রেজাউল করিম : বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার অনুযায়ী যে পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই আসার কথা ততটা আসছে না। এফডিআই বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এরপরও গত অর্থবছর আগের বছরের চেয়ে বিনিয়োগ এসেছে কম।
গত ২৭ বছরের যে হিসাব পাওয় যায় তাতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে বিনিয়োগে সবচেয়ে এগিয়ে যুক্তরাজ্য। এরপরই যুক্তরাষ্ট্র। আর তালিকায় উদীয়মান পরাশক্তি চীন রয়েছে পাঁচে ও ভারত রয়েছে নয় নম্বরে।
১৯৯৬-৯৭ অর্থবছর থেকে গত ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত যুক্তরাজ্য বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে ৫৩৪৯ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যুক্তরাজ্যের পর রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, এরপর নেদারল্যান্ড। তালিকায় চারে রয়েছে সিংঙ্গাপুর, পাঁচে চীন, ছয়ে দক্ষিণ কোরিয়া, সাতে হংকং, আটে নরওয়ে, নয়ে ভারত আর দশে জাপান।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে মোট বিনিয়োগ করেছে ৪০৮৮ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন ডলার। এরপর নেদারল্যান্ড বিনিয়োগ করেছে ৩২১০ দশমিক ৩৩ মিলিয়ন ডলার। সিংঙ্গাপুর নেদারল্যান্ডের থেকে সামান্য কম অর্থাৎ ৩১৬১ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
চীনের বিনিয়োগ ২৭৫৬ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার, দক্ষিণ কোরিয়া ২৩৮১ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার, হংকং ২১১৪ দশমিক ৪১ মিলিয়ন ডলার, নরওয়ে ১৯৩৮ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন ডলার, ভারত ১২২৫ দশমিক ৮৭ মিলিয়ন ডলার ও জাপান বিনিয়োগ করেছে ১২০৭ দশমিক ৯২ মিলিয়ন ডলার।
এরপর বেশি বিনিয়োগের তালিকায় আছে মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি ও মাল্টা।
বৈদেশিক বিনিয়োগ কয়েক বছর ধরে অস্থিতিশীল। এক বছর বাড়লে পরের বছর কমে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ৩ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ আসে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসেছিল ২ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলারের।
২০১৯-২০ অর্থবছরে আসে ২ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছরে সামান্য বেড়ে দাঁড়ায় ২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন, ২০২১-২২ অর্থবছরে আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন এবং সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে আবার কমে ৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারে নামে।
বিনিয়োগে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিনিয়োগ সম্প্রতি কমেছে। গত বছর বাংলাদেশে বিনিয়োগে পাঁচ নম্বরে আছে দেশটি।
গত বছরের তালিকায় সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ বরাবরের মতো যুক্তরাজ্য এগিয়ে। এরপর দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান দ্বিতীয়। তারপর ধারাবাহিকভাবে নেদারল্যান্ড তিন, হংকং চার, যুক্তরাষ্ট্র পাঁচ, সিংঙ্গাপুর ছয়, চীন সাত, নরওয়ে আট, মাল্টা নয় ও ভারত ১০ নাম্বারে। এই তালিকায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হলো, যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ কমে যাওয়া এবং ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র মাল্টা নয় নাম্বারে উঠে আসা।
২০০৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে এসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে গ্যাস ও জ্বালানি খাতে। এরপর টেলিকমিউনিকেশন, বিদ্যুৎ, টেক্সটাইল, ব্যাংকিং, খাদ্য ও অবকাঠামো ইত্যাদি খাতে।
গ্যাস ও জ্বালানিতে বিনিয়োগ এসেছে ২১৯৮ মিলিয়ন ডলার। টেলিকমিউনিশেন খাতে এসেছে ২১৭৬ মিলিয়ন ডলার। বিদ্যুৎ খাতে এসেছে ১৫৭০ মিলিয়ন ডলার। টেক্সটাইল খাতে এসেছে ১২৩৭ মিলিয়ন ডলার। একইভাবে ব্যাংকিং খাতে ৭৫১, খাদ্য খাতে ৫৭১ ও অবকাঠামো খাতে এসেছে ৩৪২ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ।
বাংলাদেশ থেকে কোনো দেশে কত বিনিয়োগ
বাংলাদেশ যেসব দেশে বেশি বিনিয়োগ করেছে এর মধ্যে সবার ওপরে আছে ভারত। এরপর নেপাল। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ১৯ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ হয়েছে। এরপর নেপালে বিনিয়োগ হয়েছে ৭ দশমিক ৭৬ মিলিয়ন ডলার।
একইভাবে তালিকায় তৃতীয় দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিনিয়োগ করেছে ৬ দশমিক ৬২ মিলিয়ন ডলার, চতুর্থ দেশ সিঙ্গাপুরে ১ দশমিক ৫০ মিলিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রে দশমিক ৮৫ মিলিয়ন ডলার। এসব দেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করা হয় ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টারমেডিয়েটরিজ, মাইনিং, কেমিক্যাল, ফার্মাসিটিক্যালস, মেটাল ও মেশিনারিজ খাতে।
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ কেন কম
বিদেশি বিনিয়োগ কমার পেছনে ডলার সংকট, অর্থ পাচার ও দুর্নীতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সেবা প্রাপ্তিতে ভোগান্তি ও জ্বালানি সংকট ইত্যাদিকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলছেন, ভারত, ভিয়েতনাম, চীন কিংবা বাংলাদেশের সমতুল্য দেশগুলোতে যে পরিমাণ এফডিআই আসে সে তুলনায় বাংলাদেশে এফডিআই ‘খুবই কম’।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘দেশের অর্থিক খাতে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। এই সুপারিশ আইএমএফও করেছে। আর আইএমএফ এর ঋণ পাওয়ার জন্য এ ধরনের শর্তও আছে। সরকার যদি তাদের পরামর্শে কিছু সংস্কার কাজ চালিয়ে যায় তাহলে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বিদেশি বিনিয়োগে।’
আর সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। অন্যান্য সমস্যাও আছে। সামষ্টিক অর্থনীতি যতক্ষণ পর্যন্ত না স্থিতিশীল হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি কমে না আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবে না।’
তবে তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির পর নিষ্কণ্টক জমি নিয়ে যে বাধা ছিল সেটা কেটেছে। কিন্তু ওয়ান স্টপ সার্ভিস, মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবারহ সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এ কারণে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ পাওয়া যাচ্ছে না।’
আর কী বলছে পরিসংখ্যান
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, ২০০৬ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক বিনিয়োগ (ইক্যুইটি ক্যাপিটাল) এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এরপর এসেছে সিঙ্গাপুরের। এভাবে ক্রমান্নয়ে বিনিয়োগ এসেছে চীন, নেদারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, মিশর, হংকং ও মরিশাস থেকে।
২০০৬ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে ২৩৬৩ মিলিয়ন ডলার। এরপর সিঙ্গাপুর করেছে ১৭২৮ মিলিয়ন ডলার। এরপর চীন ৮৮৬, নেদারল্যান্ড ৮১১, সংযুক্ত আরব আমিরাত ৬৭৬, যুক্তরাজ্য ৬৬১, মালয়েশিয়া ৬০৫, মিশর ৫৬৪, হংকং ৪৪৬ ও মরিসাস ৩২২ মিলিয়ন ডলার।
সর্বোমোট বিনিয়োগের চিত্র এমনটা হলেও সম্প্রতি এই চিত্রে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। যেমন গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে যুক্তরাজ্য থেকে। এরপর নেদারল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে। এই তালিকায় তিন নম্বরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সূত্র : সংবাদ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।