আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বিভিন্ন দেশের সরকারকে বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বারবার কড়াভাবে সতর্ক করে যাতে ঋণের ফাঁদে না জড়ায়। কোনো কিছু কেনা, ভাড়া করা কিংবা খাওয়া ছাড়াই প্রতিটি সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর ওপরেও ঋণের এই বোঝা চাপানো হয়। এমন ঋণ আসলে কতটা ভারী এবং প্রত্যেক নাগরিকের ওপর এর বোঝাই বা কতটুকু? ঋণগ্রস্তদের পরিণতি কী? এটি কি আদৌ পরিশোধ করতে হয়? এমনসব প্রশ্ন উঁকি দেয় পাঠকের মনে।
করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় রেকর্ড পরিমাণ ঋণ নেয় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান, চীনসহ অনেকগুলো উন্নত দেশের সরকার। মহামারির পাশাপাশি বেশি সংখ্যক প্রবীণ মানুষের চাপ তাদের অর্থনীতিতে নেতিবাচক চাপ সৃষ্টি করছে।
অনেক দেশের ঋণের পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিকেও ছাড়িয়ে যায়। এসময় একক দেশ হিসেবে ঋণের চাপের সব রেকর্ড ভাঙে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণের পরিমাণ। জো বাইডেন সরকারের রাজস্ব বিভাগের তথ্যানুসারে, ২০২২ সালের শুরুতে দেশটির জাতীয় ঋণ ৩০ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি হয়ে যায়। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। যা দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি ১৭ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রায় দ্বিগুণের বেশি।
যুক্তরাজ্যের জাতীয় ঋণ প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন ডলার, জাপানের সাড়ে ৪ ট্রিলিয়ন, ফ্রান্সের সাড়ে ৭ ট্রিলিয়ন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সাড়ে ১৭ ট্রিলিয়ন ডলার। সারা বিশ্বের সব দেশের এমন ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৩০ ট্রিলিয়ন ডলার।
মাথাপিছু ঋণ কোন দেশের নাগরিকের কত: এই তালিকায় সবার চেয়ে এগিয়ে ইউরোপের কম জনসংখ্যার উন্নত দেশ- লুক্সেমবার্গ, সুইজারল্যান্ড। এরপরই রয়েছে যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, হংকংয়ের অবস্থান। লুক্সেমবার্গের প্রতি নাগরিকের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ রেকর্ড ৫৮ লাখ ডলার। সুইজারল্যান্ডের ২৬ লাখ ডলার। মোট ঋণের তালিকায় এগিয়ে থাকলেও মাথাপিছু ঋণে অনেক পিছিয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের নাগরিকরা। মার্কিন নাগরিকের মাথাপিছু ঋণ ৭৬ হাজার ডলার আর জাপানের ৩৬ হাজার ডলার।
বাংলাদেশিদের অবস্থান কোথায়: বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে যা গত আট বছরে বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। চলতি মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরের শেষে সরকারি ও বেসরকারি খাতে নেয়া বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৯৬ বিলিয়ন (মার্কিন) ডলারে, যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ৪১ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। গত জুনের হিসাবে বাংলাদেশিদের মাথাপিছু বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৭৪ ডলারে যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৬৩ হাজার টাকা। আট বছর আগে এটা ছিল ২৫৭ ডলারের কিছু বেশি। সবশেষ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জাতীয় ঋণ ১১০ বিলিয়ন ডলার এবং মাথাপিছু ঋণ ৫৮০ ডলারের কাছাকাছি। এই হিসাব অনুযায়ী, মার্কিন নাগরিকের তুলনায় ১৩১ গুণ স্বস্তিতে রয়েছেন বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক।
বিদেশি ঋণ নিয়ে সরকার বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে এবং করছে। করোনাকালে টিকাদান ও অন্যান্য কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিদেশি ঋণ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতও বিনিয়োগের জন্য বিদেশি ঋণ নিয়েছে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ এখনো সহনীয় পর্যায়ে আছে। এ হার প্রায় ২২ শতাংশ। তবে রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় ও বিদেশি বিনিয়োগ, অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ না বাড়লে ঋণ পরিশোধ কঠিন হতে পারে। উদ্বেগের দিক হলো, ঋণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিদেশি মুদ্রার সরবরাহ বাড়ছে না।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, সমপর্যায়ের অর্থনীতির দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ জিডিপির অনুপাতে মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে আছে। এ অবস্থায় বিদেশি ঋণের কারণে অর্থনীতি দুর্দশাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। তবে আত্মতুষ্টিতে ভোগা ঠিক হবে না।
অর্থনীতিবিদেরা কঠিন শর্তের ঋণ নিয়েও সতর্ক করেছেন। তারা বলছেন, কঠিন শর্ত ও বাড়তি সুদে ঋণ নেওয়া হলে তা অর্থনীতিতে সংকট তৈরি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে জিডিপির অনুপাতে ঋণ কতটা, তা বড় বিষয় নয়। যেমন জাপানের বিদেশি ঋণ জিডিপির অনুপাতে ১০৪ শতাংশ। কিন্তু দেশটি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তেমন চাপে নেই। বিপরীতে পাকিস্তানের বিদেশি ঋণ জিডিপির ৩৫ শতাংশের কিছু কম; কিন্তু দেশটি ঋণ পরিশোধ নিয়ে সংকটে রয়েছে।
ঋণের চাপে বিপর্যস্ত যুক্তরাষ্ট্র :কোভিড মোকাবিলায় রেকর্ড পরিমাণ ঋণ নিয়েছে বিভিন্ন উন্নত দেশের সরকার। অনেক দেশের ঋণের পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিকেও ছাড়িয়ে গেছে। এতে ঋণের চাপে রেকর্ড ভাঙল আমেরিকার জাতীয় ঋণের পরিমাণ। মঙ্গলবার বাইডেন সরকারের রাজস্ব বিভাগের তথ্যানুসারে, দেশটির জাতীয় ঋণ এখন ৩০ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি।
মার্কিন রাজস্ব বিভাগের তথ্য জানাচ্ছে, সরকারি ঋণের পরিমাণ গত বছরের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে বেড়েছে প্রায় ৭ লাখ কোটি ডলার। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে আমেরিকার ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৩ লাখ কোটি ডলার।
এই আকাশছোঁয়া ঋণের একাধিক কারণ দেখিয়েছে মার্কিন প্রশাসন। প্রথমেই আছে করোনাভাইরাস। দুই বছর ধরে কোভিড মহামারির সঙ্গে লড়াই করছে একাধিক দেশ। করোনার কারণে চিকিৎসা খাতে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়েছে, ব্যয় বেড়েছে প্রশাসনের। এ ছাড়া এই মহামারি পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। সিএনএনের দাবি, ২০১৯ সালের শেষের দিকে জাপান ও চীনের বিনিয়োগকারীদের প্রায় ৭ লাখ কোটি ডলার ঋণ নিয়েও আবার ফিরিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থান: দক্ষিণ এশিয়ার বড় অর্থনীতির দেশ ভারতের মোট ঋণের পরিমাণ ৬৫০ বিলিয়ন ডলার এবং মাথাপিছু ঋণ বাংলাদেশিদের চেয়ে প্রায় ১৩০ ডলার কম। পাকিস্তানের মোট ঋণ বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ২০ বিলিয়ন বেশি। এবং পাকিস্তানিদের মাথাপিছু ঋণ বাংলাদেশিদের চেয়ে প্রায় ৪০ ডলার কম। অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংকটে পড়ে শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু ঋণ রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৫০০ ডলার। যা বাংলাদেশি বা পাকিস্তানিদের তুলনায় প্রায় পাঁচগুণ ছাড়িয়ে গেছে।
মার্কিন রাজস্ব বিভাগের তথ্য জানাচ্ছে, সরকারি ঋণের পরিমাণ গত বছরের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে বেড়েছে প্রায় ৭ লাখ কোটি ডলার। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে আমেরিকার ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৩ লাখ কোটি ডলার।
এদিকে জার্মানির বাসিন্দাদের মাথাপিছু ঋণ কমপক্ষে ৩২ হাজার ইউরো। একজন চীনা নাগরিকের ঋণ মাত্র ২ হাজার ৫০০ ইউরো।
তবে ধনী দেশ ব্রুনেইসহ আর কয়েকটি ছোট দেশ লিখটেনস্টাইন কিংবা পালাউয়ের নাগরিকরা সম্পূর্ণ ঋণমুক্ত জীবন কাটাচ্ছেন।
জাতীয় বা সরকারি ঋণ সাধারণত পরিশোধ করতে হয় না। রাষ্ট্রকে এবং নিশ্চিতভাবেই নাগরিককেও তা ব্যক্তিপর্যায়ে পরিশোধ করতে হয় না। এই ঋণ ব্যাংকে নতুন ঋণ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় যাকে বলে বন্ড। নাগরিকরা যদি সেগুলো কেনেন, তাহলে উল্টো সুদ হিসেবে মুনাফা পেতে পারেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।