লাইফস্টাইল ডেস্ক : তথ্য-প্রযুক্তি বা ইনফরমেশন টেকনোলজিতে (আইটি) চাকরির সুযোগ বর্তমানে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এ সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে একাডেমিক যোগ্যতার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কাজে অবশ্যই দক্ষ হতে হবে। আইটি পেশায় আসতে চাইলে কিভাবে তৈরি হবেন, নিয়োগের বেলায় কী কী দেখা হয়—সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানাচ্ছেন রায়হান রহমান
এখন শুধু আইটিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানেই নয়, নন-আইটিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানেও আইটি এক্সপার্টদের চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে। কারণ প্রায় প্রতিটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও ব্যবস্থাপনা এখন আইটিনির্ভর।তাই বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই থাকছে ‘আইটি বিভাগ’।
আইটি সেক্টরে কাজের ক্ষেত্র বহুমুখী, যেমন—হার্ডওয়্যার, নেটওয়ার্কিং, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, সিস্টেম অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ডাটা বেইস ম্যানেজমেন্ট, ওয়েব ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্ট, অ্যানিমেশন, মাল্টিমিডিয়া ইত্যাদি।
কাজের সুযোগ কেমন
তথ্য-প্রযুক্তিতে ডিপ্লোমা কিংবা স্নাতক শেষ করার পর শুরুতে হেল্প ডেস্ক টেকনিশিয়ান হিসেবে চাকরির সুযোগ থাকে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হিসেবেও প্রাথমিকভাবে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিবছর বড়সংখ্যক নিয়োগ হয় ‘সিস্টেম অ্যানালিস্ট’ পদে। আইটি সিকিউরিটি বা সাইবার সিকিউরিটি হিসেবেও কাজের সুযোগ আছে করপোরেট অফিসগুলোতে। এ ছাড়া নেটওয়ার্ক অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, ডাটা বেইস অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, আইটি কনসালট্যান্ট, প্রজেক্ট ম্যানেজার, ক্লাউড আর্কিটেক্ট, কোয়ালিটি অ্যাস্যুরেন্সসহ বিভিন্ন পদে চাকরির সুযোগ রয়েছে।
এ বিষয় দেশের প্রথমসারির আইটি প্রতিষ্ঠান টগি সার্ভিসেসের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) আবু তৈয়ব বলেন, আইটি সেক্টরে কাজ মানেই শুধু আইটিনির্ভর প্রতিষ্ঠানে কাজ করা বুঝায় না, বর্তমানে ব্যাংক, করপোরেট হাউস, গণমাধ্যমসহ প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেই আইটি সেক্টরে কাজের সুযোগ রয়েছে। একটা সময় হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংকে অনেক বড় কিছু মনে করা হতো। এখন হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং ‘টেকনিশিয়ান’ লেভেলের চাকরিতে রূপান্তরিত হয়েছে। আর হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জায়গাটি দখল করে নিয়েছে ‘নেটওয়ার্কিং’। নেটওয়ার্কিংয়ের মধ্যেও ভাগ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ফিজিক্যাল নেটওয়ার্কিং। এটি মূলত কেবল বা ওয়াই-ফাই দিয়ে তৈরি করা হয়। প্রতিটি অফিসেই নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ারের কদর রয়েছে। এ ছাড়া বর্তমান সময়ে ‘নেটওয়ার্কিং অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’, ‘নেটওয়ার্কিং সিকিউরিটি’ বেশ চাহিদাসম্পন্ন চাকরি।
ড্রিম টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের (ডিটিআই) পরিচালক আলতাফ হোসেন জানান, বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি মোবাইল সেট কম্পানি মোবাইল উত্পাদন শুরু করতে যাচ্ছে। এসব কম্পানিতে আইটি এক্সপার্টদের জন্য নতুন নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হবে।
বিজিনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান টাসকিয়েটরের সিনিয়র ডাটা অ্যানালিস্ট সাজোয়ার হোসেন বলেন, দিনকে দিন আইটি খাতের পরিসর বড় হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে—চাহিদা থাকাসত্ত্বেও অনেকেই কাজের সুযোগ পাচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে, কাজের দক্ষতা না থাকা। তাই এ পেশায় আসার আগে নিজেকে দক্ষ ও উপযুক্ত হিসেবে তৈরি করে নিতে হবে।
কোন পদে কী কাজ
কাস্টমারদের সহযোগিতা করার প্রাথমিক দায়িত্ব থাকে হেল্প ডেস্ক টেকনিশিয়ানদের। এ পদে কর্মরতদের সাধারণত হার্ডওয়্যার, প্রিন্টার ও ইন্টারনেটের ছোটখাটো সমস্যা সমাধান করতে হয়। সিস্টেম অ্যানালিস্ট পদের কাজ হচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গবেষণা, উন্নয়ন ও কম্পানির ইনফরমেশন সিস্টেমের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা। এ ছাড়া বিভিন্ন সফটওয়্যার আপডেট ও প্রয়োজনীয় ম্যানুয়াল লেখা একজন সিস্টেম অ্যানালিস্টের অন্যতম কাজ। আইটি সিকিউরিটি বা সাইবার সিকিউরিটির কাজ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের সার্ভার ও ওয়েবসাইটকে সাইবার হামলা কিংবা বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা থেকে রক্ষা করা। নেটওয়ার্ক অ্যাডমিনিস্ট্রেটরকে নেটওয়ার্ক সেটআপ থেকে শুরু করে নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ, নেটওয়ার্ক উন্নত করাসহ বিভিন্ন কাজ করতে হয়। ডাটা বেইস অ্যাডমিনিস্ট্রেটর পদে কাজ করতে চাইলে একটি কম্পানির সব ধরনের তথ্যকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন ও ব্যবহার করার দায়িত্ব নিতে হবে। এ ছাড়া নতুন ডাটা বেইস সিস্টেম প্রতিস্থাপন করা, ডাটা বেইস সিস্টেমকে আপগ্রেড করাও একজন ডাটা বেইস অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আইটি কনসালট্যান্ট পদের কাজটি অনেকটাই হেল্প ডেস্ক টেকনিশিয়ানের মতো। তবে এখানে আইটি কনসালট্যান্ট সাধারণত নির্দিষ্ট কোনো কম্পানির আওতাধীন না হয়ে সব ধরনের ক্লায়েন্টের ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সহায়তা করে। টেকনিক্যালবিষয়ক প্রজেক্ট তৈরি করা ও দলের সদস্যদের তত্ত্বাবধায়ন করা একজন প্রজেক্ট ম্যানেজারের কাজ। আর নতুন পণ্য বা সফটওয়্যারের সমস্যা ও ত্রুটি দূর করে ক্লায়েন্টের জন্য মানসম্মত পণ্য নিশ্চিত করতে হয় একজন কোয়ালিটি অ্যাস্যুরেন্স কর্মকর্তাকে।
ইদানীং বহু কম্পানি ক্লাউড নেটওয়ার্কিং দিয়ে নিজস্ব সার্ভার নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে মাঝেমধ্যেই ক্লাউডজনিত কাজে সমস্যা হতে পারে। এই সমস্যা দূর করার দায়িত্ব পড়ে ক্লাউড আর্কিটেক্টের ওপর।
সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় মেশিন লার্নিং প্রসেস বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। আর এটি নিয়ে কাজ করতে হয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তাকে।
কেমন যোগ্যতা থাকা চাই
কম্পিউটার সায়েন্স কিংবা আইটির ওপর ডিপ্লোমা কিংবা স্নাতক ডিগ্রি থাকার পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ের ওপর ভেন্ডর সার্টিফিকেশন থাকলে ভালো হয়। সবচেয়ে বড় কথা বাস্তব বা ব্যাবহারিক কাজে দক্ষ হতে হবে। প্রতিনিয়তই তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়ন বা পরিবর্তন হচ্ছে, তাই প্রার্থীকেও সেসব বিষয়ে আপডেট ও জানাশোনা থাকতে হবে। সব ধরনের অপারেটিং সিস্টেমের ওপর ধারণা থাকতে হবে।
আইটি সেক্টরে প্রার্থীর একাডেমিক ডিগ্রির চেয়ে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে বেশি কদর করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রার্থীর নিজের কোনো প্রজেক্ট বা গিটহাব রেপো থাকলে চাকরি পাওয়াটা সহজ হবে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে—জরিপ পরিচালনা করা, বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের মানসিকতা, সফটওয়্যার তৈরির ধারণা, সিস্টেম অ্যানালিস্ট করার যোগ্যতা থাকা জরুরি। ডাটা বেইসের খুঁটিনাটি, এসকিউএল ও তথ্য জমা করার পদ্ধতিও জানতে হবে।
সফটওয়্যার বা অ্যাপ্লিকেশন ইঞ্জিনিয়ার পদে কাজ করতে হলে ব্যাক-এন্ড, ফ্রন্ট-এন্ড, ডেভঅপ্স, সিস্টেম অ্যাডমিন ও কোয়ালিটি অ্যাস্যুরেন্সের ওপর ধারণা থাকতে হবে; প্রগ্রামিং স্কিল বাড়াতে হবে।
এ বিষয়ে আবু তৈয়ব বলেন, সাধারণত আইটি সেক্টরে কাজ বলতে বিজনেস আইটি ও করপোরেট আইটি বোঝায়। দুই মাধ্যমে কাজের ধরন আলাদা। যেসব প্রতিষ্ঠান শুধু আইটিনির্ভর প্রতিষ্ঠান, তাদের বলে বিজনেস আইটি। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হলে আইটি বিষয়ে উচ্চমানের দক্ষ হতে হবে।
সাধারণত এসব প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এর ভিন্ন চিত্র করপোরেট হাউসগুলোতে। এসব প্রতিষ্ঠান সাধারণত এমন কাউকে খোঁজে, যারা সব বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা রাখে। তবে ফ্রেশারদের করপোরেট হাউসগুলোতেই চাকরি নেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে সে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারবে।
একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, শুধু একাডেমিক লেখাপড়া দিয়ে চাকরিযুদ্ধে নামা যাবে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকে আইটিবিষয়ক কোনো না কোনো বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে।
নিয়োগ যেভাবে
একেক প্রতিষ্ঠান একেকভাবে কর্মী নিয়োগ দিয়ে থাকে। ব্যাংক বা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে আইটি সেক্টরে লোকবল নিয়োগে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। তবে আইটি ফার্ম ও করপোরেট হাউসগুলোতে সাধারণত মৌখিক ও ব্যাবহারিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই করা হয়।
এ বিষয়ে আবু তৈয়ব বলেন, ‘আমরা সাধারণত মৌখিক পরীক্ষাই বেশি নিয়ে থাকি। আর মৌখিক পরীক্ষায় প্রার্থীদের কমিউনিকেশন স্কিলটা পরখ করে দেখা হয়। একজন ফ্রেশার যখন চাকরির জন্য আসে, আমরা ধরেই নিই—সে যা শিখে আসছে তার নব্বই ভাগই আমাদের কাজে লাগবে না। তাকে নতুনভাবে শেখাতে হবে। এটাই বাস্তব। তাই মৌখিক পরীক্ষায় একজন প্রার্থীর মধ্যে শেখার আগ্রহ আছে কি না সেটা খোঁজার চেষ্টা করি। ’
কেমন বেতন
এ খাতে বেতন ও সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি প্রতিষ্ঠানভেদে ভিন্ন হতে পারে। তবে একজন ফ্রেশার বা এন্ট্রি লেভেলে মাসিক বেতন ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার মতো হতে পারে। এক-দুই বছরের অভিজ্ঞদের জন্য মাসিক ৫৫ থেকে ৮৫ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। তিন-পাঁচ বছরের অভিজ্ঞদের মাসিক বেতন এক লাখ টাকার ওপরে হতে পারে। ৮-১০ বছরের অভিজ্ঞদের প্রতিষ্ঠানভেদে মাসিক বেতন দুই লাখ টাকা হতে পারে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।