অন্যরকম খবর ডেস্ক :: ভ্যান গাড়ির ওপর সারি সারি করে সাজানো রয়েছে খাবার ভর্তি বাটিগুলো। দেখে হয়তো মনে হবে কোন বুফের আয়োজন। মিরপুর এক নম্বরে হযরত শাহ আলী মহিলা কলেজের সামনে এ জায়গায় মূলত ঢাকার বিভিন্ন ক্লাব ও কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজিত বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো থেকে বেচে যাওয়া খাবার আসে। খাবারের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, কম দামে আমিষের চাহিদা মেটাতে এখানে আসে নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তরা ক্রেতারাও।
ঘড়িতে তখন বিকেল চারটে। মিরপুর এক নম্বরে হযরত শাহ আলী মহিলা কলেজের সামনে স্বাভাবিক দিনের মতই ব্যস্ততা। হঠাৎ কিছু মানুষকে জড়ো হতে দেখা গেলো দুটি পুরাতন ভ্যানগাড়ির চারপাশে। কারণ আর কিছুই নয়, বড় বড় পাত্রে বিয়েবাড়ির খাবার আসতে শুরু করেছে! পাত্রগুলোর কোনটাতে গরুর মাংস, কোনটাতে মুরগির রোস্ট, কোনটায় আবার খাসির রেজালা। বড় পাত্র থেকে খাবারগুলো এবার রাখা হলো ছোট ছোট বাটিতে। বাটি ভরা তেল-মশলা যুক্ত খাবারগুলোর ঘ্রাণ ছড়াতে লাগলো চতুর্দিকে। মানুষের ভিড়ও বাড়তে লাগলো ক্রমশ।
কলেজ গেটের সামনে এসব অবশ্য প্রাত্যহিক ঘটনা। চারটায় শুরু হয়ে চলে রাত ১২টা পর্যন্ত। উৎসুক জনতাও চতুর্দিকে দাঁড়িয়ে দেখে খাবার নামানো উঠানোর কাজগুলো। কিন্তু যে খাবারগুলো থাকার কথা বড়বড় সব রেস্টুরেন্ট কিংবা বুফের আয়োজনে, সেগুলো ফুটপাতে এই ভ্যানগাড়ির ওপর কীভাবে এলো?
কারণটি স্বাভাবিক। ঢাকার বিভিন্ন ক্লাব ও কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলো থেকে বেচে যাওয়া খাবারই মূলত এখানে নিয়ে আসা হয়। মিরপুরের এই ফুটপাতে সেসব খাবার বিক্রি হয় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম দামে। তাই নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত, অনেকেই আমিষের চাহিদা মেটাতে ছুটে আসেন এখানে।
ফুটপাতের বুফে
ভ্যান গাড়ির ওপর সারি সারি করে সাজানো রয়েছে খাবার ভর্তি বাটিগুলো। দেখে হয়তো মনে হবে কোন বুফের আয়োজন।
এখানে দোকান মূলত দুটি। এর মধ্যে একটির বর্তমান মালিক জীবন আহমেদ। বছর ত্রিশ আগে তার মা শুরু করেছিলেন এ ব্যবসা। শুরুতে এত জমজমাট না হলেও এখন বেশ ভালো যাচ্ছে সময়। মা-বাবা এখনও আসেন, যদিও মূল দায়িত্ব তাকেই সামলাতে হয়।
বিয়ে কিংবা যে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে খাবার একটি মহাগুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। প্রায়শই এসব অনুষ্ঠান শেষে খাবার বেচে যায়। সেগুলোই চলে আসে ফুটপাতের এই দোকানগুলোতে। জীবন আহমেদ জানালেন, ঢাকা ক্লাব, ঢাকা বন ক্লাব থেকে শুরু করে বড় বড় কমিউনিটি সেন্টারের খাবার এখানে আসে। দিয়ে যায় কারা? “বাবুর্চিরা। তারপর মনে করেন ক্যাটারিং এর লোকজন আইসা এইগুলা দিয়া যায়। আমরা তাগোর থাইকা কিনা রাখি। পরে বাটি বাটি ভাগ করে বিক্রি করি।”
জীবন আহমেদের পাশের ভ্যানে যিনি খাবার সাজিয়ে বসেছেন তার নাম ফরিদা বেগম। বিকেল বেলা তার দোকানেই খাবারের পরিমাণ দেখা গেল বেশি। স্বাভাবিকভাবে ক্রেতারাও ভিড় জমাচ্ছেন সেখানে। খাবার বিক্রির ব্যস্ততার তিনি আর কথা বলতে পারলেন না। কথা বললেন তার নাতি মোহাম্মদ রাহাত। তিনি বেচা-বিক্রিতে সাহায্য করে থাকেন দাদিকে। জানালেন, তার জন্মের আগে থেকেই এই ব্যবসা করে তার পরিবার।
মিরপুরে হযরত শাহ আলীর মাজারের পাশে শাহ আলী মহিলা কলেজ। কলেজ গেটের ঠিক সামনেই বৃহস্পতি থেকে মঙ্গলবার দেখা মিলবে ভ্যানগাড়ি দুটির। শুধু বুধবারে বন্ধ থাকে খাবার বিক্রি। অন্যসব দিন, বিকেল ৪ টা থেকে মধ্যরাত অবধি চলে বেচাকেনা।
যেসব খাবার পাওয়া যায়
বড় বড় অনুষ্ঠানগুলোর মেনুতে যেসব খাবার থাকে, এসব দোকানে বিক্রি হয় সে খাবারগুলোই। তবে সবদিন একই ধরনের খাবার পাওয়া যায় না। কোনদিন একটি খাবার বেশি পরিমাণে থাকলেও, অন্যদিন হয়তো সেটা পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে।
যেদিনের ঘটনা বলছি, সেদিন জীবন আহমেদের ভ্যানগাড়ির ওপর রাখা ছিলো এক বাটি রূপচাঁদা ভাঁজা। এই খাবার অন্য দিনগুলোতে তেমন দেখা যায় না বলে জানালেন তিনি। তবে এখানে সবচেয়ে বেশি যা পাওয়া যায় তা হলো গরু ও খাশির মাংস।
গরুর মাংসের এক কেজি ওজনের বাটি ৫০০ টাকা। তবে সমপরিমাণ খাশির মাংস কিনতে হয় ৭০০ টাকা দরে। বিয়ে বাড়ির মুরগির মাংসের বিরিয়ানিও এখানে পাওয়া যায়। পলিথিনে ভাগ ভাগ করে রাখা বিরিয়ানির দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। মুরগির রোস্ট বাটির আকার ভেদে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। প্রায় সমপরিমাণ টাকায় পাওয়া যায় পাওয়া যায় মুরগির ঝাল ফ্রাই। এসব দোকানে কখনো কখনো মাছ পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে বাজার বুঝে দাম নির্ধারণ করেন দোকানিরা।
আস্ত খাসি কিংবা খাসির মাথাও মাঝেমধ্যে আসে এখানে। খাশির মাথার দাম শুরু হয় ৬০০ টাকা থেকে। অন্যদিকে সম্পূর্ণ খাসি বিক্রি হয় ৩০০০ টাকার ওপরে। জর্দা কিংবা পোলাওয়ের মত খাবারও পরিমাণ অনুযায়ী দাম হাকা হয়। দুই লিটারের বোতল ভরতি বোরহানির দামও ওঠানামা করে। কখনো ২০০, আবার কখনো দেড়শো টাকায় বিক্রি হয় প্রতি বোতল।
নিজের পছন্দমতো খাবার চাইলেই পাওয়া যায় না এখানে, জানালেন মোহাম্মাদ লোকমান। ভ্যানগাড়ি দুটির পাশেই শরবত বিক্রি করেন তিনি। তার মতে, প্রতিদিন খাবার যখন আসে, তখন আসলে ভালো জিনিস পাওয়া যায়। কোন কোন দিন ভাগ্য ভালো থাকলে মিলে যেতে পারে পছন্দের খাবার। কিন্তু কাবাব, কাচ্চির মতো খাবার চাইলেই হরহামেশা পাওয়া যায় না। সময় করে আসলে তবেই মিলতে পারে কাঙ্খিত খাবার।
চাহিদা রয়েছে বেশ
“বাজারে এক কেজি গরুর মাংস কিনতে হলে ৮০০ টাকা লাগে, সাথে ২০০ টাকার মশলা। আর এখানে আপনে এক কেজি রান্না করা গরুর মাংস পাইতেছেন মাত্র ৫০০ টাকায়। মানুষ কিনবে না কেন বলেন?” কথাগুলো বলেই সাথে একটি প্রশ্ন জুড়ে দিলেন জীবন আহমেদ।
মোহাম্মদ ফরহাদ এসেছিলেন শাহ আলীর মাজারে। সাথে তার স্ত্রী এবং ছ-সাত বছর বয়সী সন্তান। ফেরার পথে খাবার কিনতে এসেছেন ফরিদার দোকানে। এসেই এক বাটি গরুর মাংস কিনে ফেললেন। “আগে ফেসবুকে ভিডিও দেখেছি। কিন্তু দাম তো অনেক কম ছিলো। এখন বাড়ছে। তবে খারাপ না, এত কম দামে মাংস কোথাও পাওয়া যায় না।”
রাতে বাসায় পোলাও রান্না করবেন এক মধ্যবয়সী নারী। জানালেন, রাতের খাবারের জন্য মাংস কিনতে এসেছেন কাফরুল থেকে। নাম না জানা এই নারীর মতই ছেলে-বুড়ো নির্বিশেষে ক্রেতার ভিড় লক্ষণীয় দোকান দুটিতে। অনেকেই আবার আসছেন সস্ত্রীক। বিভিন্ন খাবারের দিকে আঙুল দেখিয়ে একে একে জেনে নিচ্ছেন দাম। তারপর পছন্দ মতো কিনে নিচ্ছেন কোনো কোনো খাবার।
এসব খাবার ‘উচ্ছিষ্ট’ জেনেও ব্যপক চাহিদা কেন? রিকশাচালক হাসিবুলের মতে, উচ্চমূল্যের বাজারে এত কম দামে আমিষ পাওয়া যাচ্ছে, এটাই মূল কারণ। এখানকার খাবার নিজে কখনো না কিনলেও এত চাহিদা থাকার কারণ বললেন বিশেষজ্ঞের মতই। “জিনিসপাতির যা দাম মামা, এই খাবার বাজারে কিনতে পারে কেউ? এইহানে কম দামে পায়, নিয়ে যায়।”
কারা কেনেন এসব খাবার
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ফুটপাতের এই দোকানগুলোর ক্রেতা মূলত নিম্ন আয়ের মানুষ। কথাটি পুরোপুরি সত্য নয় বলে জানালেন জীবন আহমেদ। “গরিব খুব কমই দেখি। স্থানীয় মানুষ জনই বেশি আহে। অনেক সময় একজনেই তিন থেকে চার হাজার টাকার মাল লয় (নেয়)। গরিব কি এত টাকার মাল কিনতে পারবো? একটা বাটি কিনতে গেলেও হিমশিম খাবে। যে ব্যাটা রিক্সা চালায় সে পাঁচশো টাকা হইছে কিনা সেই চিন্তা করে।”
তিনি আরো জানালেন, অনেকসময় নিজস্ব গাড়িতে করে এসেও খাবার কিনে নিয়ে যান কোন কোন খদ্দের। “ভিআইপি লোকই বেশি আসে। এই এলাকার যে বেডার (ব্যক্তির) দুইটা বাড়ি আছে, সেও দেহি এহানে দাঁড়াইয়া মাল লইয়া যায় গা। গতকাল একটা লোক গাড়ি থামাইয়া ৫০০০ হাজার টাকার মাংস নিয়ে গেলো। হয়তো ছোটখাটো একটা পার্টি করবো।”
মূলত স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত ক্রেতা থাকলেও, নিম্নবর্গের মানুষও আমিষের চাহিদা মেটাতে হাজির হন দোকাগুলোতে। পরিমাণে কম কিনলেও তারাই সংখ্যায় বেশি বলে মত দিলেন আরেক দোকানদার রাহাত।
স্বাস্থ্যঝুঁকির কথাও বলেন কেউ কেউ
দিনের বেলার যে কোনো অনুষ্ঠানে দুপুরের খাবারকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। সে হিসেবে খাবার তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় সকাল থেকেই। সকালের দিকে প্রস্তুতকৃত খাবার সন্ধ্যা গড়িয়ে যখন এই ফুটপাতে আসে, তখন ঠিক কতটা খাওয়ার উপযোগী থাকে- সে নিয়ে প্রশ্ন অনেকেরই।
বিয়ে বাড়ির অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার যে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ার সে কথা বাদ দিলেও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সকলেরই আপত্তি। সেটি হলো, ভ্যানের ওপর খাবারগুলো কখনোই ঢেকে রাখা হয় না।
দোকানিরা বলছেন, মূলত ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই এ কাজ। কিন্তু অল্প বাতাসেই যে শহরে ধুলির ঝড় ওঠে, সে শহরে উন্মুক্ত আকাশের নিচে খোলা খাবার কতটুকু নিরাপদ? মিরপুর ঢাকার ব্যস্ততম এলাকাগুলোর একটি। কলেজের সামনে এ পরিবেশকেও খুব বেশি স্বাস্থ্যকর বলা চলে না।
জীবন আহমেদ জানালেন, তারা নিজেদের বাসাতেও এই খাবারগুলো খেয়ে থাকেন। ক্রেতারাও ধুলাবালিকে কিছু মনে করেন না। বলছিলেন, “একটু পর মাল আসলেই দেখবেন আমি খাবো। আর যদি খোলা না রাখি, যে গরমডা পড়ে, ঢাইকা রাখলে তো নষ্ট হইয়া যাইবো। এটা ডিসপ্লে করাই লাগবো। আগে তো নিচে বিছানা পেতে মাল বেচতাম, এখন তো তাও ভ্যান আছে।”
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।