আন্তর্জাতিক ডেস্ক : চীনা খেলনার মতোই চীনা অস্ত্রও মোটেই টেকসই নয়। অত্যন্ত নিম্নমানের কারণে গোটা বিশ্বেই চীনা অস্ত্রের কদর কমছে। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই ক্রেতা দেশগুলি বুঝেছে, দাম কম হলেও চীনা প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বর্তমানে অচল। বরং নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে চীনা অস্ত্র। তাই দিন দিন কমছে চীনের তৈরি অস্ত্র রপ্তানি। বেশিরভাগ দেশই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে চীনের থেকে।
পশ্চিমাদের তুলনায় কমিউনিস্ট দেশটির অস্ত্রের দাম অনেক কম। তাই সহজেই অনেক দেশই আকৃষ্ট হয়েছিল। চীনের অস্ত্রের বাজারও বেড়েছিল বহরে। কিন্তু কেনার পর প্রতিটি দেশেরই অভিজ্ঞতা ভালো নয়। রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় হচ্ছে প্রচুর অর্থ। অস্ত্রের মেরামতেও চীনা সংস্থাগুলির মোটেই ভালো নয়। যন্ত্রাংশও মেলেনা সহজে। সবমিলিয়ে আপাত দৃষ্টিতে দাম কম হলেও খরচ বেশিই পড়ছে চীনা সমরাস্ত্রে। সেইসঙ্গে বাড়ছে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ঝুঁকির পরিমাণ।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে সাহায্য করেছিল চীন। আমেরিকার সঙ্গে তারাও হাত মিলিয়েছিল অগণিত বাঙালি নিধনে পাকিস্তানি সেনাদের মদদ জোগাতে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকতে তারা বাংলাদেশের স্বীকৃতিটুকুও দেয়নি। বিরোধিতা করেছে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ষরযন্ত্রকারী জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের পরই বেইজিং ঢাকার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এহেন চীন এখন বাংলাদেশের বন্ধু সাজতে চাইছে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সবকিছুতেই বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের বিরুদ্ধেও কুৎসা রটাতে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে চাইছে চীন। বন্ধুত্বের মুখোশে আসলে বেইজিংয়ের রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে বানিজ্যিক স্বার্থ। বাংলাদেশের বাজার দখল করতে চায় তারা। সেইসঙ্গে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশেও তারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে চায়।
তাই অতি নিম্নমানের অস্ত্র সরবরাহ করে এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টা করছে তারা। আন্তর্জাতিক বাজারে চীনের অস্ত্র বিক্রি মারাত্মকভাবে কমছে। গত এক দশকে অন্তত ২৫ শতাংশ কমেছে তাদের অস্ত্র রপ্তানি। বেশিরভাগ দেশই চীন থেকে অস্ত্র কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ চীনা অস্ত্রের গুণগত মান অতি নিকৃষ্ট। চীনের তৈরি যুদ্ধাস্ত্র প্রয়োজনের সময় কাজ করে না। অস্ত্রগুলি কার্যক্ষম থাকেও কম সময়। তাছাড়া রক্ষণাবেক্ষণের খরচও অনেক বেশি। তাই গুণগত মান খারাপ হওয়ায় বিভিন্ন দেশ চীনা অস্ত্র পরিত্যাগ করছে। বাংলাদেশেও চীনা অস্ত্র আমদানি নিয়ে সামরিক কর্তাদের অসন্তুষ্টি বাড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ডিরেক্টাস তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, গত এক দশকে চীনের অস্ত্র রপ্তানি কমেছে এক চতুর্থাংশেরও বেশি। অস্ত্রের গুণগত মানকেই তারা এরজন্য দায়ী করেছে। এক সময় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের কাছে রীতিমতো চ্যালেঞ্জের কারণ হয়ে উঠেছিল চীন। বিভিন্ন দেশে অস্ত্র রপ্তানিতে পশ্চিমাদের বাজার দখল করে নিয়েছিল কমিউনিস্ট শাসিত দেশটি। কারণ তাদের তৈরি অস্ত্রের দাম অনেক কম। সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার নামে ছিল চীনা ফাঁদ। কিন্তু কিছুদিন পরেই ধরা পড়ে চীনা অস্ত্রের সার্বিক দুর্বলতা। বহু যুগ আগের প্রযুক্তিতে তৈরি চীনা অস্ত্রগুলি মোটেই বর্তমান সময়ের উপযুক্ত নয়। বেশিরভাগ অস্ত্রের আয়ুও অনেক কম।
আধুনিক প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম অনেকটাই বিজ্ঞানের নিত্য নতুন আবিস্কারের ওপর নির্ভর করে তৈরি। কিন্তু চীনারা সেই মান্ধাতার আমলের প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের দেশের বাতিল অস্ত্রশস্ত্র বিদেশে রপ্তানি করছে। অস্ত্র ব্যবসার নামে অর্থ লুঠ করাই চীনাদের কৌশল।
সুইডেনের স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট বা সিপরির প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে চীনের অস্ত্র ব্যবসায় মন্দার কথা। বিভিন্ন দেশ চীন থেকে অস্ত্র কেনা কমিয়ে ফেলায় গত ৫ বছরে তাদের অস্ত্র বিক্রি কমেছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। বিশ্বের ৫৩টি দেশ চীন থেকে অস্ত্র কেনে। এদের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
চীনা অস্ত্রের আকর্ষণের কারণটিই হচ্ছে দাম কম। বুঝতে পেরেই বিশ্ববাজারে চীনা অস্ত্রের শেয়ার মারাত্মক হারে কমছে। গত এক বছরে গোটা দুনিয়ার অস্ত্রবাজারে চীনাদের শেয়ার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। পয়সা দিয়ে কেউ আর বাজে অস্ত্র কিনতে চাইছে না। বিশেষ করে দেশের নিরাপত্তার সঙ্গে ঝুঁকি নিতে চায় না কোনও দেশ।
সামরিক প্রয়োজনে বাংলাদেশ চীন থেকে বহু অস্ত্র কিনেছে। চীন থেকে কেনা হয়েছে কেডব্লিউ জেট প্লেন, শর্ট রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, মিং শ্রেণির ডুবোজাহাজ প্রভৃতি। এছাড়াও রয়েছে কামান থেকে শুরু করে প্রচুর পরিমাণে গোলা-বারুদও।
গত এক দশকে চীন থেকে আমরা ৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থের অস্ত্র ক্রয় করি। নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করতে গিয়ে চীনা অস্ত্র কিনে আসলে আমরা নিজেদের দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেই দুর্বল করে তুলেছি। কারণ চীন থেকে প্রতিটি অস্ত্রেরই দুর্বলতা প্রকাশ্যে চলে আসছে। সঙ্গে বাড়ছে রক্ষণাবেক্ষণের খরচও। তাই স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর শীর্ষকর্তাদের মধ্যে চীনা অস্ত্র নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে। প্রয়োজনের সময় যন্ত্রাংশ না পেয়ে অনেকেই অসন্তুষ্টও। মেরামতির জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিও দেয়নি চীন। ফলে অকেজো হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের বিশাল অস্ত্র ভান্ডার।
চীনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী সংস্থার নাম নরিনকো। এই নরিনকো বাংলাদেশে প্রচুর ট্যাঙ্ক গোলাবারুদ সরবরাহ করে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে কেনা এইসব অস্ত্র নিয়ে সেনাবাহিনীর ক্ষোভ রয়েছে। এগুলির গুণগত মান খুবই খারাপ। তাই সেনা বাহিনীর তরফ থেকে ঢাকায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কাছে ইতিমধ্যেই আপত্তি জানানো হয়েছে। চীনের তৈরি অন্যান্য অস্ত্র নিয়েও আপত্তি রয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর। তাই বাংলাদেশ সরকারকে অন্য দেশ থেকে অস্ত্র আমদানির পরামর্শ দিতে শুরু করেছেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা। তবে চীনপন্থী নেতা-আমলাদের সাহায্যে অচল সমরাস্ত্র বাংলাদেশে বিক্রি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বেইজিং।
শুধু স্থল বাহিনীই নয়, নৌ বাহিনীর মধ্যেও ক্ষোভ রয়েছে। কারণ চীন থেকে আনা ডুবো জাহাজ দুটিই অত্যন্ত নিম্নমানের। মাঝ সমুদ্রে তারা প্রায়ই বিকল হয়ে পড়ে। বিকল নৌ সামরিক যানের অস্ত্র-শস্ত্রও। এমনকী সামরিক নৌঘাঁটি বানানোর নামে চীন বাংলাদেশের নৌ প্রতিরক্ষাকেও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। একই অবস্থা বায়ু সেনা বাহিনীরও। চীনা যুদ্ধ বিমান বেশিরভাগই বিকল হয়ে পড়েছে। আধুনিক রণাঙ্গনে এদের বিধ্বংসী ক্ষমতাও অনেক কম। প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশেরও আকাল রয়েছে। স্বাভাবিক সময়েই চীনা প্রকৌশলীদের পাওয়া যায় না, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি কী হবে তা সহজেই অনুমেয়।
মিয়ানমারও এখন চীনা অস্ত্রের বদলে ভারত-সহ অন্যান্য দেশ থেকে অস্ত্র কিনতে শুরু করেছে। তাই আমাদেরও সতর্ক হতে হবে। অতিরিক্ত চীনা নির্ভরতা বিপদ ডেকে আনতে পারে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সঙ্গে কোনও আপোষ করার জায়গা নেই। দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার স্বার্থেই চীনা অস্ত্র বর্জন জরুরি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।