রিলিজ করতে পারবো এবং আমি তা প্রস্তুত করবো।
মানসুরা বলেন, বিষয়টি সম্পূর্ণ গোপন রাখার জন্য বলেন এবং এই সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলতে হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার চান। তিনি যে প্রতারণার ফাঁদ পাতছেন এটি বুঝতে পেরে ঘটনাটি সম্পর্কে আরও জানার আগ্রহ হয়। পরবর্তীতে আমার হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার দেই। এবং তিনি আমাকে ৬৩৯৩৫৩৬৬৫৯২৩ এই হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার থেকে বার্তা দেন। সেটি ছিল ১৮ সেকেন্ডের একটি ভিডিও বার্তা। সেই ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, আমি ভিডিও বার্তাটি পাঠিয়েছি যাতে আপনি এটা স্পষ্ট বুঝতে পারেন যে, আমি সত্যি এবং এই চুক্তিতে আমরা যাতে সফল এবং ধনী হতে পারি। অনুগ্রহ করে এই চুক্তি সম্পর্কে সবকিছু গোপন রাখুন। বর্তমানে আমি ব্যাংক প্রাঙ্গণে বসবাস করছি। আমি এখানে থাকবো এবং ছুটি কাটাতে দুই মাস পর বাড়ি যাবো। সেজন্য দ্রুত এই ভিডিওটি রেকর্ড করেছি। যাতে জানতে পারেন আপনি একটি বাস্তব চুক্তিতে আছেন। এরপর আমি ব্যাংক নীতির কারণে ভয়েস বা ভিডিও কলের মাধ্যমে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবো না। আমার প্রস্তাব শতভাগ ঝুঁকিমুক্ত না যতক্ষণ না আপনি আমার নির্দেশাবলী অনুসরণ করেন। তবে আমি প্রক্রিয়া শুরু করার আগে আপনার সঙ্গে এই চুক্তি, আমাকে আশ্বস্ত করতে হবে আপনি এই চুক্তি সম্পর্কে সবকিছু গোপন রাখবেন শুধুমাত্র আপনার এবং আমার মধ্যে থাকবে। এরপর তিনি তার আইডি কার্ডের ছবি পাঠান। সঙ্গে কিছু নথি পাঠান সেগুলো মৃত ইউসুফের আমানত প্রশংসাপত্র, ডেড সার্টিফিকেট। এবং সেটি ব্যাংক ম্যানেজারের হোয়াটসঅ্যাপ (+৬৩৯৭৭১৪৬৫৭৯৯) নম্বরে ফরওয়ার্ড করতে বলেন। এবং ব্যাংক ম্যানেজার যে চিঠি পাঠাবে সেটি নিউ ইয়র্ক কাউন্টি সুপ্রিম কোর্ট আইন উপদেষ্টাকে এই হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে (+৬৩৯৮৫২২৭৭৪৩৬) পাঠাতে হবে। আমিও তার দেয়া এই নির্দেশাবলি অনুসরণ করি।
মানসুরা বলেন, তিনি ব্যাংক ম্যানেজারের আরেকটি হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার দেন (+৬৩৯৪৮৬৩৭৭৯৪২)। এই নাম্বারটি থেকে দুইটি টাকা ভর্তি লাগেজের ২৬ সেকেন্ডের একটি ভিডিও পাঠান। এরপর আমার ঠিকানা নেন। এই ঠিকানা সংযুক্ত করে একটি চিটি পাঠিয়ে সেটি শিপিং কোম্পানির হোয়াটঅ্যাপ নাম্বারে (+১৯৭২৫২১৮৪১৭) পাঠাতে বলেন। শিপিং কোম্পানি লাগেজ নেয়ার জন্য ১৩২০ ডলার (১ লাখ ৪৫ হাজার) টাকা ডেলিভারি ফি পাঠাতে বলেন। সেই সঙ্গে দুইটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বার পাঠান।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, এটি একটি অনলাইন প্রতারণার ফাঁদ। এসব বিষয় নজরে এলে ভুক্তভোগীদের আমাদের সিআইডি সাইবার সেন্টারের হটলাইনে সকল এভিডেন্সসহ অভিযোগ করতে হবে। যাতে করে এসব প্রতারককে ফাইন্ডআউট করা যায়। তাদের দেয়া ফোন নাম্বার, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বার তদন্ত করে পদক্ষেপ নিবো। এ সব ঘটনায় যারা সচেতন তারা ভুক্তভোগী হয় না। কিন্তু একটু অসচেতন হলে সহজে এই ফাঁদে অনেকে পড়ে যান। আমরা অভিযোগ পেলে সবসময় শনাক্তের চেষ্টা করি। এই রকম চক্রগুলো এভাবে লোভ দেখিয়ে অনেককে প্রতারণার ফাঁদে ফেলেছে। এসব ফাঁদে পা দিয়ে অনেকে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। অনেক সহজ, সরল লোক আছে তারা সহজে ভুক্তভোগী হয়ে যান। সবচেয়ে বড় কথা সচেতন হতে হবে, ভার্চ্যুয়াল সাইটে অপরিচিত কারও সঙ্গে কথা বলা যাবে না বা কোনো ইনফরমেশন শেয়ার থেকে বিরত থাকতে হবে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর পক্ষ থেকে সবসময় সচেতন থাকতে বলা হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।