জুমবাংলা ডেস্ক : আগামী ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি ও শ্রমবাজারে গভীর সংকট দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের পাশাপাশি চামড়া, প্লাস্টিক, কৃষি, লজিস্টিকস এবং আর্থিক খাতও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি শুধু একটি বাণিজ্য সংকট নয়, বরং একটি জাতীয় জরুরি অবস্থা। যথাসময়ে সরকার হস্তক্ষেপ না করলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান হারিয়ে যেতে পারে, যা পুনরুদ্ধার করতে দীর্ঘ সময় লাগবে এবং ৫০ লাখের বেশি চাকরি ঝুঁকিতে পড়বে।
স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, “এটি শুধুই বাণিজ্যিক ইস্যু নয়, এটি জাতীয় জরুরি পরিস্থিতি। অনেকে ভাবছেন কেবল তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রভাব পড়বে, কিন্তু বাস্তবে বড় ক্রেতারা এক দেশ থেকে বিভিন্ন বাজারের জন্য পণ্য সংগ্রহ করেন, তাই এই প্রভাব অন্যান্য বাজারেও ছড়িয়ে পড়বে।”
একটি ইউরোপীয় পোশাক ব্র্যান্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “যদি এই শুল্ক সমস্যা সমাধান না হয়, তাহলে বাংলাদেশে বিনিয়োগের যৌক্তিকতা আর থাকবে না। আমাদের বিকল্প বাজার বিবেচনা করতে হতে পারে।”
বর্তমানে তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাতে সরাসরি ৪০ লাখ মানুষ এবং সংশ্লিষ্ট খাতে আরও ১০ লাখের বেশি মানুষ কর্মরত। শিল্প নেতাদের আশঙ্কা, যদি অর্ডার কমে যায়, তাহলে মাত্র দুই মাসেই ১০ লাখের বেশি মানুষ চাকরি হারাতে পারে।
স্প্যারো গ্রুপ প্রতি বছর ৩০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, যার অর্ধেকই যুক্তরাষ্ট্রে যায়। প্রতিষ্ঠানটির প্রতি মাসের মজুরি ব্যয় ৪০ কোটি টাকার বেশি। শোভন ইসলাম বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ধসে পড়লে আমরা দুই মাসও টিকে থাকতে পারব না।”
এশিয়ান গ্রুপ, চট্টগ্রামের একটি শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক খন্দকার বেলায়েত হোসেন বলেন, “আমাদের ৯৩ শতাংশ রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রে। সরকার যদি যথাযথ কূটনৈতিক সমঝোতা করতে না পারে, তাহলে আমরা অস্তিত্ব সংকটে পড়ব।” তিনি জানান, তাদের মাসিক মজুরি ব্যয় ৬০ কোটি টাকা এবং মোট পরিচালন ব্যয় প্রায় ৭০ কোটি টাকা। “আমাদের বড় ক্রেতা ওয়ালমার্ট অর্ডার অব্যাহত রেখেছে, তবে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।”
ওয়ালমার্ট, গ্যাপ, লেভিস, আমেরিকান ঈগল, সিঅ্যান্ডএসহ বড় ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ৫০০ কোটি ডলারের পণ্য কেনে। এখন তারা ভবিষ্যৎ অর্ডার নিয়ে পুনরায় ভাবছে। অনেক বায়িং হাউস ইতোমধ্যেই কারখানাগুলোকে উৎপাদন ও চালান স্থগিত করতে বলেছে। জানা গেছে, হা-মীম গ্রুপের মাসিক মজুরি ব্যয় ৯০ কোটি টাকা এবং সেখানে ৭০ হাজারের বেশি কর্মসংস্থান ঝুঁকিতে রয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে ২,৩৭৭টি প্রতিষ্ঠান পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে ৮০১টি প্রতিষ্ঠান তাদের রপ্তানির অর্ধেক বা তার বেশি যুক্তরাষ্ট্রে করে, ফলে তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।
ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ খাত যেমন স্পিনিং, ডাইং, এক্সেসরিজ ও কেমিক্যাল শিল্পও রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। অর্ডার কমলে এসব খাতে উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং ছাঁটাইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। একইভাবে, পরিবহন ও লজিস্টিকস খাত, সিঅ্যান্ডএফ ও গুদাম ব্যবসাও ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে। এক ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, যারা ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি ও ফ্যাক্টরিংয়ে ব্যবসা করে, তারাও বড় চাপে পড়বে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি সরবরাহকারীরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছেন, কারণ তারা বড় কারখানার ওপর নির্ভরশীল। অর্ডার কমে গেলে এই প্রতিষ্ঠানগুলো একেবারে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
কূটনীতিতে পিছিয়ে বাংলাদেশ, এগিয়ে ভারত-ভিয়েতনাম
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ এখনও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কোনো বাণিজ্যিক ছাড় পায় না, যেখানে ভারত, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ কৌশলগত কূটনীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ছাড় আদায় করেছে।
শোভন ইসলাম সতর্ক করে বলেন, “ট্রাম্প প্রশাসনে চীন ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি হারিয়েছিল। বাংলাদেশও তেমন বিপদের মুখোমুখি হতে পারে।”
সমাধানে কূটনৈতিক উদ্যোগ জরুরি
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বলেন, “বিষয়টি জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক ঐকমত্যের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। সঠিক কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক কৌশল না নিলে দেশের রপ্তানি, অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে ভয়াবহ প্রভাব পড়বে।” তিনি সতর্ক করে বলেন, “৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি এবং ১৫ লাখের বেশি চাকরি ঝুঁকিতে রয়েছে।”
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।