মুফতী খলীল মাদানী : গায়েবানা জানাজা নিয়ে কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সোচ্চার। কেউ এর পক্ষে, কেউ বিপক্ষে বলছেন। সঙ্গত কারণেই ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে গায়েবানা জানাজা সম্পর্কে কী বিধান হতে পারে তা জানার আগ্রহ সৃষ্টি হতেই পারে। আসলে গায়েবানা জানাজা বিষয়টি হালফিল ঘটনা একটি।
কোনো জনপ্রিয় আলেম বা শায়েখ মারা গেলেই তার জানাজায় ভিড় হয় এবং ভিড়ের বাইরেও অনেকে গায়েবানা জানাজা পড়েন। শরিয়ত অনুযায়ী এর গ্রহণযোগ্যতা আছে কি নেই এমন আলোচনাও পছন্দ করেন না অনেকে। তারা বলছেন, এটার শরই দৃষ্টিকোণ ঘাঁটার প্রয়োজন নেই। প্রতিবাদ হিসেবে এই জানাজা পড়া হচ্ছে। কথা হচ্ছে, একটি ফরজ ইবাদতকে কি এভাবে যথেচ্ছ ব্যবহারের অবকাশ ইসলামে আছে?
জানাজার নামাজ ফরজে কেফায়া। ফরজে কেফায়া কয়েকজন আদায় করলেই সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যায়। একবার আদায় করলে দ্বিতীয়বার আদায়ের অবকাশ নেই। জানাজার নামাজের এ বিধান খুব স্পষ্ট। কারণ রাসুল (সা.) তার জীবদ্দশায় বহু সাহাবির জানাজার নামাজ পড়েছেন। জানাজা সংক্রান্ত অসংখ্য বর্ণনা হাদিসের কিতাবে রয়েছে।
গায়েবানা জানাজার সপক্ষে কেউ কেউ এই দলিল উপস্থাপন করছেন, জানাজার দোয়ার ভেতর গাইবিনা শব্দটি রয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে- হে আল্লাহ, তুমি আমাদের গায়েব ব্যক্তিকে মাফ করে দাও; বোঝা গেল, গায়েব ব্যক্তির জানাজা আদায় করা যাবে। এটা একটা হাস্যকর যুক্তি। কারণ এই দোয়া হাইয়্যিনা শব্দটিও আছে। যার অর্থ হে আল্লাহ তুমি আমাদের জীবিতদের মাফ করে দাও। এখন তাই বলে কি জীবিত কারও জানাজাও আদায় করা যাবে? জানাজার নামাজ জীবিতদের জন্য নয়, তেমনিভাবে যার লাশ সামনে নেই এমন কারও জানাজারও অবকাশ নেই।
তবে প্রিয় নবীর সিরাতে একটি ঘটনা আছে। হাবশার বাদশা নাজ্জাসির গায়েবানা জানাজা পড়েছিলেন রাসুল (সা.)। এই ঘটনা থেকেও কেউ কেউ দলিল দেয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনো একটি বর্ণনা পেয়েই তা থেকে মাসআলা বলে দেয়া যায় না। ফতোয়া দেয়ার কিছু মূলনীতি আছে। সেই মূলনীতির আলোকে ফতোয়া দিতে হবে। আপনি যদি ঘটনাটিকে তলিয়ে দেখেন, তাহলে এই ঘটনা দিয়ে প্রমাণ দেয়াটা আপনার কাছে অযৌক্তিক মনে হবে। কারণ রাসুল (সা.) কেন কেবল একজন নাজ্জাসির গায়েবানা জানাজা আদায় করলেন, আর কারও জানাজা কেন আদায় করলেন না?
মুতার যুদ্ধে হজরত জাফর তাইয়্যার শহীদ হলেন। রাসুল সা. অত্যন্ত শোকাহত ছিলেন। কিন্তু তিনি তার গায়েবানা জানাজা আদায় করেননি। একইভাবে বিরে মাউনা যুদ্ধে সত্তরজন কারি শহীদ হন। রাসুল (সা.) দীর্ঘদিন শোকাহত ছিলেন কিন্তু তাদেরও গায়েবানা জানাজা আদায় করেননি। দোয়া করেছেন। পরবতী সময়ে খুলাফায়ে রাশেদার কারও ইন্তেকালেও গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়নি।
হজরত আবু বকর (রা.), হযরত উসমান (রা.) হজরত আলী (রা.) কারও গায়েবানা জানাজা হয়নি। সাহাবি, তাবেয়ি, তাবে তাবেয়ি কারও জন্যই গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়নি। কোরআনের আয়াত ও নবীজির হাদিস বুঝতে হবে সালাফ তথা পূর্ববতী মনীষীদের ব্যাখ্যার আলোকে। দেড় হাজার বছর পর এসে নতুন কোনো ব্যাখ্যা ইসলামে গ্রহণযোগ্য হবে না। আধুনিক সময়ে ইসলামের অনেক বিষয় নিয়েই রাজনীতি করার অপচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কেউ মারা গেলে তার জন্য দোয়া করা যায় যে কোনো সময়। উত্তম আমল করে সদকা ও দান খাইরাতের মাধ্যমে ইসালে সাওয়াব করা যায়। প্রতিটি ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর বিধান জেনে সেভাবেই আমাদের আমল করা উচিত। অতিরঞ্জন না করে ভারসাম্য ধরে রাখাই ইসলামের শিক্ষা। কারও প্রতি ভক্তি বা ঘৃণা, ভালোবাসা বা দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে। প্রত্যেকে যার যার দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বিশেষ মনন লালন করে। কিন্তু আমরা ইসলামের নামে যখন কিছু করি তখন আমাদের মন মানসিকতার আলোকে ইসলামকে ব্যাখ্যা না করে কুরআন সুন্নাহর আলোকে ব্যাখ্যা দেয়াই কাম্য। নিজের নির্দিষ্ট ও গণ্ডিবদ্ধ চিন্তা চেতনা দিয়ে ইসলামকে ব্যাখ্যা করলে ইসলামের প্রশস্ততা বিনষ্ট হয়ে সংকীর্ণতা সৃষ্টি হয়। এজন্য কেবল গায়েবানা জানাজা নয়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের ভাবতে হবে। মৌলিকত্ব টিকিয়ে রেখে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ইসলামের বিকৃতি থেকে বাঁচতে হবে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আমাদের ধর্মে কোনো নতুন বিষয় সংযোজন করলো সে প্রত্যাখ্যাত। তাকে ও তার চিন্তাকে প্রত্যাখ্যান করা হবে। [বুখারি]। ইসলামের মৌলিক বিষয়াদিতে কোনো ধরনের সংযোজন বিয়োজনের অবকাশ নেই। কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন ইসলামের মাঝে কোনো বিকৃতি বা সংযোজন করতে গেলে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না।
হাবশার বাদশার গায়েবানা জানাজার ইতিহাস জানতে হবে। রাসুল (সা.) কেন তার গায়েবানা জানাজা আদায় করেছিলেন। এর কারণ খুব স্পষ্ট। হাবশায় তার জানাজা দেয়ার মতো কেউ অবশিষ্ট ছিল না। কারণ কিছু দিন আগেই হাবশার রাজ দরবারের সব নব মুসলিমদের মদিনার উদ্দেশে একটি জাহাজে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঘটনাক্রমে সেই জাহাজটি পানিতে ডুবে যায়। হাবশায় অন্য কোনো মুসলিম ছিল না। ফলে নাজ্জাসির জানাজা স্বয়ং নবীজি আদায় করেন। এ ঘটনা থেকে এ মাসআলা দেয়া যায়, যদি কারও জানাজা আদায়ের কেউ না থাকে এবং লাশ সামনে রেখে জানাজার সুযোগ না থাকে সে ক্ষেত্রে এই হাদিসের আলোকে গায়েবানা জানাজা হয়তো আদায় করা যাবে। কিন্তু এর বাইরে যা হবে তা অতিরঞ্জন বলেই গণ্য হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।