বিজ্ঞান ও প্রযক্তি ডেস্ক : জোয়ারের পানিতে পটুয়াখালীর একটি খালে টর্পেডো ভেসে আসার পর- এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে ব্যাপক আলোচনা। এমনকি বিশ্বে কত ধরনের আধুনিক প্রযুক্তির টর্পেডো রয়েছে, এর ব্যবহারই বা কী সেসব নিয়েও আছে আলোচনা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের সাথে সাথে উন্নত হচ্ছে টর্পেডোর প্রযুক্তিও। নিউক্লিয়ার সাবমেরিনের মাধ্যমে যেসব টর্পেডো ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
টর্পেডো আসলে কী?
এটি মূলত যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংসকারী বিস্ফোরক বা বোমা।
ভেঙে বললে, টর্পেডো হচ্ছে পানির তলদেশে চলতে সক্ষম এক ধরনের অস্ত্র। যা পানির তলদেশে বা পানির উপর থেকে অর্থাৎ উভয় স্থান থেকেই লক্ষবস্তুতে নিক্ষেপ করা যায়। এর ভিতরে সমুদ্রযান ধ্বংস করার জন্য বিস্ফোরক মজুদ থাকে।
টর্পেডোর কাজ কী?
টর্পেডো হচ্ছে এক ধরনের সেলফ প্রোপেলড মিসাইল।
যেটি পানির নিচ দিয়ে গিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। এর ভেতরে সমুদ্রযান ধ্বংসের জন্য বিস্ফোরক ওয়ারহেড যুক্ত থাকে।
লক্ষ্যবস্তুর সাথে সংঘর্ষ হলে অথবা কাছাকাছি এলে এটি বিস্ফোরিত হয়। যেকোনো বড় জাহাজ ধ্বংস করে দেয়ার কাজে টর্পেডো ব্যবহার হয়। সাধারণত বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনী এটি ব্যবহার করে থাকে। কারণ টর্পেডো মূলত ব্যবহার হয়ে থাকে যুদ্ধক্ষেত্রে জাহাজ ধ্বংস করার কাজে।
সামরিক বাহিনীর সদস্যদের কাছে টর্পেডো আগে ‘ফিশ’ বা মাছ নামে পরিচিত ছিল। একে অটোমোটিভ এবং অটোমোবাইল নামেও ডাকা হতো। এছাড়া ‘মাইন’ও আগে ‘টর্পেডো’ নামে পরিচিত ছিল।
গত শতাব্দীর প্রথমদিক থেকে টর্পেডো নামটি শুধুমাত্র জলের নিচের স্ব-চালিত অস্ত্রের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়ে আসছে।
টর্পেডো কিভাবে কাজ করে?
টর্পেডো এমন এক গাইডেড বিস্ফোরক যা পানির নিচ দিয়ে অতিক্রম করে লক্ষবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।
রকেট ইঞ্জিন, জেট ইঞ্জিন, জাহাজ, ডুবোজাহাজ, হেলিকপ্টার, বিমান, ভাসমান মাইন, সাবমেরিন, মিসাইল, নৌঘাঁটি ইত্যাদি থেকে এটি নিক্ষেপ করা যায়।
বিমান বা হেলিকপ্টারের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট গতি ও উচ্চতায় পৌঁছানোর পর টর্পেডোকে ছেড়ে দেয়া হয়। যাতে তা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে আঘাত করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে টর্পেডো সাধারণত পাখার নিচে বহন করা হয়ে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা এমন একটি ডিভাইস বা সমরাস্ত্র যা দিয়ে পানির নিচে যেকোনো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা যায়। আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন টর্পেডো পানির নিচ থেকে বের হয়ে উপরের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতেও আঘাত হানতে সক্ষম।
বাংলাদেশে যে ধরনের টর্পেডো রয়েছে
প্রতিরক্ষার সুরক্ষা হিসেবে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্র যেমন মিসাইল, টর্পেডো, মাইন এবং অন্যান্য সমরাস্ত্র রয়েছে। একইসাথে মিসাইল, টর্পেডো, মাইন এবং গোলাবারুদ সংরক্ষণ ও মেরামতের সক্ষমতাও রয়েছে নৌবাহিনীর।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ মুসা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের নৌবাহিনীতে আধুনিক প্রযুক্তির নানা ধরনের টর্পেডো রয়েছে। চাইনিজ, ইউরোপীয়ান উন্নত প্রযুক্তির অনেক টর্পেডোই রয়েছে। যতদিন এগুচ্ছে প্রযুক্তিগতভাবে তত উন্নত টর্পেডো কেনা হচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের নেভিতে যেসব টর্পেডো রয়েছে এগুলোর সক্ষমতা হলো একটা সাবমেরিন টর্পেডো দিয়ে আরেকটা সাবমেরিন বা জাহাজে আঘাত হানা যায়। দেশে সাবমেরিনের সাথে টর্পেডো নেট রয়েছে। জাহাজ থেকে ছোড়া হলে পানিতে ডাইভ করে কিছু দূরত্বে গিয়ে যেখানে প্রোগ্রাম করে দেয়া হয় সেখানে গিয়ে আঘাত করে। এটাই এর কাজ।’
টর্পেডো নেট হলো জাহাজ নিষ্ক্রিয় করার প্রতিরক্ষামূলক যন্ত্র।
মুসা বলেন, ‘পানির নিচে কোনো ধরনের শত্রু জাহাজ বা শত্রু সাবমেরিনকে আঘাত বা ঘায়েল করার জন্য এটা মারাত্মক সমরাস্ত্র।’
বিশ্বের ৫টি আধুনিক টর্পেডো
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, ততই আধুনিক হচ্ছে টর্পেডোর ধরন। একসময় ধারণা ছিল শুধুমাত্র পানির নিচের অস্ত্র হিসেবে টর্পেডো ব্যবহৃত হয়। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি পাল্টে দিয়েছে সে ধারণা। এখন স্বল্প দূরত্বের লক্ষ্যবস্তুর পাশাপাশি দীর্ঘ দূরত্বের লক্ষ্যবস্তুতেও আঘাত হানতে পারে টর্পেডো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওজনের ওপর নির্ভর করে দুই ধরনের টর্পেডো রয়েছে। একটি হাল্কা ওজনের দ্বিতীয়টি ভারী ওজনের।
এম কে ৫৪ লাইটওয়েট টর্পেডো
এটি আধুনিক প্রযুক্তির লাইটওয়েট টর্পেডো। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সহায়তায় রেথিয়ন ইন্টিগ্রেটেড ডিফেন্স সিস্টেম নামের প্রতিষ্ঠান এর নকশা করেছে। একইসাথে তারাই এটি তৈরি করেছে। এটি আগে লাইটওয়েট হাইব্রিড টর্পেডো নামে পরিচিত ছিল।
এই অ্যান্টি-সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার টর্পেডোটি গভীর ও অগভীর পানি- দুই ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যায়।
পানির নিচের লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি শ্রেণিবিভক্তি করে আঘাত হানতে সক্ষম এটি। এর দৈর্ঘ্য দুই দশমিক ৭১ মিটার। ওজন ২৭৫ দশমিক ৭ কেজি।
পানিতে ভাসমান জাহাজ, বিমান এবং হেলিকপ্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা যায় এমনভাবে এটি ডিজাইন করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনী এই আধুনিক টর্পেডো ব্যবহার করে। এমনকি রয়েল এয়ারফোর্স এবং রয়েল থাই নেভিও এটি ব্যবহার করছে।
এফ ২১ হেভিওয়েট টর্পেডো
এফ ২১ হলো নতুন প্রজন্মের একটি হেভিওয়েট টর্পেডো। ফরাসি নৌ প্রতিরক্ষা এবং মেরিন রিনিউয়েবল এনার্জি কোম্পানি এটি তৈরি করেছে।
এটি একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টর্পেডো। যা শত্রু সাবমেরিন এবং পানির উপরের জাহাজকে লক্ষ্য করে আঘাত হানার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে।
গভীর পানি এবং কাছাকাছি উপকূলীয় এলাকায় উচ্চ মাত্রার শব্দ এবং অনেক জাহাজ রয়েছে এমন স্থানেও অপারেশন চালাতে সক্ষম এটি।
এটির দৈর্ঘ্য ছয় মিটার। ওজন এক দশমিক পাঁচ টন।
ব্ল্যাক শার্ক টর্পেডো
এটি একটি নতুন প্রজন্মের হেভিওয়েট টর্পেডো। বিভিন্ন ভূমিকায় এর ব্যবহার দেখা যায়। সাবমেরিন বা পানির উপরের জাহাজ থেকে ছোড়া হয় এটি। পানির উপরের এবং নিচে সব ধরনের হুমকি মোকাবেলার জন্য এর নকশা করা হয়েছে।
ইতালীয় নৌবাহিনী এটি ব্যবহার করে। এ -১৮৪ হেভিওয়েট টর্পেডোর পরিবর্তে এটি ব্যবহার করা হয়।
এই টর্পেডোটির ডায়ামিটার ২১ ইঞ্চি। এর উচ্চ বিস্ফোরকযুক্ত ওয়ারহেড রয়েছে। এটি ৫০ কিলোমিটার রেঞ্জের মধ্যে উৎক্ষেপণ করা যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ মুসা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘যত দিন যাচ্ছে বিশ্বে টর্পেডোর প্রযুক্তি ততই আধুনিক হচ্ছে। আগে শর্ট ডিসটেন্স ছিল। এখন লং ডিসটেন্সে টর্পেডো ছোড়া যায়। আগে বেশিদূরে ডাইভ করতে পারতো না। এখন অনেক দূরে ডাইভ করতে পারে। সমুদ্রে ডাইভ করার সময় হাই প্রেশার লাগে। সেসব প্রযুক্তিও অনেক এগিয়ে গেছে বিশ্বে।’
স্পেয়ারফিস হেভিওয়েট টর্পেডো
আধুনিক প্রযুক্তির হেভিওয়েট এই টর্পেডো সামুদ্রিক এবং উপকূলীয় এলাকার পানির উপরের হুমকির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়।
যুক্তরাজ্যের রয়্যাল নেভির সাবমেরিন বহরের সাথে এই এক দশমিক ৮৫ টনের টর্পেডো রয়েছে।
এটি তিন শ’ কেজি বিস্ফোরক ওয়ারহেড বহন করে। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তারের ব্যবস্থা রয়েছে এর, যা লক্ষবস্তুর দিকে সরাসরি আঘাত হানতে সক্ষম। এর প্রোপালশন ব্যবস্থা কম গতিতে ৪৮ কিলোমিটারের মধ্যের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।
টর্পেডো – ৬২
এটি রয়েল সুইডিশ নৌবাহিনী ব্যবহার করে। এটি হেভিওয়েট টর্পেডো, যা দ্বৈত উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায়। সুইডিশ নৌবাহিনীর সাবমেরিন ফ্লিটের সাথে ব্যবহার করা হয় এই টর্পেডো।
এটি সব ধরনের সাবমেরিন ও পানির উপরের জাহাজকে লক্ষ্যবস্তু করে আঘাত হানতে সক্ষম। এই টর্পেডো এক হাজার ৪৫০ কেজি ওজনসহ উৎক্ষেপণ করা যায়। এটি উচ্চ বিস্ফোরক ওয়ারহেড বহন করতে পারে।
পানির নিচের পাঁচ হাজার মিটার গভীরতায় কাজ করতে সক্ষম এই টর্পেডো।
একটি উন্নতমানের পাম্প জেট ইঞ্জিন দ্বারা এটি পরিচালিত হয় এবং সর্বোচ্চ ৪০ কিলোমিটার গতিতে ৪০ কিলোমিটারের মধ্যে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে এই টর্পেডো।
‘বিশ্বে এখন টর্পেডো থেকে টর্পেডা ফ্লাই করে সমুদ্রের উপরে এসে খোলস খুলে গিয়ে মিসাইল হয়ে যায়। এমন টর্পেডো ও আছে। এগুলো ডুবে থাকে। আবার সমুদ্রের উপরে ভেসে উঠে টিউব বার্স্ট করে মিসাইল লঞ্চ করে জাহাজ বা ক্রুজ মিসাইলে আঘাত হানে এমন টর্পেডোও রয়েছে,’ বলেন মুসা।
পোসেইডন টর্পেডো
২০১৫ সালে রাশিয়ান নৌবাহিনী প্রথম পারমাণবিক শক্তিচালিত এই টর্পেডোটি প্রকাশ করে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। পরের বছর নভেম্বরে প্রথমবারের মতো এটি পরীক্ষা করা হয়েছিলো।
এই টর্পেডো মূলত পারমাণবিক শক্তি চালিত পানির নিচের ড্রোন যা পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
২০২৭ সালের মধ্যে প্রথম পোসেইডন মোতায়েন করা হবে বলে বুলেটিন অব দ্যা এটোমিক সাইন্টিটসের ওয়েবসাইটে গত বছর প্রকাশ করা হয়েছে।
মুসা বলেন, ‘যেসব দেশ নিউক্লিয়ার সাবমেরিন ব্যবহার করে তারা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ নিউক্লিয়ার সাবমেরিন যখন তখন মুভ করানো যায় না। সাবমেরিন পানির তলদেশে থেকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে এই টর্পেডো দিয়ে।’
সূত্র : বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।