বিনোদন ডেস্ক : ‘পাসুরি’—কোক স্টুডিও, পাকিস্তানের ১৪তম সিজনের দ্বিতীয় এপিসোডের এই গানটি শোনেননি এমন শ্রোতা খুব কম পাওয়া যাবে। সত্যিকার অর্থে গানটি অত্যন্ত সাধারণ হলেও এ গানটির আবেদন এতটাই যে ইতিমধ্যে সেটি ৭০ কোটিরও বেশি মানুষ শুনে ও দেখে ফেলেছেন। কোক স্টুডিও পাকিস্তানের এতটা ব্যবসাসফল আর দর্শকনন্দিত গান আর নেই।
গানটির গীতিকার, প্রধান সংগীত পরিচালক ও থিং ট্যাঙ্ক আলী শেঠি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, গানটির ভাবনা আমার মাথায় প্রথম আসে একটি জিঙ্গেল ট্রাক (ভারত ও পাকিস্তানে এধরনের ট্রাক দেখা যায়। যেগুলো বিশেষভাবে চিত্রায়িত থাকে। দৃষ্টিনন্দন নানা ক্যালিগ্রাফি বা চারুলিপি ও আঁকাআঁকি থাকে এসব ট্রাকে।) দেখে। ওই ট্রাকটির পেছনে লেখা ছিল একটি পাঞ্জবি বাক্য—আগ লাগা তেরি মাজবুরিয়া নু (তোমার সব উদ্বেগ আর বাধ্যবাধকতায় আগুন ধরিয়ে দাও)। আমি তখন ফয়সালাবাদ (পাকিস্তানের পাঞ্জাবের অন্যতম বড় শহর) থেকে লাহোর (পাকিন্তানের পাঞ্জাব রাজ্যের রাজধানী) ফিরছিলাম। আমি অনুভব করলাম- এটি পাঞ্জাবি ভাষার একটি দারুণ অভিব্যক্তি। আমার মনে হলো, এটিকে অবশ্যই একটি গানের অংশ হওয়া উচিত। এটাই আমাকে এমন একটি গান তৈরির বিষয়ে অনুপ্রাণিত করেছিল।
শেঠি আরও বলেন, আমি এমন একটি গান লিখতে চেয়েছিলেন যা ক্লাসিক্যাল মনে হলেও সমসাময়িক জীবনের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ।
‘পাসুরি’ পাঞ্জাবি ও উর্দু ভাষার সংমিশ্রণে লিখিত একটি গান। গানটির প্রধান গীতিকার আলী শেঠি, সঙ্গে ছিলেন ফজল আব্বাস। সুরারোপও করেন আলী, সঙ্গে ছিলেন জুলফিকার (জুলফি) জব্বর খান। আর এই গানটির সংগীত আয়োজন করেন আব্দুল্লাহ সিদ্দিকি ও শেরি খাতাক। পাকিস্তানি পপ, পাঞ্জাবি ফোক আর রেগেটোনের দুর্দান্ত মিশ্রণ এই গানটি। ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কোক স্টুডিও পাকিস্তানের ইউটিউব চ্যানেলে অবমুক্ত হয় ৩ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডের এই গানটি।
আলী শেঠি বলেন, গানটি তৈরি করতে প্রায় একবছরেরও বেশি সময় লেগে যায়। আমি মনে করি আমরা সবাই মিলে এটির মধ্য দিয়ে পুরো পৃথিবীকে ধরতে চেয়েছি। আমরা পেরেছি কিনা জানি না, তবে বিশেষ কিছু আপনি অবশ্যই এখানে খুঁজে পাবেন।
গানটির প্রধান সংগীত পরিচালক আব্দুল্লাহ সিদ্দিকি বলেন, গানটিতে রুবাব (৫ থেকে ২১ তার বিশিষ্ট বিশেষ ধরনের বাদ্যযন্ত্র। মূলত এটি আফগানিস্তানের বাদ্যযন্ত্র হিসেবেই পরিচিত। তবে পাকিস্তান ও ভারতের বিভিন্ন এলাকায় এটি বাজানো হয়, ব্যবহারও হয়।) এর সঙ্গে তাল মিলিয়েছে রেগেটোনের রিদম। এ এক অন্যরকম খেলা। এটাকে আপনি সুপার ফিউশন বলতে পারেন।
পপ এবং লোকসংগীতের এক অনন্য মিশ্রণ ‘পাসুরি’, বৈশ্বিক তালের সঙ্গে কাব্যিক ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ। শেঠি বলেন, গানটি রেগে এবং রেগেটোনের মিশ্রণ—রাগাটোন। আমি যখন এটা নিয়ে কাজ করি তখন আমার ভালো লেগেছে। গানটি আমাদের সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে, সেই সঙ্গে কথা বলে বিশ্বসংগীতের সাথে। এটি একই সঙ্গে স্থানীয়, একই সঙ্গে বৈশ্বিক। এর শেকড় এদেশের মাটিতে প্রোথিত, যার ডালপালা ছড়িয়েছে বিশ্বময়।
গানটিকে ‘এক নতুন ও যুগান্তকারী হাইব্রিড জনরা’ আখ্যা দিয়ে আব্দুল্লাহ সিদ্দিকি বলেন, এটি কোক স্টুডিওর অন্যতম আধুনিক কাজ। গানটিতে একই সঙ্গে আছে ইলেকট্রনিক ড্রামস-সিনথেসাইজার থেকে অ্যাকুস্টিক গিটার, বাগলামা আর ম্যান্ডোলিন। দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী রাগার সঙ্গে মিশেছে টার্কিশ তারযন্ত্র, ফ্লামিনকো ক্ল্যাপস আর লাতিন রেগেটোন রিদম।
আলী শেঠি
যে কথাটি প্রথমেই বলে নেওয়া উচিত ছিল সেটি শেষে বলি। গানটির গীতিকার ও সুরকারের মতো এটি গেয়েছেনও কিন্তু আলী শেঠিই। এই পাকিস্তানি-অ্যামেরিকান মিউজিক্যাল ট্যালেন্টের জন্ম ১৯৮৪ সালে। গ্র্যাজুয়েশনের পর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেন। সেই সঙ্গে পাঠ নেন গজল, কাওয়ালি ও খেয়ালের।
লেখালেখি দিয়ে সংস্কৃতি অঙ্গনে পা রাখেন সাংবাদিক-রাজনীতিবাদ দম্পতির এই সন্তান। তার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য উইশ মেকার’ প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে। আর সংগীতে পা রাখেন ২০১২ সালে। মিরা নায়ার-এর একটি ছবিতে গান গাওয়ার মাধ্যমে তিনি এ সংগীতযাত্রা করেন। আর ২০২২ সালে কোক স্টুডিওর ‘পাসুরি’ তাকে নিয়ে যায় বিশ্বদরবারে।
শায়ে গিল
ক্যরিয়ার বলতে প্রকৃতপক্ষে কিছুই নেই শায়ে গিল এর। তিনি মূলত একজন কভার আর্টিস্ট। ‘পাসুরি’ গানের সুরকার জুলফিকার জব্বর খান তাকে আবিষ্কার করেন সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ইনস্টাগ্রামে। সেখানে তিনি (শায়ে গিল বা আনুশায়ে বব্বর গিল) নিয়মিত বিভিন্ন গানের কভার করে আপলোড দিতেন। সেখান থেকে তাকে খুঁজে বের করে সংগীতজগতের এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেন জুলফি। শায়ে একবার বলেছিলেন, তিনি (জুলফি) আমাকে ইনস্টাগ্রামে খুঁজে পান। আমার গান পছন্দ করেন এবং আমাকে মেসেজ দিয়ে বলেন, ‘আমরা আপনাকে নিয়ে কোক স্টুডিওতে কাজ করতে চাই’।
এই হলেন শায়ে গিল, যার জন্ম ১৯৯৯ সালের ২২ জানুয়ারি লাহোরের এক পাঞ্জাবি খ্রিস্টান পরিবারে। আর ‘পাসুরি’ ছাড়াতার আর কোনো অ্যাচিভমেন্টের গল্প নেই।
সীমা কিরমানি
সীমা কিরমানির পরিচয় তিনি নিজেই। পাকিস্তানের নামি শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী, পাকিস্তানে ভারতনাট্যমের রূপদানকারী, কোরিওগ্রাফার, নাট্যকর্মী, পারফরমার, পরিচালক-প্রয়োজক এবং সর্বোপরি একটি সমাজকর্মী। তিনি নারী উন্নয়ন ভিত্তিক সংগঠন তেহরিক-ই-নিশওয়ান এর প্রতিষ্ঠাতা।
‘পাসুরি’ গানের শুরুতেই যাকে নৃত্যরত ভঙ্গিতে দেখা গেছে, তিনিই সীমা কিরমানি। গানের মিউজিক ভিডিওতে একটা আলাদা ফ্লেভার দেওয়ার জন্য এই ক্লাসিক নৃত্যশিল্পকে কাস্ট করেন মিউজিক ভিডিওর পরিচালক।
সীমা এই গানে পারফরম করার বিষয়ে বলেছিলেন, আমাকে বলা হয়েছিল গান আর সুরের মাঝখানে কিছু একটা করার। আমি চেষ্টা করেছি। জানি না, আমি সফল না বিফল।
আগেই বলেছি, কোক স্টুডিওর ইতিহাসে সবচেয়ে অধিক ভিউড গান ‘পাসুরি’। প্রকাশের কদিন পরই গানটি স্পর্টিফাই ‘ভাইরাল ফিফটি’ চার্টে উঠে আসে। ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি মানুষ ‘পাসুরি’ গানটিকে খুঁজেছে, গুগলে। গুগল ট্রেন্ডস এ গানটিকে ‘ইয়ার ইন সার্চ ২০২২’ খেতাব দেয়। এটাই প্রথম পাকিসন্তানি গান যেটা ইউটিউবের ‘গ্লোবাল টপ মিউজিক ভিডিও চার্টে’ ঢুকে পড়ে এবং বেশ কিছু দিন অবস্থান করে। ২১ জানুয়ারি, ২০২৩ গানটি ৫০০ মিলিয়ন ভিউ পায়।
প্রখ্যাত সাময়িকী গার্ডিয়ান তাদের এক প্রতিবেদনে গানটি সম্পকে বলে, অনেক দিন একটি গান ভাষা ও রাষ্ট্রের সব সীমানা ভেঙে বিশ্বময় হয়ে উঠল। আসলে শিল্পের পক্ষেই এ কাজ করা সম্ভব, রাজনীতির পক্ষে এটা সম্ভব নয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।