আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষ্যে গত বছর লিথুয়ানিয়ার ভিলনিয়াসে জড়ো হয়েছিলেন ন্যাটো-নেতারা। ‘ইউক্রেন’ প্রশ্নে ন্যাটোর সংকল্প এবং প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ‘একটি সুস্পষ্ট বার্তা’ দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল ঐ সম্মেলনে। ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করা হবে কি না—এই প্রশ্নের চূড়ান্ত সমাধান টানার বিষয়েও একমত ছিলেন নেতারা। তবে ভিলনিয়াস সম্মেলন এসব প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। বরং সম্মেলন শেষে ন্যাটোর পক্ষ থেকে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, তা ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ন্যাটোর বুখারেস্টে শীর্ষ সম্মেলনের কথাই মনে করিয়ে দেয় নতুন করে।
বুখারেস্ট সম্মেলন ঘিরে ন্যাটোতে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ব্যাপক তোড়জোড় ছিল। এ নিয়ে সম্মেলনে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা হয় নেতাদের মধ্যে। তবে দিন শেষে কিয়েভকে সেই পুরোনো প্রতিশ্রুতির বাণীই শোনানো হয়। কিয়েভের ‘মাথায় হাত দিয়ে’ জানিয়ে দেওয়া হয়, ‘ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করা হবে, তবে সময় লাগবে। সেই সময় এখনো আসেনি।’
ন্যাটোর এ ধরনের প্রতিশ্রুতি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির স্বভাবতই ভালো লাগার কথা নয়। ভিলনিয়াস সম্মেলনের পর নাখোশ জেলেনস্কি ন্যাটোর প্রতি বিষোদগার করে বসেন। ইউক্রেনকে সদস্য করার বিষয়ে ‘একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমা’ ঠিক করতে না পারা কিংবা ‘না করতে চাওয়া’কে ‘অভূতপূর্ব ও অযৌক্তিক’ বলে অভিহিত করেন। ইউক্রেনকে ন্যাটো সদস্য করার বিষয় ঝুলে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য, বিশেষ করে বাইডেন প্রশাসনের জন্য বেশ অস্বস্তিকর বটে।
সম্প্রতি (৯-১১ জুলাই) ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে। ওয়াশিংটনে আয়োজিত এই সম্মেলনে মিলিত হন ন্যাটোর ৩২টি দেশের নেতা। তবে এ সম্মেলনেও সুরাহা হয়নি ইউক্রেনকে জোটের সদস্য করার বিষয়ের। বলতে হয়, এই আলোচনা লাইনচ্যুত হয়ে গেছে। ওয়াশিংটনে জোটের ৭৫তম বার্ষিকী উদ্যাপন করতে ন্যাটো নেতারা এক টেবিলে বসলেন বটে, কিন্তু ইউক্রেনকে সদস্যপদ করার বিষয় আগের মতোই ঝুলে রইল প্রতিশ্রুতির বাণীতে।
ইউক্রেনকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তি করার কথা উঠলে সব সময়ই লক্ষ করা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বলে থাকে—‘এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।’ ওয়াশিংটন সম্মেলনের পর, তথা এবারও একই ধরনের ‘ভাষা’ ব্যবহার করা হয়েছে ন্যাটোর পক্ষ থেকে। মাস কয়েক আগে ন্যাটোর সদ্য সাবেক মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ একই ধরনের কথা বলেছিলেন। তার বক্তব্য ছিল, ‘ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করা হবে, তবে সেই সময় এখনো হয়নি।’
ইউক্রেনকে আদতে ন্যাটো সদস্য করা হবে কি না কিংবা করা হলে নেতাদের পক্ষ থেকে বলা ‘সেই সময়’ ঠিক কখন, কবে আসবে, তা যেন জানার উপায় নেই! যদিও বাস্তব চিত্র বলে ভিন্ন কথা। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হচ্ছে—এমন দাবির শক্ত কোনো ভিত্তি নেই। এমনকি ন্যাটো ইউক্রেনকে জোটে যুক্ত করার ক্ষেত্রে সেভাবে প্রস্তুত বলেও মনে হচ্ছে না। বরং কিয়েভকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়াটা ‘বাজে সিদ্ধান্ত’ হবে বলেই মনে করে বেশির ভাগ ন্যাটো সদস্য। এ ধরনের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাটোর উচিত ঝেড়ে কাশা। উপরন্তু, হোয়াইট হাউজেরও উচিত, জেলেনস্কির কাছে এ বিষয়ে খোলাসা করে বলা।
চলমান বৈশ্বিক বাস্তবতার মুখে ‘একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী দেশ’ হিসেবে ন্যাটোর সদস্য হওয়া ইউক্রেনের জন্য কতটা কঠিন—এই বিষয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিষ্কার করা উচিত। ন্যাটো সনদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে, জোটভুক্ত কোনো একটি সদস্য আক্রান্ত হলে, সেই সদস্যের ওপর আক্রমণ এলে, তা সব সদস্যের জন্য প্রযোজ্য হবে। সেই অবস্থায় সদস্য দেশগুলো আক্রান্ত দেশকে রক্ষায় যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য থাকবে। যেমন—ন্যাটোর সদস্য হিসেবে এখন কোনোভাবে পোল্যান্ড যদি আক্রান্ত হয়, তাহলে কাগজেকলমে পোল্যান্ডকে রক্ষা করতে বাধ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র আক্রান্ত হলে পোল্যান্ডও এগিয়ে আসতে বাধ্য। জোটভুক্ত অন্য সব দেশের ক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য।
মুশকিল হলো, রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধ চলছে। এমন একটি মুহূর্তে ইউক্রেনকে সদস্য করা হলে অবধারিতভাবে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে ন্যাটো। সেক্ষেত্রে ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত সর্বাত্মক রূপ ধারণ করবে। সেই অবস্থায় পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের পথে পা বাড়াতে পারেন, যার ফলে বিশ্বে নেমে আসবে এক চরম অন্ধকার। ঠিক এই কারণেই ন্যাটোর অনেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ইউক্রেনকে এখনই ন্যাটোভুক্ত করার বিপক্ষে।
কিয়েভকে ন্যাটো সদস্য করার বিষয়ে ‘আপত্তি’ নতুন কোনো বিষয় নয়। ২০০৮ সালে তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করার বিষয়ে প্রস্তাব দিতে চেয়েছিলেন। ঐ সময় সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্র জর্জিয়াকেও ন্যাটোর সদস্যপদ করে নেওয়ার প্রস্তাব ছিল বুশের পক্ষ থেকে। তবে ফ্রান্স ও জার্মানিসহ বেশ কিছু ন্যাটো সদস্য বুশের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বসে।
এরপর ’১৪ সালের মার্চে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেওয়ার পর ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্য হওয়ার বিষয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়। বলা যায়, তখন এই বিষয় হয়ে ন্যাটোর ‘টপ অ্যাজেন্ডা’। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের তত্পরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। অবশ্য আগের মতোই আলোচনা বেশি দূর গড়ায়নি। শেষ পর্যন্ত তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কিয়েভের উদ্দেশে বলেন, ‘দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে লালন করার জন্য ন্যাটোতে ইউক্রেনকে যুক্ত করার জন্য বৈঠক চালিয়ে যাবে ওয়াশিংটন।’
ওবামার এ ধরনের কথাই যেন কিয়েভের একমাত্র সান্ত্বনা! গত মাসে বাইডেনও একই ধরনের কথা বলেছেন। তবে তিনি এ-ও বলেন, ‘ইউক্রেনকে সদস্য করার বিষয়ে ন্যাটো এখনো প্রস্তুত নয়।’ এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘ন্যাটো ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। একটি সদস্যও যদি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আপত্তি জানায়, তাহলে এই প্রচেষ্টা বিফল হবে। এ কারণে সব সদস্য একমত না হওয়া পর্যন্ত ন্যাটোতে কিয়েভের যোগদান অবরুদ্ধই থাকবে।’
বাইডেনের কথার সূত্র ধরে হিসাব করে বলা যায়, যতদিন ইউক্রেনের যুদ্ধ চলবে, ততদিন ন্যাটোতে প্রবেশ করতে পারবে না কিয়েভ। এই বাস্তবতার বাইরে যাওয়া নেহাত কল্পনাপ্রসূত চিন্তা। এর কারণও একদম স্পষ্ট—যেমনটা আগেই বলা হয়েছে। ইউক্রেন জোটের সদস্য হয়ে গেলে ন্যাটোর সব সদস্য সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে লড়াই করতে বাধ্য হবে।
জেলেনস্কি আসলেই বিচক্ষণ! রাশিয়ার আগ্রাসনের একেবারে প্রথম দিন থেকেই সদস্য হওয়ার জন্য তিনি রীতিমতো উঠেপড়ে লেগেছেন। এজন্য বহু সময় ব্যয় করেছেন তিনি। তবে ন্যাটোতে কিয়েভের অন্তর্ভুক্তির পথে যে জটিলতা আছে, তা তারও অজনা নয়। আর এ কারণেই তিনিও রয়েসয়ে এগোচ্ছেন।
এ রকম একটি পটভূমিতে প্রশ্ন উঠতে পারে, ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদান কি তাহলে কেবল আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? এই প্রশ্নের উত্তর বেশ জটিলই। তবে কিয়েভের জন্য ‘সম্ভাবনার দুয়ার’ বন্ধ হচ্ছে না শিগিগরই! রাশিয়ায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইকেল ম্যাকফাউলের মতো অনেক পররাষ্ট্রনীতি পণ্ডিত মনে করেন, ‘যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো সঠিক পদক্ষেপ হবে।’
এ ধরনের চিন্তায় বাগড়া আছে! কারণ, এর ফলে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধকে টেনে লম্বা করতে চাইবেন পুতিন। এতে করে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে ইউক্রেনের মাটিতে যুদ্ধ চলবে। আসলেই তো! পুতিন কেন যুদ্ধ বন্ধ করবেন, যখন তিনি বুঝতে পারবেন যে, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেই ইউক্রেনকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়া হবে। অর্থাত্, হিসাব পরিষ্কার—ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদানের বিষয়টি এক ‘সমস্যামান দৃশ্যকল্প’।
সম্প্রতি বেশ কয়েক জন পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ এক খোলা চিঠিতে লিখেছেন (যেখানে আমিও স্বাক্ষর করেছি), ‘ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেই কিয়েভকে জোটে যোগদান করানো হবে—ন্যাটো যত বেশি এ ধরনের প্রতিশ্রুতি দেবে, ইউক্রেনের জোটবদ্ধ হওয়া আটকাতে পুতিন তত বেশি যুদ্ধ ও হত্যা চালিয়ে যাওয়ার প্রণোদনা পাবেন।’
ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো শুরু থেকেই বলে আসছে, এমনকি বারবার প্রমাণও দিচ্ছে যে, ইউক্রেনের পক্ষে তারা সরাসরি যুদ্ধে নামবে না। ইউক্রেনের সামরিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে ন্যাটো বিশ্বের বৃহত্তম পারমাণবিক শক্তির সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক, তা কেবল ন্যাটো সদস্যরা নয়, যে কেউই চাইবে না। আবার, সদস্য না করে কেবল ‘নিরাপত্তা গ্যারান্টি’র বাণী আওড়ানো নিছক কথার কথা কিয়েভের জন্য। সব মিলিয়ে উভয় সংকটে পড়েছে ন্যাটো। এ নিয়ে ন্যাটো নিজেকে যেন বিভক্ত করে ফেলছে, যা ক্রমশ প্রকাশ্য!
লেখক: ডিফেন্স প্রায়োরিটিজের ফেলো ও শিকাগো ট্রিবিউনের নিয়মিত কলামিস্ট
সিএনএন থেকে ভাষান্তর: সুমৃৎ খান সুজন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।