মেহেদী হাসান রোমান : মাশরাফীর সাথে বাটারফ্লাই ইফেক্টের বেশ মিল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাটারফ্লাই ইফেক্টের নাম যারা শুনেছেন, তারা এর একটি থিওরির সাথে বেশ পরিচিত। এটি অনু্যায়ী, পৃথিবীর সবকিছুই অন্য ঘটনাপ্রবাহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এমনকি এমন কিছু ঘটে থাকে যার জন্য অন্য একটা ব্যাপার সমান্তরাল অথবা বুমেরাং হয়ে চলতে থাকে। বাটারফ্লাই ইফেক্ট অনু্যায়ী, জাপানের টোকিওর একটি লেকে ঢিল ছোড়ার কারণে বায়ুপ্রবাহের যে পরিবর্তন হয়, তার জন্য কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলে সুনামি আঘাতও হানতে পারে।
একটি বাণিজ্যিক পণ্যের বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়ে মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা তার সংলাপে বলেছিলেন, ‘পা দুটো বেইমানি করলেও ঘাড়ের রগ বাঁকা করে চ্যালেঞ্জ করবো নিজেকেই। শুধু একটা বল করতে চাই বাংলাদেশের জন্য।’এমন কঠিন, দৃঢ়চেতা ও লড়াকু মানসিকতার জন্যই আপামর জনতা ভালোবেসেছিল তাকে। পরম শ্রদ্ধায় তাকে বসিয়েছিল সম্মানের স্বর্ণচূড়ায়। আর সেই মাশরাফীও বিশ্ব মঞ্চে বুক চিতিয়ে লড়তেন দেশের জন্য। ইনজুরি আর অস্ত্রোপচারের টেবিল থেকে বারবার ফিরে এসেছেন মাঠে। তাকে দেখা গেছে লাল-সবুজ জার্সি গায়ে।
বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা অধিনায়কও বলা হয় নড়াইল এক্সপ্রেসখ্যাত মাশরাফীকে। বিশ্বমঞ্চে টাইগারদের অনেক বড় অর্জনের সাক্ষী ও তার নেপথ্যে তার ছিলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ২০১৫ বিশ্বকাপে দলকে কোয়ার্টার ফাইনাল ও ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশ তার নেতৃত্বেই খেলে আইসিসির মেজর ইভেন্টের সেমিফাইনাল। ২০০৪ সালে বাংলাদেশের শততম ওয়ানডে এবং ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে দুবারই ভারতকে হারায় টাইগাররা। দুইবারই বল হাতে যেন বর্ম ছুড়ে ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপকে তছনছ করে দিয়েছিলেন মাশরাফী।
ক্যারিয়ারে একাধিকবার ইনজুরিতে পরেছেন। সেখান থেকে ফিরে এসেছেন বারবার। বাংলাদেশের মানুষ মাশরাফীকে তার ক্যাপ্টেন সত্তায় পেয়েছে অনেক পরে। তার আগে নড়াইলের চিত্রাপাড়ের এই কৌশিক (মাশরাফীর ডাকনাম) ছিলেন ক্রিকেটার মাশরাফীর বাইরেও অন্যকিছু। মাশরাফীর সমার্থক শব্দ হয়ে গেছিলো অনেকগুলো। সেগুলো ছিলো ইতিবাচকতায় পূর্ণ। ভক্তরা ভালোবেসে ক্যাপ্টেনের সাথে আরও ইংরেজি অনেক বিশেষণে বিশেষায়িত করতো মাশরাফীকে।
মানুষের এমন ভালোবাসায় মাশরাফী পেয়েছিলেন বীর খেতাব। ক্রিকেটার পরিচয়কে ছাপিয়ে তরুণদের কাছে মাশরাফী হয়ে উঠেছিলেন এক আইডলের নাম। মাশরাফী কেবল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নন। বরং সবারই ক্যাপ্টেন। তার বিদায় কেনো মিরপুর থেকে হলো না, কেনো বিদায়ী ম্যাচে ভক্তরা তাদের আইডলকে বর্নিল বিদায় দিতে পারলেন না তা নিয়েও ক্ষোভ ছিলো ক্রিকেটভক্তদের কাছে।
কিন্তু সেই ‘ক্যাপ্টেন মাশরাফী’ এবার পরিণত হলেন হাসির পাত্রে। এরজন্য দেশে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
মাশরাফী এখন তার জাতীয় দলের অধিনায়ক নন। তবে তার লিগ্যাসি তাকে ‘ক্যাপ্টেন ম্যাশ’ হিসেবেই পরিচিত করায় এখনও। এখন সে পুরাদস্তুর রাজনীতিবীদ। নড়াইলের একটি উপজেলার পুরোটা এবং অপর উপজেলার আংশিক নিয়ে গঠিত নির্বাচনী এলাকার জনপ্রতিনিধি সে। সেখানকার মানূষের দুঃখ-দুর্দশা, প্রয়োজন তাকে দেখতে হচ্ছে এখন।
এর মাঝে দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেশজুড়ে চলছে চরম অস্থিরতা। সরকারি হিসেবে যখন নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে দেড়শো’র ঘর, বেসরকারি হিসেবে সেই সংখ্যাটাকে বলা হচ্ছে আরও অনেক বেশি। যার হিংসভাগই আবার তরুণ ছাত্র। এই তরুণদের কাছেই মাশরাফী ছিলেন এক আইডলের নাম। মাশরাফীর রাজনৈতিক পরিচয় ভুলে ব্যক্তি ম্যাশকে তারা অনুসরণ করতো। এই শতাব্দীতে জন্ম নেয়া অনেকেই যখন বাল্যকাল অতিক্রম করছে তখন মাশরাফী তার ক্যারিয়ারের প্রাইম টাইমে। এমনকি মাশরাফীর কলার উঁচু করা ট্রেন্ডও যুবকেরা গ্রহণ করেছিলো যারা পেস বল করতো পাড়ার মাঠে। কিছুটা স্টাইল আইকন বললেও ভুল হবে না।
শিক্ষার্থীদের মনে হয়েছে চলমান এই ছাত্র সমাজের যৌক্তিক গণআন্দোলনে সমর্থন দেননি ক্যাপ্টেন ম্যাশ। যে মাশরাফী দলের নেতা ছিলেন, দলের অভ্যন্তরীণ অনেক সমস্যা নিজ গুনে সমাধান করে ফেলার ক্ষমতা ছিলো যার, বিশ্বকাপের আগে জাতীয় দলের এক খেলোয়াড়কে যখন প্রধানমন্ত্রী ডেকেছিলেন গণভবনে। সেদিনও বড়ভাইয়ের মতো ম্যাশ ছিলেন সাথে। এছাড়া নানা ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব মাশরাফী কেনো চুপ রইলেন কোটা সংস্কার ইস্যুতে, এই হিসেবটাই হয়ত মিলাতে পারছিলো না কেউ কেউ।
হতে পারে এই মাশরাফী তাদের কাছে অচেনা। স্বাভাবিকভাবেই তাই ম্যাশকে নিয়ে সমালোচনায় মেতেছে অনেকে।
যারা এতদিন ভালোবাসা আর সম্মানে মাথায় বসিয়েছিল মাশরাফীকে। এবার সেই তারাই মাশরাফীর একটি দেয়াল ছবিকে ব্যাঙ্গ করে জোকার বানিয়ে দিয়েছেন। সেই ছবিতে নিক্ষেপ করছেন জুতা। ছবির দুই পাশের লেখা, ‘ওহ ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন’ মুছে ফেলা হয়েছে। মাশরাফিকে বলা হচ্ছে ক্লাউন।
এখন বিষয়টা এমন না যে মাশরাফী শিক্ষার্থীদের পক্ষে একটি ইতিবাচক স্ট্যাটাস দিলেই দেশের এত কিছু হত না। মাশরাফী মানুষ, তাকে আবেগে আমরা সুপারহিরো ভেবে নিলেও সে মাটিতে পা রেখে চলা আর পাঁচটা মানুষের মতোই।
তবে এতো কিছুর পরেও যদি, কিন্তু, তবুও থেকে যায়। মাশরাফী ভিলেন বনে যাননি, তবে তার স্টারডমে ভাটা পড়েছে এটা সত্যি। তাকে জোকার বানিয়ে মজা নিতে চায়নি কেউ। কারণ সেই মজা আসলে শিক্ষার্থীদেরও ভালো লাগেনি। মাশরাফী মজার বস্তু হবেন কেন? শিক্ষার্থীদের রাগ তাদের ক্যাপ্টেন ম্যাশ চুপ কেন। ম্যাশের কথা শুনতে চেয়েছিলেন তারা। এটা মাশরাফীর ভক্তদের অধিকারও বটে। ব্যাস এটুকুই।
মাশরাফীকে নিয়ে ট্রল করা হয়নি। যারা মাশরাফীর ছবি বিকৃত করেছেন তারা শৈশবের সুপারহিরোকে বোবা হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। কৌশিককে হয়ত তারা চেনেন না। তাদের ক্যাপ্টেন ম্যাশ চুপ কেন এই অভিযোগ আর অভিমান তাদের। আর এই অভিমানটা হয়ত মাশরাফীর প্রতি তাদের অধিকার- এমনটাও মনে করতে পারেন তারা।
ওই যে বাটারফ্লাই ইফেক্ট। মাশরাফীকে কে বলেছিলো জনতার সুপারহিরো হতে? তিনি হয়ে গিয়েছিলেন। এই হয়ে যাওয়াটাই তার প্রতি কিছু বিষয়ে আকাঙ্খা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকের। এখন এটাকে মাশরাফী কিভাবে দেখে। খ্যাতির বিড়ম্বনা নাকি অন্যকিছু? সেটা মাশরাফীই ভালো বলতে পারবেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।