ধর্ম ডেস্ক : রোজা বা সিয়াম ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল ভিত্তির তৃতীয়। সুবহে সাদিক বা ভোরের সূক্ষ আলো থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব প্রকার পানাহার,পাপাচার, কামাচার ও সেই সাথে যাবতীয় ভোগ-বিলাস থেকেও বিরত থাকার নাম রোজা।
ইসলামের মূল স্তম্ভসমূহের মধ্যে ঈমান, নামাজ ও যাকাতের পরই রোজার স্থান। হাদিস শরিফে এসেছে-
بُنِيَ الْإِسْلَامُ عَلَى خَمْسَةٍ، عَلَى أَنْ يُوَحّدَ اللهُ، وَإِقَامِ الصَلَاةِ، وَإِيتَاءِ الزّكَاةِ، وَصِيَامِ رَمَضَانَ، وَالْحَجِّ.
পাঁচটি স্তম্ভের ওপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত আল্লাহ তাআলাকে এক বলে স্বীকার করা, নামাজ কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, রমজানের রোজা রাখা ও হজ্ব পালন করা। (সহিহ মুসলিম ১/৩২)
সুতরাং রমজানের পূর্ণ মাস রোজা রাখা ফরজ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَیْكُمُ الصِّیَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَی الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ. হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর (রমজানের) রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের উপর ফরজ করা হয়েছিল। যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পার। (সুরা বাকারা (২) : ১৮৩)
মাহে রমজানকে তিন দশকে ভাগ করা হল যে কারণে
শরয়ি ওজর ছাড়া যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত একটি রোজাও পরিত্যাগ করে সে নিকৃষ্ট পাপী। দ্বীনের মৌলিক ফরজ লংঘনকারী এবং ঈমান ও ইসলামের ভিত্তি বিনষ্টকারীরূপে পরিগণিত হবে। আর এ কারণে সে রোজার যে মঙ্গল ও বরকত থেকে বঞ্চিত হবে কস্মিণকালেও তার ক্ষতিপূরণ করতে পারবে না। এমনকি এ রোজার কাযা করে নিলেও তা ফিরে পাবে না। হাদিস শরিফে এসেছে-
مَنْ أَفْطَرَ يَوْمًا مِنْ رَمَضَانَ مِنْ غَيْرِ رُخْصَةٍ وَلَا مَرَضٍ، لَمْ يَقْضِ عَنْهُ صَوْمُ الدّهْرِ كُلِّهِ وَإِنْ صَامَهُ.
যে ব্যক্তি কোনো ওযর বা অসুস্থতা ব্যতিরেকে রমজানের একটি রোজা পরিত্যাগ করবে সে যদি ওই রোজার পরিবর্তে আজীবন রোজা রাখে তবুও ওই এক রোজার ক্ষতিপূরণ হবে না। (জামে তিরমিজি, হাদিস ৭২৩)
অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় এই যে, আমাদের সমাজে অনেক সবল-সুঠাম দেহের অধিকারী ব্যক্তিও অকারণে, সামান্য ছুতায় অসুস্থ হওয়ার অমূলক আশঙ্কায় রোজা পরিত্যাগ করেন। এতে তারা আখেরাতের কত বড় ক্ষতি নিজের ওপর টেনে নিচ্ছে তা একটু ভেবেও দেখে না।
রোজার অর্থ: রোজা একটি ফারসি শব্দ। এর আররি হলো ‘সওম’। সওম এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। শরীয়তের পরিভাষায় ‘জ্ঞানবুদ্ধি সম্পন্ন মুসলমানের ওপর সুবহে সাদিক তথা দিনের একেবারে শুরু ভাগ থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়তে পানাহার, স্ত্রী সহবাস ও রোজাভঙ্গকারী অন্যান্য কার্যাদি থেকে বিরত থাকার নামই হলো ‘সওম’ বা ‘রোজা’।’
রোজার ইতিবৃত্ত
রোজা এমন একটি ইবাদত, যা বাহ্যত কষ্টকর হলেও তার প্রচলন ছিল সর্বকালে। হযরত আদম আ.-এর যুগ থেকে শেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সব নবীর উম্মতের ওপরই তা ফরজ ছিল। -রূহুল মাআনী ২/৫৬
অবশ্য পূর্ব যুগে রোজার ধরন ছিল বিভিন্ন প্রকৃতির। রোজা রাখার পদ্ধতির ভিন্নতা ছাড়াও ফরজ রোজার সংখ্যাও বিভিন্ন রকম ছিল। প্রাথমিক অবস্থায় উম্মতে মুহাম্মদীর ওপরও কেবল আশুরার রোজা ফরজ ছিল। রমজানের রোজার ফরজ বিধান আসার পর আশুরার রোজা ফরজ হওয়ার হুকুম রহিত হয়ে যায়। -মাআরিফুস সুনান ৫/৩২৩
রোজা ফরজ হয় হিজরতের দেড় বছর পর, ১০ শাবানে। রোজা ফরজ হওয়ার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোট ৯টি রমজান পেয়েছিলেন।
রোজার হেকমত
রোজার হেকমত তথা অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে একটি কথা ভালোভাবে জানা থাকা দরকার। তা এই যে, মহিয়ান গরিয়ান আল্লাহ তাআলা হলেন মহান স্রষ্টা ও মহা মুনিব আর মানুষ হল তার ক্ষুদ্র সৃষ্টি ও দাস। এ সম্পর্কের দাবি হলো, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রতিপালক যে কোনো নির্দেশ দেবেন, মানুষ সর্বদা প্রস্তুত থাকবে তা পালনের জন্য। ওই নির্দেশের হেকমত (তাৎপর্য) তার বুঝে আসুক বা না আসুক।
সুতরাং মহান আল্লাহ তাআলা যেসব ইবাদতের নির্দেশ দেবেন, সেগুলোর কোনো কারণ বা তাৎপর্য জানা না থাকলেও তাৎক্ষণিক নতশিরে তা মেনে নেয়াই হচ্ছে বান্দার দায়িত্ব। বলাবাহুল্য, শরীয়ত নির্দেশিত কোনো ইবাদতই তাৎপর্যহীন বা যুক্তিবিরোধী নয়। তবে সব কিছুর যুক্তি বা হেকমতই যে বান্দার জানা থাকবে বা বান্দার জ্ঞান-বুদ্ধি তাকে স্পর্শ করতে পারবে এমনটি ভাবা ঠিক নয়। কারণ আল্লাহ তাআলা বান্দাকে অতি সামান্য জ্ঞানই দান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَ مَاۤ اُوْتِیْتُمْ مِّنَ الْعِلْمِ اِلَّا قَلِیْلًا.তোমাদের অতি সামান্য জ্ঞানই দান করা হয়েছে। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৮৫
আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিনের নির্দেশসমূহে কত হেকমত, কত কারণ এবং কত উদ্দেশ্যই থাকতে পারে, বান্দার কত কল্যাণই তাতে নিহিত থাকতে পারে। অসীম জ্ঞানের অধিকারী সে সত্তার নির্দেশসমূহ তাৎপর্য সসীম জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ কীভাবে বুঝতে পারবে! তবুও ইসলামী পণ্ডিতগণ বিভিন্ন ইবাদতের বিভিন্ন ধরনের হেকমত বর্ণনা করেছেন। রোজার ব্যাপারেও বিভিন্ন হেকমতের কথা তারা বলেছেন।
রমজান মাস কী ও কেনো
যদিও শরীয়তের নির্দেশ মান্য করা এ সব হেকমত বুঝে আসার সঙ্গে সম্পর্কিত নয় তথাপি সম্মানিত পাঠকমণ্ডলীর কৌতুহল নিবারণের উদ্দেশ্যে নিচে রোজার দু-একটি হেকমত সম্পর্কেও আলোকপাত করা হলো।
‘আল্লাহ তাআলা মানুষের স্বভাবে যে ফেরেশতা সুলভ বৈশিষ্ট্য চরিত্র গচ্ছিত রেখেছেন, তার উন্নতি ও উৎকর্ষসাধন এবং নফস ও প্রবৃত্তির দমন ও নিবৃত্তির অন্যতম মাধ্যম হলো রোজা। কানা‘আত, আত্মশুদ্ধি, সবর-শোকর, তাকওয়ার মতো বৈশিষ্ট্যগুলোর উন্নতি ও বিকাশে রোজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। উপরন্তু রোজার মাধ্যমে মানুষ উদার ও প্রবৃত্তিরথ জৈবিক তাড়না হতে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে ঊর্ধ্বজগৎ তথা আপন স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগসূত্র স্থাপনে সক্ষম হয়।
তাছাড়া নিরেট চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য বছরের কিছু দিন অবশ্যই পানাহার বর্জন করা উচিত। এটি স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ উপকারী। তাই হিন্দু-খ্রিস্টান সব ধর্মেই রোজার মতো উপবাস করার প্রচলন রয়েছে। (যদিও ইসলামের রোজার সাথে সেসব উপবাসের পদ্ধতিগত কোনো মিলই নেই)। (আরকানে আরবাআ : ২৬৪)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।