লক্ষ্মীপেঁচা বাংলাদেশের সবচেয়ে নিরীহ ও সুন্দর পেঁচা। অন্য পেঁচাদের চেয়ে সে প্রকৃতি ও মানুষের ঘনিষ্ঠতর বন্ধু। সে কৃষকের পরম বান্ধব। বাংলাদেশের অন্য পেঁচাদের মুখ গোলাকার, কিন্তু লক্ষ্মীপেঁচার মুখ অদ্ভুত, অন্য রকম। পানপাতা, বটপাতা বা মানুষের হৃদপিণ্ডের মতো মুখখানা কেমন যেন একটা কৌতুক কৌতুক ভাব আছে।
লক্ষ্মীপেঁচার ইংরেজি নাম Barn Owl। বৈজ্ঞানিক নাম Tyto alba, শরীরের মাপ ৩৪-৩৬ সেন্টিমিটার। পুরুষের চেয়ে মেয়েরা সামান্য বড় হয়ে থাকে। এদের মুখের গড়নের সঙ্গে যেমন দুনিয়ার অন্য কোনো পেঁচার (ভারত-নেপালের ঘাসপেঁচা ছাড়া) মিল নেই, তেমনি কণ্ঠস্বরও অন্য পেঁচাদের মতো ভয়ঙ্কর, ভয় জাগানিয়া নয়। ধাতব ‘ক্রিচ ক্রিচ, হিসস সিস, ক্রি ক্রি’, স্বরে ডাকে। কেবল বাসা ছাড়া বা উড়তে শেখা ছানারা খিদের কান্নায় যখন মা-বাবাকে ঘিরে ধরে, তখন ওদের কণ্ঠস্বর ছড়ায় অনেকদূর পর্যন্ত।
লক্ষ্মীপেঁচার বিশেষ বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এদের মুখমণ্ডলের গড়ন বানরের মুখমণ্ডলের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়া যায়। তাই এদের আরেক নাম বানরমুখো পেঁচা। এই পেঁচা হিন্দু সম্প্রদায়ের লক্ষ্মীদেবীর বাহন। মুখমণ্ডলের রং সাদা, চোখ বেতফলের শাঁসের মতো কালো, চকচকে। কপাল আর ঠোঁটের আদল এমন যে, মনে হয় আফ্রিকান বেবুনের নাক। ঠোঁটের পাশে আবার গোঁফের মতো অতি সূক্ষ্ম একটা টান চলে এসেছে ঠোঁটের গোড়া পর্যন্ত। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় ঠোঁট খুব ছোট। কিন্তু তা নয়। আর শরীরের তুলনায় মাথাটা বেশ বড়, গোলগাল।
একনজরে লক্ষ্মীপেঁচার মাথা-পিঠ-ঘাড় ও পাখার ওপরিভাগের রং ধূসর, হালকা ও সোনালি রঙের মিশেল। মনে হয় চকচক করছে, তাতে আবার চমৎকার সাদাটে ও কালচে ছিট। গলা-বুক-পেট সাদা, পা-ঢাকা লোমও সাদা। শরীরের এই নিচের অংশগুলোতে (পা বাদে) হালকা হলুদ রঙের ছিট আছে। লক্ষ্মীপেঁচাদের সারা শরীরে যেন আব (আবির) লাগানো। এদের ডানার নিচের রং সাদা, লেজের তলার রং লালচে-হলুদ।
এই লালচে হলুদের ওপর কয়েকটি পাথালি কালো টান আছে। এদের পালকগুলো মখমলের মতো নরম ও পেলব। নখরগুলো বড়শির মতো বাঁকা, জোরালো ও ধারালো। মাথা গোলাকার, ডানা লম্বাটে, লেজ খাটো। দুরন্ত শিকারি এবং ওড়ায় দক্ষ। অন্য পেঁচাদের মতো লক্ষ্মীপেঁচার চোখ বড় বড় নয়।
বাংলাদেশের সব জায়গায় লক্ষ্মীপেঁচা আছে। খোদ রাজধানী শহরে অনেক লক্ষ্মীপেঁচার বাস। পুরনো দরদালানের ফাঁকফোকর ও গাছের কোটরে বিশ্রাম করে সারাদিন। রাতে বের হয়। নিশাচর, তাই নিবিড় পর্যবেক্ষণ কঠিন। এরা আছে সুন্দরবনে, আছে বান্দরবানে আর গারোপাহাড়ে। এরা আছে গ্রামে-গঞ্জে এবং ছোট শহরে। বাংলাদেশের বাইরে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও মায়ানমারেও আছে।
লক্ষ্মীপেঁচার মূলখাদ্য নানা জাতের ইঁদুর। হোক ঘরের নেংটি কিংবা মাঠের বড় কালো ইঁদুর (ওজন প্রায় ২ কেজি)। এছাড়া খায় কাঠবিড়ালি, ছোট সাপ, ব্যাঙ, কাঁকড়া, পাখি, চামচিকা ও পাখির ডিম-বাচ্চা। ধেনো ইঁদুর খুব প্রিয় খাবার। রাতের ধানক্ষেত-আলুক্ষেতে ইঁদুর শিকার করার সময় কখনো কখনো লড়াই লাগে বনবিড়াল ও সাপের সঙ্গে। কেননা ওরাও ইঁদুর খায়। বিষধর সাপ ধরে লক্ষ্মীপেঁচারা। ওরা শ্রবণশক্তি দিয়েই শিকারের নড়াচড়ার সঠিক জায়গাটা শনাক্ত করতে পারে। বিষধর সাপ ধরার জন্য আমি ১৯৬৫ সালে বড়শিতে ব্যাঙ গেঁথে ফেলে রেখেছিলাম, তাতে একটি লক্ষ্মীপেঁচা আটকে ছিল।
বর্ষাকাল ছাড়া লক্ষ্মীপেঁচারা বছরের যেকোনো সময়ে বাসা বাঁধতে পারে। বছরে দুই বার ডিম-বাচ্চা তোলে। কোনো কারণে ওগুলো নষ্ট হলে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আবারো ডিম পাড়ে। ডিম প্রায়শ ৬টি, কখনো ৭টি ও ৯টি। দুজনে পালা করে তা দেয়। বাসা আকারে বড় হলে দুজনে এক সঙ্গেই তা দেয়। তাছাড়া দিনে বাসায় থাকতে হয় বলে ডিম বুকেই বসতে হয়।
ডিমের রঙ সাদা। অনেকটা গোলাকার ধরনের। ফোটে ৩০-৩৩ দিনে। ছানাদের বয়স মাসখানেক হলে বাসার ভেতর থেকে বেরিয়ে আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করে। ৫/৭টি ছানা যখন পাশাপাশি বসে থাকে শরীরে শরীর মিশিয়ে, তখন দেখতে ভারি সুন্দর লাগে। মা-বাবা খাবার মুখে এলেই ওরা আগে খাবার জন্য ঠেলাঠেলি লাগায়, চেঁচায়। ছানারা উড়তে পারে ৫২-৫৫ দিন বয়সে। আরও মাস খানেক মা-বাবার সঙ্গে থাকে। তারপর আলাদা হয়ে যায়। নতুন উড়তে শেখা ছানারা বোকার হদ্দ থাকে বলে প্রায়ই মানুষের হাতে ধরা পড়ে এবং কাক-চিলসহ অন্যান্য পাখিদের নাগালে পড়ে নাস্তানাবুদ হয়।
দিনের বেলায় এরা যেখানে লুকিয়ে থাকে, সাধারণত সেখানেই বাসা বাঁধে। প্রয়োজন না হলে বাসায় কোনো উপকরণ ব্যবহার করে না। আমার বাসার চিলেকোঠার ডালা ও বাক্সে গত ২০ বছরের ভেতর ৯ বার ডিম-বাচ্চা তুলেছে লক্ষ্মীপেঁচা। তার ভেতর ২ বার ডিম পেড়েছিল ৯টি করে। কাকেরা দূর থেকে মাঝে-মধ্যে হল্লা করত বটে, তবে সুবিধা করতে পারেনি। ১৯৭৪ সালে একটি লক্ষ্মীপেঁচার ছানাকে আমি তাঁতিবাজারের বুনো বানরদের হাতে দেখেছিলাম। ওরা ছানাটিকে নিয়ে খেলছিল। কী জানি, স্বগোত্রীয়ই ভেবেছিল কি না!
অপরের বাসা দখলের প্রবণতাও লক্ষ্মীপেঁচাদের রয়েছে। আবার নিরিবিলি পরিবেশ হলে মানুষের ঘরের ভেতরেও বাসা করতে পারে। ১৯৭১ সালে এক হিন্দুবাড়ির (কেউ ছিল না টানা ৮ মাস) রান্নাঘরের ঝুলন্ত শিকের ভেতরের মাটির হাঁড়িতে লক্ষ্মীপেঁচার ৭টি ডিম দেখেছিলাম। এরা একই বাসা বার বার ব্যবহার করতেও ভালোবাসে।
পাহাড়-টিলাময় এলাকায় এই পেঁচা পাহাড়-টিলার খাঁজ বা খোঁদলে বাসা করে। বর্তমান বাংলাদেশে লক্ষ্মীপেঁচারা যথেষ্ট ভালো অবস্থায় আছে। খাদ্যাভাব নেই, নেই বাসা করার জায়গার সঙ্কট। ভালো থাক এই মহা উপকারী পাখিটি। কৃষকের বন্ধু হয়েই সে টিকে থাকুক আরও বহুকাল সোনার বাংলায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।