জুমবাংলা ডেস্ক : এখন শুধু ভোরের অপেক্ষা। এরপরেই শুরু হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট নেয়ার পালা। প্রায় ১২ কোটি ভোটার নিজেদের রায়ে বেছে নেবেন নিজে নিজ এলাকার জনপ্রতিনিধিদের। রোববার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীন ভোট গ্রহণ চলবে। এ লক্ষ্যে, ভোটগ্রহণের সব প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় প্রশাসন। গোটা দেশজুড়ে নেয়া হয়েছে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
আগামী পাঁচ বছরের জন্য দেশের আইনসভায় কারা হবেন জনপ্রতিনিধি, সেই লক্ষ্যে অনুষ্ঠেয় ভোট সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে সম্ভাব্য সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে নির্বাচন কমিশন। নওগাঁ-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আমিনুল ইসলাম মারা যাওয়ায় ওই আসনের নির্বাচন স্থগিত করেছে ইসি। ফলে ৩শ’ আসনের মধ্যে ২৯৯ আসনে ভোট হবে।
শনিবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল দেশবাসীকে নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার আহবান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে হুশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, কোনো অনিয়ম হলে প্রয়োজনে ভোট বন্ধ করা হবে।
তিনি এমন এক সময়ে এই হুশিয়ারী দিলেন যখন বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলোর ভোট ঠেকানোর ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনে আছে। এরমধ্যেই আবারও যাত্রীবাহী ট্রেনে নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। বেনাপেলো এক্সপ্রেসে ট্রেনে আগুন দেয়ার ঘটনায় প্রাণ ঝরছে নিরীহ চার মানুষের, যাদের মধ্যে আছে নারী শিশুও।
গত ১৫ নভেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে ইসি। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ১৮ ডিসেম্বর চূড়ান্ত প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দেয় সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা। ওই দিন থেকেই আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হয়। প্রচার শেষ হয় ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টায়।
এবারের নির্বাচনে ১৮ দিন প্রচারের সময় পেয়েছেন প্রার্থীরা। এবারের নির্বাচনে ২৮টি দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে ১৯৭০ প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে দলীয় প্রার্থী ১৫৩৪ জন আর স্বতন্ত্র ৪৩৬ জন।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী ২৬৬ জন, জাতীয় পার্টির ২৬৫, তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী ১৩৫ জন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ৬৬ জন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১২২ জন, জাতীয় পার্টির (জেপি) ১৩ জন, বিকল্পধারা বাংলাদেশের ১০ জন প্রার্থী রয়েছেন। নির্বাচনে নারী প্রার্থী হিসেবে রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৯০ জন। আর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অন্যান্য মিলে ৭৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
২৯৯ সংসদীয় আসনে মোট ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৪২ হাজার ২৪টি। এসব কেন্দ্রে ভোটকক্ষ দুই লাখ ৬১ হাজার ৯১২টি। মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন। যার মধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ৬ কোটি ৭৬ লাখ ৯ হাজার ৭৪১ ও নারী ভোটারের সংখ্যা ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৮ হাজার ৬৯৯। এছাড়া সারাদেশে এবার তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার আছেন ৮৪৯ জন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন স্থানীয় ২০ হাজার ৭৭৩ জন পর্যবেক্ষক। এছাড়া প্রায় দুই শতাধিক বিদেশি পর্যবেক্ষক থাকছেন বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন।
বিদেশি তৎপরতা, সহিংসতা, বর্জন
সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে অবরোধ-হরতাল চালিয়ে যাচ্ছে দলটি এবং তাদের সমমনারা। সর্বশেষ ভোটের একদিন আগে থেকে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে তারা।
এই হরতালের আগেই শুক্রবার বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন দেয় হরতাল সমর্থনরা। এতে প্রাণ যায় চারজনের। আহত হয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে ১০ জন। এর আগে, বৃহস্পতিবার রাজশাহী ও ফেনীর পাঁচটি ভোটকেন্দ্রে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। শুক্রবার মধ্যরাত থেকে দেশের দশ জেলায় ১৪টি ভোটকেন্দ্রে আগুন দেয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এক দশক আগে ২০১৪ সালে ভোট প্রতিহত করতে সারা দেশজুড়ে ব্যাপক নাশকতা চালায় বিএনপি-জামায়াত চক্র সকালের মধ্যেই ১৪৭টি আসনে বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতার কারণে প্রায় ১৪০টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করে দেওয়া হয়। ভোট ঠেকাতে এবারও একই কায়দায় সহিংসতা চালাচ্ছে তারা।
ভোটের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা করাতে ঢাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা ছিলো চোখে পড়ার মতো। দলগুলোর মধ্যে দূতিয়ালি করতে দেখা যায় রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে। নভেম্বর মাসে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের এই তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও জানায়।
ব্যালট যাবে সকালে
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এবারই প্রথমবারের মতো ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানো হচ্ছে। শুধু দুর্গম অঞ্চলের দুই হাজার ৯৬৪টি কেন্দ্রে ব্যালট পাঠানো হয়েছে ভোটের আগের দিন।
ব্যালট পেপার বাদে শনিবার সকাল থেকেই ঢাকার আসনগুলোর ভোট কেন্দ্রে পাঠানো হয় প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র, জামানত বই, রশিদ বই, আচরণ বিধিমালা, প্রতীকের পোস্টারসহ বিভিন্ন ধরনের ফরমসহ প্রায় ২০ রকমের সরঞ্জামাদি। রাজধানীর ১৫টি পয়েন্ট থেকে বিতরণ করা হয় ঢাকার ১৫টি আসনে ভোটের সরঞ্জাম। প্রিজাইডিং অফিসারের নেতৃত্বে পুলিশ, আনসার একটি করে টিম পরিবহনসহ কেন্দ্রগুলোতে এসব সরঞ্জাম নিয়ে যান। তারা ভোটকেন্দ্র প্রস্তুত করে সেখানেই রাতে অবস্থান করবেন।
সারাদেশে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য স্থাপনায় মোট ৪২ হাজার ২৪টি ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে ভোটকক্ষ ২ লাখ ৬১ হাজার ৯১২টি।
ভোটের নিরাপত্তা রক্ষায় মাঠ পর্যায়ে পুলিশ, র্যাব, আনসার-ভিডিপি, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ৮ লাখ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। ঢাকায় শুক্রবার মধ্যরাত থেকে মোটরসাইকেল এবং শনিবার মধ্যরাত থেকে আরো কিছু যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পুলিশ।
এছাড়া ভোট গ্রহণের কাজে ৮ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত থাকবেন। এছাড়াও স্ট্যান্ডবাই থাকবেন এক লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী। তিন হাজার ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারক মাঠে থাকছেন। তারা যে কোনো অপরাধে তাৎক্ষণিক শাস্তি দিতে পারবেন।
এবার ভোটে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে ৬৬ জন দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে দুইজন বিভাগীয় কমিশনার এবং ৬৪ জন জেলা প্রশাসক।
লক্ষ্য ভোটারের উপস্থিতি
এবারের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে চায় নির্বাচন কমিশন ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেই লক্ষ্যেই এবার দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়াতে বাধা দেয়নি ক্ষমতাসীন দল। ভোটের আগে জাতির উদ্দেশে দেওয়া সিইসির ভাষণেও ছিলো কেন্দ্রে যাওয়ার আহবান। ভোটের প্রচারে বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার দেশবাসীর প্রতি আহবান ছিলো ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার।
গত ১০ দিন ধরে ভোট বর্জনের জন্য সারাদেশে প্রচার চালিয়েছে বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলো।
২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। সে নির্বাচনে ৪০ শতাংশ ভোট পড়ে বলে জানিয়েছিলো ইসি। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ নিবন্ধিত সব দল অংশ নেয়। সেবার ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছিলো বলে জানায় ইসি।
ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সারাদেশে মোট ভোটকেন্দ্র ৪২ হাজার ২৪টি। এর মধ্যে ২৩ হাজার ১৩৩টি কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করে এসব কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাড়তি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নির্বাচনী এলাকায় সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, র্যাব, পুলিশ, আর্মড পুলিশ ও আনসার ব্যাটালিয়নের সদস্যরা মোবাইল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করতে শুরু করেছে গত ২৯ ডিসেম্বর থেকেই।
এছাড়া নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনসহ সহিংসতা রোধে প্রতিটি এলাকায় পর্যাপ্ত সংখ্যক জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোতায়েন করেছে কমিশন। কমিশনের তথ্য অনুযায়ী মোবাইল কোর্ট আইনের আওতায় প্রতিটি উপজেলা ও জেলা সদরের পৌরসভায় একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করছেন। এর বাইরে ঢাকায় ২৬ জন, চট্টগ্রামে ১০, খুলনায় ৬, গাজীপুরে ৪ ও অন্য সিটিতে তিনজন করে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছে।
পাশাপাশি ৫-৯ জানুয়ারি ৩০০ আসনে ৬৫৩ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করছেন, যারা নির্বাচন উপলক্ষে সংঘটিত অপরাধসমূহ আমলে নেয়া ও তা সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে বিচার সম্পন্ন করবেন। ভোটগ্রহণের দিন ছাড়াও এর আগের ও পরের দুই দিন করে এসব ম্যাজিস্ট্রেটরা কাজ করবেন, যার মূল উদ্দেশ্যে হলো ভোটকে কেন্দ্র করে কোন ধরনের সহিংসতা যেন না হতে পারে।
আর ভোটের দিনে মেট্রোপলিটন এলাকায় প্রতিটি ভোটকেন্দ্র অস্ত্রসহ তিনজন পুলিশ ও ১২ জন আনসার কাজ করবেন। আর এর বাইরের এলাকায় প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে অস্ত্রসহ দু’জন পুলিশ ও ১২ জন আনসার সদস্য কাজ করবেন। তবে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোকে একজন করে সশস্ত্র পুলিশ বেশী থাকবে।
মোবাইল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্স
ইসির তথ্য অনুযায়ী, ভোটকে কেন্দ্র করে সারাদেশে ৩৮ হাজার ১৫৪ জন সেনা সদস্য এবং ২ হাজার ৮২৭ নৌ বাহিনী সদস্য নিয়োজিত থাকছে যারা একজন ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে তাদের দায়িত্ব পালন করবে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য গত ৩ জানুয়ারিই নির্বাচনি এলাকাগুলোতে পৌঁছে গেছে।
এছাড়াও বিজিবি বা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের ৪৪ হাজার ১৯২ জন, কোস্টগার্ডের ২ হাজার ৩৫৫ জন, র্যাবের ৬০০ টিম, পুলিশের ১ লাখ ৭৪ হাজার ৭৬৭জন ও আনসার ব্যাটালিয়নের মোট ৫ লাখ ১৪ হাজার ২৮৮ জন ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকাগুলোতে দায়িত্ব পালন করবে।
এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বা ডিএমপি নির্বাচন ঘিরে কিছু যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, যা শনিবার থেকে কার্যকর হয়েছে। শুক্রবার রাত থেকে সোমবার রাত পর্যন্ত মোটর সাইকেল চলাচল বন্ধ থাকবে। পাশাপাশি শনিবার মধ্যরাত থেকে রোববার মধ্যরাত পর্যন্ত ট্যাক্সি ক্যাব, পিকআপ, মাইক্রোবাস ও ট্রাক চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকবে।
তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, প্রশাসন ও অনুমতিপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক ছাড়াও জরুরি সেবা কাজে নিয়োজিত যানবাহন যেমন ওষুধ, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা এবং এ ধরনের কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি ও সংবাদপত্র বহনকারী সব ধরনের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা শিথিল থাকবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।