ভূমিকম্পের তীব্র ঝাঁকুনিতে কাঁপল ঢাকা শহর। এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে নরসিংদীর মাধবদী উপজেলায়। ভূমিকম্পের প্রভাব পড়েছে ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোতেও।

এ ভূমিকম্পের কম্পনের তীব্রতা কত মানুষ অনুভব করেছেন, সেটার একটা অনুমিত হিসাব দিয়েছে মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস। ভূমিকম্পের আড়াই ঘণ্টা পর সংস্থাটি বলেছে, এ ভূমিকম্পে ৭ কোটির বেশি মানুষ মৃদু ভূকম্পন অনুভব করেছেন। এ ছাড়া হালকা ঝাঁকুনি পেয়েছেন আরও প্রায় পৌনে ৭ কোটি মানুষ।
এ ভূমিকম্পকে ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী কমলা শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে ইউএসজিএস। এর মানে হলো এমন ভূমিকম্পে উল্লেখযোগ্য প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে। অর্থনৈতিক ক্ষতির ঝুঁকি অনুযায়ী, এটি হলুদ শ্রেণিভুক্ত। বাংলাদেশের জিডিপির ১ শতাংশের কম অর্থনৈতিক ক্ষতির ঝুঁকি থাকে।
সংস্থাটির অনুমিত হিসাব অনুযায়ী, ভূমিকম্পের শক্তিশালী কম্পন অনুভব করেছেন ঢাকার ১ কোটির বেশি মানুষ। উৎপত্তিস্থল নরসিংদী জেলায় উচ্চ শক্তিশালী কম্পন অনুভব করেছেন প্রায় ৩ লাখ মানুষ।
মার্কিন এই সংস্থা বাংলাদেশে এর আগের তিনটি ভূমিকম্পের উপাত্তও তুলে ধরেছে তাদের ওয়েবসাইটে। সেখানে বলা হয়েছে, ১৯৮৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর ৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়। এতে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ১৯৯৯ সালের ২২ জুলাইয়ের ৫ দশমিক ২ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে মৃত্যু হয়েছিল ৬ জনের।
ভূমিকম্পের প্রভাবে রাজধানীতে বিভিন্ন স্থানে দেয়াল ধসে পড়েছে। কোনো ভবনের রেলিং ও অংশবিশেষ ভেঙে পড়তে দেখা গেছে। অনেকেই ভয় পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে অন্তত ১০ জন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে নরসিংদীতে ৫ জন, ঢাকায় ৪ জন ও নারায়ণগঞ্জে ১ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ছয় শতাধিক মানুষ।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে নরসিংদীর মাধবদী উপজেলায় এ ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়। রিখটার স্কেলে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭। তবে মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস বলছে, এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫। ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে এটার উৎপত্তি।
৫ দশমিক ৭ মাত্রার মাঝারি এ ভূমিকম্পকে স্মরণকালের মধ্যে কম্পনের তীব্রতার দিক থেকে নজিরবিহীন বলছেন ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞরা।
ইউএসজিএস বলছে, বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ভূমিকম্পপ্রবণ হলেও কেন্দ্রীয় অঞ্চল তুলনামূলকভাবে শান্ত থাকে। ১৯৫০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকার ২৫০ কিলোমিটারের মধ্যে ৫ দশমিক ৫ বা তার বেশি মাত্রার ১৪টি ভূমিকম্প হয়েছে—এর মধ্যে দুটি ছিল ৬ মাত্রার। আর গতকাল নরসিংদীর মাধবদীর ভূমিকম্পটি ছিল ঢাকা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে।
এ ভূমিকম্পের কম্পনের তীব্রতা কত মানুষ অনুভব করেছেন, সেটার একটা অনুমিত হিসাব দিয়েছে মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস। ভূমিকম্পের আড়াই ঘণ্টা পর সংস্থাটি বলেছে, এ ভূমিকম্পে ৭ কোটির বেশি মানুষ মৃদু ভূকম্পন অনুভব করেছেন। এ ছাড়া হালকা ঝাঁকুনি পেয়েছেন আরও প্রায় পৌনে ৭ কোটি মানুষ।
ভূমিকম্পটির তীব্রতা এত বেশি কেন জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, এ ভূমিকম্প ঢাকার খুব কাছে হয়েছে। এর আগে এখানে ৪ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হয়নি।
মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, এর আগে ২০২৩ সালে রামগঞ্জে ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছিল। সেটি ঢাকা থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে। এবারের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল থেকে ঢাকার দূরত্ব সেই তুলনায় অনেক কম।
এ ভূমিকম্পে অনেক ভবনে ফাটল ধরেছে, দেবে গেছে বেশ কিছু ভবন ও মাটি। গত তিন দশকে কোনো ভূমিকম্পে এ ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এ ভূমিকম্পে মারাত্মক না হলেও উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, ‘বড় ভূমিকম্পগুলো ১৫০ বছর পরপর ফিরে আসার আশঙ্কা থাকে। এদিক থেকে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পগুলো ফেরত আসার সময় হয়ে গেছে। তাই আজকের (শুক্রবার) এই ভূমিকম্পের পর সবাইকে সচেতন ও সাবধান হতে হবে।’
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর জানাচ্ছে, ২০১৫ থেকে ২০২৫ সাল—এই এক দশকে বাংলাদেশে ২০টি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল ২০২৩ সালের ২ ডিসেম্বর। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫। বাকি ভূমিকম্পগুলোর গড় মাত্রা ছিল ৪। সবচেয়ে বেশি ছয়টি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায়।
ঢাকায় তীব্র ঝাঁকুনি
গতকাল শুক্রবার ছুটির দিন থাকায় ঢাকায় সকাল থেকে অনেকে বাসায় ছিলেন। ১০টা ৩৮ মিনিটে নরসিংদীতে ভূমিকম্প আঘাত হানলে তার প্রভাব পড়ে ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোতে।
ভূমিকম্পের তীব্রতায় রাজধানীতে বাসাবাড়ি, হাসপাতাল ও বহুতল মার্কেটে থাকা অনেক মানুষ প্রাণভয়ে নিচে নেমে আসেন। তাঁরা বাসার সামনে থাকা গলি ও সড়কে অবস্থান নেন। কেউ অসুস্থ লোকজন নিয়ে, কেউ বাচ্চা কোলে দৌড়ে নিচে নেমে আসেন। ঢাকা শহরে খোলা জায়গার সংকট আছে। তাই বাসার নিচে আশ্রয় নিলেও অনেকের মধ্যে শঙ্কা ছিল, কোনো ভবন ধসে পড়ে কি না।
নিকেতনের বাসিন্দা আশরাফুল আলম বলেন, ‘সেলুনে বসে চুল কাটাচ্ছিলাম। হঠাৎ চেয়ার এত কাঁপছিল যে মনে হচ্ছিল পড়েই যাব। কোনোমতে সেলুন থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াই।’ তিনি বলেন, এই শহর একদমই নিরাপদ নয়। ভূমিকম্প হলে জীবন বাঁচানোর তাগিদে বাইরে এলেও সেখানেও নিরাপত্তা নেই। বসবাসের অনুপযোগী একটা শহর যে এখনো টিকে আছে, সেটাই একটা বিস্ময়।
ঢাকার নিম্নাঞ্চলে ঝুঁকি বেশি
২০২৪ সালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) উদ্যোগে ও বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ‘আরবান রেজিলিয়েন্স’ নামের একটি প্রকল্পের তথ্য হলো, ঢাকায় ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে ৮ লাখ ৬৪ হাজার ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। দিনে এমন মাত্রার ভূমিকম্প হলে ২ লাখ ২০ হাজার মানুষ আর রাতে হলে ৩ লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা যেতে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে ওই গবেষণায়।
ঢাকার নিম্নাঞ্চলগুলোতে ঝুঁকির মাত্রা আরও বেশি বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল-পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ। তিনি বলেন, পুরান ঢাকা থেকে টঙ্গী, সেখান থেকে সোজা মধুপুরের লাল মাটি পর্যন্ত উঁচু ভূমি ধরা হয়। অন্যদিকে পূর্ব-পশ্চিম যেমন প্রগতি সরণি থেকে বালু নদ পর্যন্ত ধরা হয় নিম্নভূমি। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে এসব নিম্নভূমিতে বালু ফেলে আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা করা হয়েছে। এ ছাড়া হাজারীবাগ, শ্যামলী, ঢাকা উদ্যান, বছিলা, পূর্বাচল ও উত্তরাও ঢাকার নিম্নাঞ্চলে অন্তর্ভুক্ত। তিনি বলেন, বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে এসব এলাকার ভবনগুলো ঢাকার উঁচু এলাকার ভবনের চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



