সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ : বইমেলা ব্যাপারটা যে কোনো জায়গাতেই আলোকিত মানুষের, সমাজের শিক্ষিত শ্রেণির একটা গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ধরা হয়। যেহেতু বই জিনিসটা মানুষের নানাবিধ ধারণা এবং তথ্যকে বহুকাল ধরে লিপিবদ্ধ করে আসছে (এইখানে ভালো কিংবা মন্দ ব্যাপার না)। ফলত, বইমেলাকে কেন্দ্র করে নানামতের, নানাপথের মানুষের দারুণ একটা সংশ্লেষ হয়।
আর বাংলাদেশে একুশে বইমেলা তো আরো বেশি গুরুত্ববহ। এই মেলার ঐতিহাসিক পটভূমি তো আছেই, যেই দেশে বই পড়ার চর্চা ক্রমশই কমে আসছে, ভিন্নমতের প্রতি সহিংসতা বাড়ছে, সেখানে এহেন মেলা খুবই দরকারি। কিন্তু সম্প্রতি বইমেলা যেন তার চরিত্র হারাচ্ছে। এই বইমেলাতেই দেখা গেল যে, বেশ কয়েকজন আলোচিত চরিত্রকে ‘ভূয়া, ভূয়া’ সম্বোধনে কিছু যুবক তেড়ে আসছে এবং মেলা থেকে বের করে দিচ্ছে।
এদের মধ্যে আছেন এক অসম বয়সী দম্পতি, ইউটিউসহ নানা মাধ্যমে নানারকম আধেয় তৈরি করে আলোচিত হওয়া একজন ব্যাক্তি যিনি নির্বাচনও করেছেন। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, পুলিশ তাদের প্রাথমিক নিরাপত্তাটুকু দিলেও শেষতক তাদের মেলা থেকে বের করে নিয়ে গেছেন। পুলিশের আচরণেও বোঝা গেছে যে, পুলিশ এই ‘ঝামেলা’ পোহাতে চায়নি।
একুশে বইমেলার মতো স্থান এরকম হয়ে উঠছে কেন? কারো লেখালেখি বা কাজকর্ম পছন্দ না হলেই তাকে দলবেঁধে বের করে দিতে হবে কেন? সমাজ কি আগে থেকেই এমন অস্থির ছিল নাকি এ এক নতুন ঘটনা? সত্যি কথা বলতে, আমাদের সমাজে পরমতের প্রতি প্রচণ্ড অসহিষ্ণুতা সবসময়ই ছিল। আমাদের ইতিহাসে অন্তত দুইজন লেখক, লেখালেখির দায়ে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। তাদের নিরাপত্তা দিতে অপারগ রাষ্ট্রও মেলার পুলিশদের মতোই তাদের দেশের বাইরে ‘পার’ করে দিয়েছেন। উনারা তাও বেঁচে আছেন। এই মেলার আশপাশেই একাধিক লেখক হামলাকারীর শিকার হয়ে মারা গেছেন। দেশজুড়ে ভিন্ন মতের নানা লেখক খুন হয়েছে, হুমকি পেয়েছেন অগণিত।
এর একটা বড় কারণ আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ন্য্যয়বিচার পাওয়ার অভাবে, লোকে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়াটাকেই উপায় মনে করে। আর একে কাজে লাগায় সুচতুর রাজনীতিবিদরা। এই উন্মত্ত জনতাকে কাজে লাগিয়ে একদিকে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করে, অন্যদিকে জনতাকে তাদের অধিকারবোধ থেকে ভুলিয়ে রাখে।
যারা এই আচরণ নিয়ে বলে তাদের ওপর খড়গহস্ত হয় রাষ্ট্র। তাদের জনতার চোখে দোষী সাজায় নানারকম চেতনা আর অনুভূতির দোহাই দিয়ে! এইসব চেতনা আর অনুভূতির বড়ি গিলিয়ে উন্মত্ত জনতার উত্তেজনা আরো জিইয়ে রাখে। অন্যদিকে যারা সমাজে শিক্ষাদীক্ষায় উচ্চাসনে, যাদের দায়িত্ব ছিল জনগণকে অসহিষ্ণুতার শিক্ষা দেওয়া, তারা হয় বিবেক বেঁচে দেয় নানা লোভে, অথবা নিজেরাই সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে উল্টো এগুলো উসকে দেয়।
এই পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তির প্রভাবে নব সংস্কৃতি। আমরা পাশের দেশ ভারতে দেখতে পাই একজন বিখ্যাত পর্ণস্টারকে একেবারে মূল মিডিয়ায় তারকা বানিয়ে ফেলা হয়েছে। অথচ খোদ পশ্চিমে এই ধরনের গ্রহণযোগ্যতা হয় না।
পর্ণস্টারেরও মানুষ হিসেবে অধিকার আছে এতে কোনো সন্দেহ নেই এবং উনাকে নিরাপত্তা ও সম্মান দেওয়া রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব। কিন্তু তাকে উদযাপন করা একটা বাজে চর্চা। মূলত এর মাধ্যমে পর্নের মতো জিনিস, যা নারীদের জন্য চরম অবমাননাকর এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর, তাকে ঠারে-ঠোরে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পশ্চিমের সংস্কৃতি লিবারেল, কিন্তু তা সময় নিয়ে গঠিত হয়েছে। সে একই সাথে ব্যক্তির পূর্ণ মর্যাদা ও সামাজিক মূল্যবোধ কিভাবে বজায় রাখতে হয় তা শিখেছে। কিন্তু আমাদের এইখানে কিছু লিবারেল হতে চাওয়ারা হয়তো ভাবেন লিবারেল মূল্যবোধ আরোপ করে দিলেই, জোর করলে, জনতাকে হীন করলেই তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।
ক্ষমতার ও টাকার জোরে বয়স্ক লোকের তরুণী বিয়ে একটা প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। আইন অনুসারে তো বটেই, সামাজিকভাবেও দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক যতক্ষণ অন্যর ক্ষতি না করছে, অধিকার হরণ না করছে, তাদের স্বাধীনতা আছে যে কোনো কিছু করার। কিন্তু এর মানে এই নয় যে তাদের ঘটা করে উদযাপন করতে হবে।
এখনকার দিনে প্রযুক্তি সহজলভ্য হয়েছে। মানুষের শিক্ষাদীক্ষার হারও বাড়ছে। ফলত, সামাজিকমাধ্যমসহ নানা জায়গায় মানুষ সহজেই মতামত প্রকাশ করতে পারছে। আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার কারণে উগ্র মতামতগুলোই বেশি সামনে আসছে। যদিও বলতেই হয়, এখনো হতদরিদ্র মানুষ এর বাইরে। উনাদের জীবনযুদ্ধ এতই কঠিন যে এইসব সাংস্কৃতিক চুলাচুলিতে উনাদের অংশ নেওয়ার সময় বা সুযোগ নেই।
ফলত, বিরুদ্ধমত বা অপছন্দের কাজকে প্রতিরোধ করার উপায়টা খুব একটা সুশীল কায়দায় হচ্ছে না। মেলার মাঠের মতো জায়গাতেও ভূয়া ভূয়া বলে গায়ের জোরে কাউকে কাউকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। শুধুমাত্র লিবারেল মানসের আয়নায় কিংবা নিজের মতামতকে সেরা ভাবার ক্ষুদ্রতা দিয়ে এই ব্যাপারটাকে বোঝা যাবে না। এজন্য দরকার গভীর সামাজিক-রাজনৈতিক পাঠ। বর্তমান পরিস্থিতিতে সামাজিক উপদ্রবের (অ) সামাজিক প্রতিরোধ (?) বাড়তেই থাকবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।