সাইফুল ইসলাম : মানিকগঞ্জ ট্রাফিক পুলিশের বিভিন্ন কর্মকর্তা ও সদস্যদের বিরুদ্ধে অবৈধ হ্যালোবাইক, সিএনজি, রিকশা, ট্রাক, লেগুনা, ট্রলি ও অন্যান্য পরিবহন থেকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। এতে বেপরোয়া যানবাহনের চাপ, নিয়ম ভঙ্গ, অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ নানা কারণে চালক ও যাত্রীদের ভোগান্তি বেড়েই চলেছে। জেলা শহর ও আশপাশের সড়কগুলোতে সৃষ্টি হচ্ছে নিয়মিত যানজট, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য।

গত তিন মাসের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ট্রাফিক বিভাগের ভেতরের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র। দেখা গেছে, অবৈধ অর্থ আদায়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা চলছে। অনৈতিক উপায়ে প্রতিনিয়ত হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বিপুল পরিমাণ টাকা। বিষয়টি নিয়ে পরিবহন চালকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
ডাম্পিংকৃত গাড়ি থেকে আদায়কৃত টাকা ভাগবাটোয়ারার অভিযোগ
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, প্রতি মাসে ছোট-বড় মিলিয়ে কমপক্ষে ৪০০ যানবাহন ডাম্পিং করে প্রতিটি থেকে দুই হাজার টাকা করে বিল আদায় করছে ট্রাফিক বিভাগ। এতে মাসে প্রায় আট লাখ টাকা তোলা হলেও সরকারি কোষাগারে এই অর্থ জমা না দিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ট্রাফিক বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ডাম্পিংকৃত গাড়ি থেকে আদায়কৃত টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়না। এই টাকা দিয়ে পুলিশের অফিসিয়াল ও বিভিন্ন খরচ মেইনটেইন করা হয়।
এ সংক্রান্ত তথ্য জানতে গত ১ নভেম্বর তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করা হলেও এক মাস পেরিয়ে গেলেও ইনস্পেক্টর (প্রশাসন) আব্দুল হামিদ তথ্য প্রদান করেননি।
বিভিন্ন রুটে মাসোহারা বাণিজ্য
মানিকগঞ্জের বিভিন্ন রুটের চলাচলকারী অবৈধ যানবাহন থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায় করেন টিআই আব্দুল হামিদ—এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া ব্যানারবিহীন ট্রাক ও পরিবহন থেকে প্রতি গাড়িতে ২–৩ হাজার টাকা করে তোলেন টিআই আব্দুল হামিদ, টিআই আবুল বাশার, টিআই জাসেল উর রহমানসহ কয়েকজন সার্জেন্ট।
এই অর্থ সংগ্রহে সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেন চান মিয়া নামে এক পরিবহনচালক।
সিংগাইরে ইট–বালুর ট্রাকে মাসে লাখো টাকা
সিংগাইর উপজেলায় প্রায় তিন শতাধিক ইট ও বালুবাহী ট্রাক চলাচল করে। এর মধ্যে নিয়মিত দুই শতাধিক ট্রাক থেকে মাসে প্রতি ট্রাকে এক হাজার টাকা করে আদায় করে ট্রাফিক বিভাগ।
বিভিন্ন রুটের সিএনজি–মাহিন্দ্রা থেকেও মাসোহারা
মানিকগঞ্জ-হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ-সিংগাইর, হেমায়েতপুর-সিংগাইর, মানিকগঞ্জ-সাটুরিয়া, মানিকগঞ্জ-তিল্লি রুটে চলাচলকারী চার শতাধিক সিএনজি ও মাহিন্দ্রা থেকে লাইনম্যান মোশারফ হোসেন, ময়ুর, কাজলের মাধ্যমে মাসে মোটা অংকের টাকা সংগ্রহ করা হয়।
সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন টিআই আব্দুল হামিদ, টিআই বাশার ও টিআই জাসেল উর রহমান—এমন অভিযোগ উঠে এসেছে।
ড্রাম ট্রাক, লেগুনা পরিবহন থেকেও ধারাবাহিক অর্থ আদায়
মানিকগঞ্জ শহর ও আশপাশে দেড় শতাধিক ড্রাম ট্রাক চলাচল করে। প্রতিটি থেকে মাসে এক হাজার টাকা করে তোলা হয়।
মানিকগঞ্জ–বানিয়াজুরি রুটে চলাচলকারী প্রায় ৮০টি লেগুনার বেশিরভাগেরই বৈধ কাগজপত্র ও ফিটনেস না থাকলেও প্রতিটি থেকে সুপারভাইজার মিঠু ও ইউসুফের মাধ্যমে মাসে ৮০ হাজার টাকা সংগ্রহ করা হয়।
দূরপাল্লার পরিবহন থেকেও মাসোহারা আদায়
ঢাকা–আরিচা মহাসড়কে চলাচলকারী সেলফি, নীলাচল, পদ্মালাইন, শুভযাত্রাসহ বিভিন্ন পরিবহন থেকে মাসিক চাঁদা আদায় করা হয়। এসব পরিবহনের লাইনম্যান সুলতান টাকা লেনদেন করেন বলে জানা যায়।
জেলার বাইরের ওয়েলকাম, রাবেয়া, সাতক্ষীরা লাইন, স্টার লাইন, সেবা গ্রীন লাইন, দিগন্ত, ঈগল, রোজিনা ও অন্যান্য পরিবহন থেকেও মোটা অংকের মাসোহারা তোলার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ট্রাফিক কর্মকর্তাদের নামে হ্যালোবাইক ও রিকশা ব্যবসা!
অনুসন্ধানে জানা যায়, টিআই জাসেল উর রহমানের ২৯টি হ্যালোবাইক রয়েছে। এছাড়া তার নামে আরও কিছু অটোরিকশা ভাড়ায় চলে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া কয়েকজন টিএসআই, এটিএসআই, সাংবাদিক মোবারক হোসেন, মানবাধিকার কর্মী পরিচয় দানকারী ফেরদৌস হোসেন বাবুসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের নামেও হ্যালোবাইক ও অটোরিকশা চলাচল করে। ট্রাফিকের অন্যান্য সদস্যরা এসব গাড়ি ডাম্পিং করতে চাইলে টিআই, সার্জেন্ট, এটিএসআই বা সাংবাদিকের নাম বললেই ছেড়ে দেওয়া হয়।এরমধ্যে মোবারক হোসেনের নামে ২০ টির বেশি গাড়ি চলে বলে দাবি করেছেন একাধিক এটিএসআই।
সাংবাদিক মোবারক হোসেন বলেন, আমার নয়টি গাড়ি আছে, এর মধ্য সাতটি নিয়মিত চললেও বাকি দুইটা অনিয়মিত।
ট্রাফিক বিভাগের প্রতিক্রিয়া
তথ্য অধিকার আইনে দাখিল করা আবেদনের প্রেক্ষিতে তথ্য দিতে বাধ্য নন বলে দাবি করেছেন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (প্রশাসন) আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করি। কোনও ধরনের মাসোহারা বা অবৈধ লেনদেন করা হয় না।’ তবে ডাম্পিং বিলের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলমের সরকারি মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হলেও তার পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



