আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইউক্রেন তাদের রুশ-দখল করা ভূখণ্ড উদ্ধারের জন্য পাল্টা অভিযান শুরু করার পরে এখনো পর্যন্ত বড় কোনো সাফল্য পেয়েছে এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না।
ইউক্রেনীয় বাহিনী বলছে, পাল্টা অভিযানে এ পর্যন্ত জাপোরিশা ও দোনেৎস্ক অঞ্চলের আটটি গ্রাম পুনর্দখল করেছে তারা। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিও এখন স্বীকার করছেন যে যুদ্ধে অগ্রগতি প্রত্যাশার চেয়ে অনেক ধীর গতিতে হচ্ছে।
“কিছু লোক মনে করে যে এটা একটা হলিউড সিনেমা, তারা এক্ষুণি ফলাফল চায়। কিন্তু যুদ্ধ কোনো মুভি নয়”- বলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
তিনি স্বীকার করেছেন যে রুশদের বিরুদ্ধে তার বাহিনীর পাল্টা অভিযানে অগ্রগতি হচ্ছে “ধীর গতিতে।”
জেলেনস্কি এমন এক সময় এ কথা বললেন যখন ইউক্রেনের দক্ষিণ ও পূর্বদিকে রুশ অধিকৃত এলাকার প্রতিরক্ষাব্যূহ সংলগ্ন এলাকাগুলোতে ব্যাপক লড়াই চলার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এরই পাশাপাশি ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে নিয়মিত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চলছে।
ইউক্রেনীয় বাহিনী বলছে, দু-সপ্তাহব্যাপী পাল্টা অভিযানে এ পর্যন্ত জাপোরিশা ও দোনেৎস্ক অঞ্চলের আটটি গ্রাম পুনর্দখল করেছে তারা। অন্যদিকে ইউক্রেনেরই ডেপুটি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হান্না মালিয়ার বলছেন, দোনেৎস্কের বাখমুত ও লিমানে রুশ বাহিনীও এলাকা দখল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
মালিয়ার বলছেন, ইউক্রেনীয় সৈন্যরা এ পর্যন্ত ৪.৩ মাইল এগিয়েছে এবং ৪৪ বর্গমাইল এলাকা পুনর্দখল করেছে। সবশেষ দখল করা গ্রামটি হচ্ছে পিয়াটিখাটস্কি। স্থানীয় রুশ কর্মকর্তা এবং রুশ সামরিক ব্লগাররাও এ খবর নিশ্চিত করেছেন।
তবে এসব যুদ্ধে রুশ বাহিনীর স্থল ও আকাশ থেকে চালানো আক্রমণে ইউক্রেনীয় বাহিনী পশ্চিমাদের দেয়া নতুন কিছু ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান হারিয়েছে। প্রাণহানি কত হয়েছে তা প্রকাশ করা হয়নি।
রুশ বাহিনী বলছে, জাপোরিশা ও লিমানের কাছে তারা ইউক্রেনীয় আক্রমণ প্রতিরোধ করে তাদের হারিয়ে দিয়েছে।
কোনো দাবির সত্যতাই যাচাই করা যায়নি।
‘ইউক্রেন তেমন কোনো বড় অগ্রগতি ঘটাতে পারেনি’
ইউক্রেন যে সমস্ত অগ্রগতির কথা বলছে, সংবাদমাধ্যমগুলোর রিপোর্ট থেকে আভাস মেলে যে তার পরিমাণ খুবই সামান্য।
জেলেনস্কিও এখন বলছেন, তাদের পাল্টা অভিযান কঠিন হয়ে পড়েছে – কারণ ইউক্রেনের ৭৭,২২০ বর্গমাইল এলাকায় মাইন পেতে রেখেছে রুশ বাহিনী।
একটি ব্রিটিশ গোয়েন্দা রিপোর্টে রোববার বলা হয়, দক্ষিণের পুরো ফ্রন্টলাইন জুড়ে বেশ কিছু স্থানে যুদ্ধ তীব্রতর হয়েছে, তবে তেমন কোনো বড় অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।
এতে বলা হয়, উভয় পক্ষেই উচ্চ মাত্রায় ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি হচ্ছে এবং সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে এখানে হয়তো আগামী মাসগুলোতে কামান ও পরিখা-ভিত্তিক যুদ্ধ দেখা যাবে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ইউক্রেনীয় বাহিনী যতটা অগ্রগতি অর্জন করেছে তাকে ‘ক্ষুদ্র’ বলে অভিহিত করছে তারা।
বলা হয়, এটুকু অগ্রগতি অর্জনের জন্য তাদের প্রাণহানি এবং পশ্চিমা দেশগুলোর দেয়া অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংস হবার মতো মূল্য দিতে হয়েছে। রুশ বাহিনী এসব ক্ষয়ক্ষতিকে তাদের ‘ট্রফি’ হিসেবে প্রচার করছে।
কিছু বিশ্লেষক বলছেন, ইউক্রেনের কাউন্টার-অফেন্সিভের সাফল্য কতটা তা নিরুপণ করতে কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস লেগে যাবে।
দাবি-পাল্টা দাবির মধ্যে আসলে কী ঘটছে? এ যুদ্ধে আসলে কী হচ্ছে তা বলা খুবই কঠিন।
মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতা এ্যান্ড্রু ক্র্যামার জাপোরিশা থেকে জানাচ্ছেন, পরস্পরবিরোধী দাবি-পাল্টা দাবির কারণে যুদ্ধক্ষেত্রের প্রকৃত অবস্থা কী তা যাচাই করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তবে এসবের মধ্যেও কোনো পক্ষই যে খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থায় নেই তার আভাস পাওয়া যায়।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ও জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ জেনারেল মার্ক মাইলিও ইতোমধ্যেই স্বীকার করেছেন যে ইউক্রেনের বাহিনী তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে এবং তাদের সেনা ও পশ্চিমাদের দেয়া ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান– উভয়ে ক্ষেত্রেই ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।
তবে তারা এটাও বলেছেন, এই কঠিন পরিস্থিতি প্রত্যাশিত ছিল এবং ইউক্রেনীয়রা এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে।
রুশ প্রেসিডেন্টও বলছেন ‘ক্ষয়ক্ষতির’ কথা
ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও।
নিউইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে, সম্প্রতি এক বিরল স্বীকারোক্তিতে পুতিন বলেন, রাশিয়ার নিজস্ব কিছু সমস্যা আছে। এর মধ্যে আছে “নির্ভুলভাবে লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম” এমন অস্ত্রের সরবরাহের স্বল্পতা, আর একটি হলো রুশ বাহিনী ও ওয়াগনার নামের ভাড়াটে বাহিনীর মধ্যেকার সংঘাত।
এছাড়া কয়েকদিন আগে রুশ সংবাদদাতা ও সামরিক ব্লগারদের সাথে কথা বলার সময়ও পুতিন স্বীকার করেন যে জুন মাসে তারা ৫৪টি ট্যাংকসহ বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
ইউক্রেন যুদ্ধে অগ্রগতি হচ্ছে বলে যেসব দাবি করছে– সেগুলো স্বাভাবিকভাবেই অস্বীকার করছেন পুতিন এবং বলছেন যে ইউক্রেনীয় বাহিনী যে পরিমাণ ট্যাংক হারিয়েছে তার সংখ্যা “রুশ পক্ষের চেয়ে শত শত বেশি।” তাছাড়া “কোনো জায়গাতেই তাদের বলার মতো কোনো অগ্রগতি হয়নি”- একথাও বলেন তিনি।
দুর্ভেদ্য রুশ প্রতিরক্ষা ব্যূহ
এক সপ্তাহ আগেকার কিছু রুশ আক্রমণ থেকে ধারণা হয় যে কিয়েভের বাহিনীর সামনে অত্যন্ত বিপজ্জনক কিছু সমস্যা রয়েছে।
সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তারা যখন তাদের পরিখাগুলো থেকে বের হয়ে তাদের নিজেদের বাহিনীর বিমান প্রতিরক্ষা এবং ইলেকট্রনিক জ্যামিং ব্যবস্থার আওতার বাইরে চলে যাচ্ছে ।
এর ফলে তারা রুশ বিমান হামলার সহজ শিকারে পরিণত হবার ঝুঁকিতে রয়েছে।
আমেরিকানদের দেয়া স্টিংগারের মত কাঁধে-বহনযোগ্য বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে ইউক্রেনীয় সৈন্যরা সামনে এগুতে পারছে।
কিন্তু এর চাইতে উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা যা সামরিক যানের ওপর বসাতে হয়, সেগুলো নিয়ে সামনে এগুতে গেলে তাদের রুশ কামানের গোলার মুখে পড়তে হবে।
ইউক্রেন বহু দিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান চাইছে- যাতে তারা তাদের অগ্রসরমান বাহিনীকে আকাশ থেকে সুরক্ষা দিতে পারে।
তবে এফ-সিক্সটিন বিমান পেতে আরো অনেকটা সময় লাগবে ।
জেলেনস্কি বলছেন, তার ধারণা আগস্ট মাস নাগাদ ইউক্রেনীয় যোদ্ধা পাইলটদের প্রশিক্ষণ শুরু হবে এবং প্রথম এফ-সিক্সটিন বিমানের চালান আসতে আসতে ছয় থেকে সাত মাস পার হয়ে যাবে।
রুশদের আসল প্রতিরক্ষাব্যূহ এখনো অনেক দূরে
স্থল যুদ্ধ সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ এবং রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট বা রুসি-র একজন ফেলো জ্যাক ওয়াটলিং বুধবার এক নিবন্ধে লিখেছেন, এখন যেখানে যুদ্ধ হচ্ছে – রাশিয়ার আসল প্রতিরক্ষাব্যূহ এখনো তার থেকে অনেকটা দূরে।
তিনি বলছেন, ইউক্রেনের বাহিনী এখনো রুশদের হাতে-খোঁড়া পরিখা ও ছোট ছোট ফায়ারিং পজিশনগুলো ভেদ করে এগুনোর চেষ্টা করছে।
“কিন্তু সেখান থেকে ১৫-২০কিলোমিটার দূরে রয়েছে রাশিয়ার আসল প্রতিরক্ষাব্যূহ যেখানে আছে যথাযথভাবে তৈরি করা পরিখা, কংক্রিটের সুরক্ষিত ফায়ারিং পোস্ট, ট্যাংক প্রতিরোধী ব্যবস্থা, সমন্বিত আর্টিলারি সিস্টেম এবং আরো কিছু মাইন পাতা-এলাকা।”
ইউক্রেনের বাহিনী সামনে এগুলে তাদের আকাশ থেকে বিমান প্রতিরক্ষা যথেষ্ট জোরদার না হলে তারা রুশ হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমানের অব্যাহত আক্রমণের মুখে পড়বে।
তাছাড়া ইউক্রেন কোনো একটি জায়গায় খুব বেশি সৈন্য সমাবেশ করছে না।
ওয়াটলিং বলছেন, তারা চাইছে তাদের আক্রমণগুলোর ফলে রুশরা তাদের অবস্থানগুলোতে আরো সৈন্য নিয়ে আসুক, তাহলে তাদের দুর্বল জায়গাগুলো কোথায় তা বোঝা ইউক্রেনীয়দের জন্য সহজতর হবে।
তবে সেটা এখনো ঘটবে বলে রুশ নেতৃত্বের কথায় মনে হচ্ছে না।
‘দীর্ঘ ও কঠোর’ যুদ্ধের কথা বলছে ইউক্রেন
ইউক্রেনীয় বাহিনীকে এর মধ্যেই মাইনফিল্ড, পরিখা, ট্যাংকের অগ্রযাত্রা থামানোর জন্য খুঁড়ে রাখা গর্ত, বিমান হামলা এবং কামানের গোলাবর্ষণ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
স্বাধীন সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনীয়দের পক্ষে রুশদের প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেদ করা কঠিন হবে।
“আমাদের সামরিক বাহিনীকে দীর্ঘ এবং কঠোর যুদ্ধের জন তৈরি থাকতে হবে” – ফেসবুকে ডিফেন্স এক্সপ্রেস নামে একটি ইউক্রেনীয় গ্রুপে একথা বলেন একজন বিশ্লেষক ইভান কিরিচেভস্কি ।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক রিপোর্টে বলা হচ্ছে, রাশিয়া তাদের বিমান দিয়ে পাল্টা হামলা চালানোর যে কৌশল নিয়েছে তা ইউক্রেনীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রা শ্লথ করে দিতে পারে।
তাছাড়া এর ফলে রাশিয়ার বাহিনী হয়তো আরো বেশি প্রতিরক্ষাব্যূহ স্থাপন করার জন্য হাতে সময় পাবে। সূত্র : বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।