শামসুল ইসলাম : স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় পাসপোর্ট এখন সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। তিন মাস থেকে চার মাসেও অনেকের ভাগ্যে পাসপোর্ট জুটছে না। পাসপোর্ট বিড়ম্বনার দরুণ দেশটিতে অবৈধ প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের বৈধতা লাভের সুযোগ হাত ছাড়া হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনে প্রায় ৬০ হাজার প্রবাসী কর্মী নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে অনেকেই যথাসময়ে পাসপোর্ট পাচ্ছে না। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন প্রবাসী কর্মীরা।
বাংলাদেশ হাইকমিশনে পাসপোর্ট শাখায় ১৬জন কর্মকর্তা-কর্মচারি পাসপোর্ট সরবরাহে কাজ করেও দ্রুত সঙ্কট নিরসন করতে পারছে না। প্রতিদিন হাইকমিশনে দফায় দফায় ফোন করেও কোনো সাড়া পাচ্ছে না ভুক্তভোগিরা। এ জন্য মালয়েশিয়ায় নতুন পাসপোর্টের জন্য হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের মাঝে চলছে হাহাকার। মালয়েশিয়া থেকে একাধিক ভুক্তভোগি এ তথ্য জানিয়েছে। দেশটির সরকার ঘোষিত অবৈধ অভিবাসী কর্মীদের বৈধতা লাভের সুযোগ কাজে লাগাতে হাইকমিশনে পৃথক জরুরি বুথ খুলে সরাসরি হাতে হাতে পাসপোর্ট সরবরাতের জোর দাবি জানিয়েছে জাতীয় শ্রমিক লীগ মালয়েশিয়া শাখার সভাপতি নাজমুল ইসলাম বাবুল।
সময়ের সাথে সাথে মানুষ পরিবর্তন হয়,সিস্টেম আপডেট হয় কিন্তু মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের পাসপোর্ট সেবা দিন দিন অবনতি হচ্ছে। দেশটির বিভিন্ন প্রদেশে কর্মরত প্রবাসীদের ভাগ্যে সাড়ে ৩ মাসেও মিলছেনা পাসপোর্ট। মালয়েশিয়ায় বসবাসকারী বাংলাদেশিদের পাসপোর্ট প্রাপ্তিতে জটিলতা যেন শেষ হওয়ার নয়। পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতায় বাড়ছে ভোগান্তি। দূতাবাসের ওয়েবসাইটে দেওয়া টাইম টেবিল আর বাস্তবতা এ যেন এক আকাশ পাতাল ব্যবধান। মালয়েশিয়া দূতাবাসের ডিজিটাল সেবার গ্যাড়াকলের ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ পাসপোর্টপ্রত্যাশী প্রবাসীরা। বিশেষ করে, জহুরবারু, পেনাংয়ে কুয়ালালামপুরে বসবাসকারীদের ভোগান্তি চরম পৌঁছেছে। বৈশ্বিক করোনা কালে দেশটির বিভিন্ন প্রদেশের পোস্ট অফিসের মাধ্যমে হাইকমিশন থেকে পাসপোর্ট সরবরাহের প্রথা চালু করা হলেও এ প্রক্রিয়ায় পাসপোর্ট হাতে পেতে অহেতুক ২ থেকে ৩ মাস বিলম্ব হয়।
অসমর্থিত সূত্র জানায়, গত এক সপ্তাহ যাবৎ শুধু মালয়েশিয়া থেকে আবেদনকৃত পাসপোর্ট ঢাকায় বন্ধ রয়েছে। কেন বা কি কারণে বন্ধ তা কেউ বলতে পারছেনা। পাসপোর্ট অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার মৌখিক নির্দেশে মালয়েশিয়া পাসপোর্ট প্রিন্ট বন্ধ রাখা হয়েছে। পাসপোর্ট প্রিন্ট কেন বন্ধ রাখা হয়েছে এই বিষয়ে জানতে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পরিচালক মো. সাইদুর রহমানের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। অতিরিক্ত মহাপরিচালক সেলিনা বানুর মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। মালয়েশিয়ায় কর্মরত প্রবাসী কর্মী রুপচান বিগত চার মাস যাবত পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেও পাসপোর্ট পায়নি। দেশটিতে কর্মরত প্রবাসী মো. রাসেল হোসাইন, জুয়েল আহমেদ রাব্বি, কামরুল হোসেন, মোক্তার হোসেন ও জালাল উদ্দিন নতুন পাসপোর্টের আবেদন করেও বিগত ৩ মাস যাবত কোনো সাড়া পাচ্ছে না। বিগত ১৬ জানুয়ারি প্রবাসী কর্মী মো.শামীম রেজা পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে এখনোও পাসপোর্ট পায়নি।
পাসপোর্ট সরবরাহে ধীরগতি সর্ম্পকে জানতে চাইলে গতকাল শনিবার কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের পাসপোর্ট উইংয়ের প্রধান কায়মুদ্দিন বলেন, হাইকমিশনে ৬০ হাজার নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৩৫ হাজার পাসপোর্ট হাইকমিশনে চলে এসেছে। ঢাকা থেকে পাসপোর্ট সরবরাহ ধীরগতি এবং পাসপোর্ট প্রিন্ট বন্ধ রয়েছে কী না এমন প্রশ্নের জবাবে পাসপোর্ট উইংয়ের কায়মুদ্দিন বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। পাসপোর্ট দ্রুত সরবরাহে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বলেও তিনি দাবি করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অর্ধেক প্রবাসীই একাধিক পাসপোর্টের জন্য আবেদন করছে এতে নানা জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। জাতীয় শ্রমিক লীগ মালয়েশিয়া শাখার সভাপতি নাজমুল ইসলাম বাবুল গতকাল শনিবার কুয়ালালামপুর থেকে বলেন, মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে পাসপোর্ট ডেলিভারি প্রক্রিয়ায় প্রবাসী কর্মীরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। তিন চার মাসেও অনেকেই পাসপোর্ট হাতে পাচ্ছে না। তিনি বলেন, করোনা মহামারির সময়ে হাইকমিশন পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পাসপোর্ট ডেলিভারি দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলেও তাতে পাসপোর্ট পেতে অনেক বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে। তিনি দেশটির সরকারের ঘোষিত অবৈধ কর্মীদের বৈধতা লাভের সুযোগ কাজে লাগাতে পোস্ট অফিসের পাশাপাশি হাইকমিশনে জরুরি পৃথক বুথ খুলে হাতে হাতে পাসপোর্ট সরবরাহের জোর দাবি জানান।
বিগত ২৭ জানুয়ারি থেকে চালু হওয়া মালয়েশিয়া সরকারের রিক্যালিবাসি তিনাগা কিরজা ( জঞক ২.০ ) তে বৈধ করণ প্রক্রিয়ায় বৈধ হওয়ার আশায় পাসপোর্ট রিনিউর জন্য আবেদন করলেও, পাসপোর্ট পেতে বিলম্ব হওয়ায় আশায় গুড়ে বালি মনে করছে পাসপোর্ট প্রত্যাশীরা। রিক্যালিব্রেশন প্রোগ্রামে গত ২ মার্চ পযন্ত বৈধ হওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছে ২ লক্ষ বিদেশি কর্মী। এবং প্রায় ২০ হাজার নিয়োগকর্তা ওয়াকসফোর্স রিক্যালিব্রেশন প্রোগ্রামে ( জঞক ) এর অধীনে নিবন্ধন করেছেন। কর্মসূচীর মাধ্যমে গৃহীত আবেদনের মধ্যে নির্মাণ খাত থেকে ৫৫ শতাংশ, সেবা ২৮ শতাংশ, উৎপাদন ৬ শতাংশ, কৃষি ৬ শতাংশ, এবং বৃক্ষরোপণ ৫ শতাংশ আবেদন জমা পরেছে। ধারণা করা হচ্ছে এই কর্মসূচির আওতায় প্রায় ৬ লক্ষ বিদেশি কর্মী বৈধতা পাবে। কর্মসূচিটি আগামী ৩১ ডিসেম্বর পযন্ত চলবে।
এতোদিন কোভিড -১৯ এর দোহায় দিয়ে পাসপোর্ট সেবা বিলম্ব হলেও এখন কেন পাসপোর্ট পেতে বিলম্ব হচ্ছে এর কোন সঠিক জবাব দিতে পারছে না কেউ। করোনাকালে লকডাউন থাকায় প্রবাসীদের নির্বিঘেœ সেবা দিতে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পাসপোর্টের আবেদন গ্রহণ এবং ডেলিভারির নিয়ম চালু করে হাইকমিশন। শুরুতে এমন উদ্যোগ প্রসংশা কুড়ালেও ছিল নানা অভিযোগ।
অভিযোগ আছে, পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পাসপোর্টের আবেদন পাঠিয়ে এনরোলমেন্ট নাম্বার পেতে অপেক্ষা করতে হয় এক থেকে দেড় মাস। এরপর পাসপোর্ট ডেলিভারি পেতে অনলাইনে আবেদন করে অপেক্ষা আরও প্রায় এক মাস। পোস্ট অফিস থেকে ডেলিভারি নিতে এপয়েন্টমেন্টর তিন কর্মদিবসে বারকোড পাওয়ার কথা বললেও অপেক্ষা করতে হয় ১৫ থেকে ২০ দিন।
বর্তমানে করোনার প্রভাব না থাকায় সবকিছু স্বাভাবিক হলেও হাইকমিশনের পাসপোর্ট সেবার নিয়ম আছে আগের মতোই। প্রবাসীদের পাসপোর্ট প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে মালয়েশিয়া সরকার ঘোষিত অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতা নেয়ার সুযোগ গতবারের মতো এবারও হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা আছে অনেকের। কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনে দফায় দফায় ফোন ও ই-মেইল করেও কোনো সাড়া পাচ্ছে না। কুয়ালালামপুর থেকে একাধিক ভুক্তভোগি এসব তথ্য জানিয়েছে।
পাসপোর্ট যথা সময়ে না পেলে এসব প্রবাসী কর্মীরা অবৈধ হয়ে যাবে। ফলে চাকরি হারিয়ে তাদের খালি হাতে দেশে ফিরতে হবে। কুয়ালালামপুর থেকে ভেস্ট মাকের্টিং এসডিএন বিএইচডি’র পরিচালক মো.রুহুল আমিন জানান, শত শত প্রবাসী কর্মীরা নতুন পাসপোর্ট না পাওয়ায় চরম হতাশায় ভুগছে। হাইকমিশন থেকে প্রবাসী কর্মীদের দ্রুত পাসপোর্ট সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া না হলে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দেশটির সরকারের ঘোষিত বৈধতা লাভের সুযোগ থেকে অনেকেই বঞ্চিত হবে। এতে রেমিট্যান্স প্রবাহে বিরুপ প্রভাব পড়তে পারে। তিনি হাইকমিশন থেকে জরুরিভিত্তিতে পাসপোর্ট সরবরাহের কার্যকরী উদ্যোগ নেয়ার জোর দাবি জানান।
বিএমইটি’র সূত্র মতে, ১৯৭৮ সনে দেশটিতে ২৩ কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে জনশক্তি রফতানি শুরু হয়। দশ সিন্ডিকেট চক্রের অপতৎপরতায় মালয়েশিয়া সরকার ২০১৮ সনের শেষ দিকে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দেয়। শুরু থেকে এযাবত দেশটিতে ১০ লাখ ৫৭ হাজার ১৪৪ জন কর্মী চাকরি লাভ করেন।২০২২ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে মালয়েশিয়া থেকে প্রবাসী কর্মীরা ২২৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছে। বর্তমানেও দেশটিতে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীরা প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে। ২৫ সি-িকেটের পর দেশটিতে ১শ’ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে অনুমোদিত কর্মীরা চাকরি নিয়ে যাচ্ছে। সি-িকেট চক্রের মাধ্যমে মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের কাছ থেকে চার লাখ টাকা থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব কর্মী দেশটিতে গিয়ে চড়া অভিবাসনের ব্যয়ের অর্থ তুলতে পারবে কী না তা’নিয়েও শংসয় দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে প্রবাসী মন্ত্রণালয় নির্বিকার। এদিকে, দেশটির সরকার বিদেশি অভিবাসী কর্মী নিয়োগের নতুন অনুমোদন প্রদান স্থগিত ঘোষণা করেছে। তবে অনুমোদন প্রাপ্ত কর্মীরা দেশেটিতে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। সূত্র : ইনকিলাব
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।