বিজ্ঞান ও প্রযক্তি ডেস্ক : বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ মানুষের জীবনের প্রতিটি দিককে স্পর্শ করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) কিংবা কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তাকে (এজিআই) তথ্য–প্রযুক্তির বিকাশের চরম অবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রযুক্তিশিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে এই প্রযুক্তি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি সাধারণত অ্যালগরিদম ও মেশিন লার্নিং সুবিধা কাজে লাগিয়ে তথ্যভান্ডার বিশ্লেষণ করে ফলাফল ও অনুমান জানিয়ে থাকে।
এআই ও এজিআই গবেষণায়, স্বাস্থ্য ও আর্থিক খাতে, শিক্ষা ব্যবস্থা বিপ্লব সূচনা করেছে। এসব খাতে এজিআইয়ের সুফল ভোগ করছে মানুষ। কিন্তু অনেকটা নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতো এআই বা এজিআইয়ের সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া নিয়ে মানুষ উদ্বিগ্ন। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি প্রযুক্তি গডফাদারেরাও এআই বা এজিআই ভবিষ্যতে মানুষের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এ প্রযুক্তি নিয়ে মানুষের উদ্বেগের বিষয়গুলো জানার আগে জেনে নেওয়া যাক এজিআই আসলে কী জিনিস।
এজিআই
এজিআই বা আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স এমন এক ধরনের যুগান্তকারী প্রযুক্তি, যা মানুষের মতোই কাজ ও চিন্তা করতে পারে। এমনকি নতুন জিনিস শিখতে পারে, কারণ এবং প্রভাবের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। সহজ কথায়, এজিআইয়ের লক্ষ্য হলো মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার অনুকরণ করা। যাতে এটি অপরিচিত কাজ করতে, নতুন অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে এবং নতুন উপায়ে এর জ্ঞান প্রয়োগ করতে পারে।
মানুষ সাধারণত চারপাশের বিভিন্ন কিছু দেখে, বই পড়ে, টেলিভিশন বা চলচ্চিত্র দেখে তথ্য সংগ্রহ করে। তথ্যগুলো মস্তিষ্কের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। এজিআইও মানুষের মতো করে সব কিছু করতে পারবে। এর গণনার ক্ষমতা বা ডেটা প্রক্রিয়াজাত করার ক্ষমতা বিস্ময়কর হওয়ার কারণে সে একই কাজ মানুষের চেয়ে আরও ভালোভাবে করতে পারবে। ভবিষ্যতে তা আরও নিখুঁত রূপ ধারণ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এআই বনাম এজিআই
এআই ও এজিআইয়ের মধ্যে সাধারণ পার্থক্য হলো, এআইয়ে ছবি শনাক্ত করা বা অনুবাদ করার মতো ছোট পরিসরের ক্ষমতা রয়েছে। অন্যদিকে এজিআই সাধারণ কোনো কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের মতো যেকোনো বিষয় নিয়ে ভাবতে বা কাজ করতে পারে।
চ্যাটজিপিটি উদ্ভাবনকারী প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) স্যাম অল্টমান ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি বলেছেন, এজিআইয়ের উন্নতিতে তাঁরা আরও শত কোটি ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছেন। অল্টমানের এ ঘোষণা সাধারণ বিবেচনায় সুসংবাদ। কিন্তু ওপেনএআইসহ অন্য প্রতিষ্ঠানের এত বিনিয়োগ প্রযুক্তিটিকে একদিন মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে হাজির করবে না তো? এমন প্রশ্ন বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
শঙ্কা কী কী
পরিবেশের ক্ষতি: এজিআই নিয়ে বিশেষজ্ঞদের যেসব উদ্বেগ রয়েছে তাদের একটি পরিবেশের ক্ষতি। কারণ রাশি রাশি তথ্য প্রক্রিয়াজাত করতে বিপুল বিদ্যুতের দরকার হয়। এত বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য দরকার পড়ে বিপুল জ্বালানির। তা ছাড়া এজিআই বর্জ্য আরেকটি নেতিবাচক বিষয়। এ দুটি বিষয় পরিবেশে বড় প্রভাব ফেলে।
বেকারত্ব: এজিআইয়ের ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মীর প্রয়োজনীয়তা কমবে। এরই মধ্যে নিয়োগ কমার পাশাপাশি বাড়ছে কর্মী ছাঁটাইয়ের হার। এটি বড় ধরনের সামাজিক বৈষম্য তৈরি করছে। তা ছাড়া এজিআইয়ের ফলে গুটিকয় কোম্পানির হাতে জিম্মি হয়ে পড়তে পারে মানুষ।
নিরাপত্তাহীনতা: এজিআই শক্তিশালী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাহীনতা বাড়তে পারে। এজিআই এখনও এ পর্যায়ে না পৌঁছালেও শিগগিরই সে স্তরে পৌঁছে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কমবে দক্ষতা: এজিআই জনপ্রিয় হওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের দক্ষতা কমতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ তখন মানুষের পক্ষ থেকে মেশিনই সব কিছু করবে। এমনকি মানুষ বুনিয়াদি দক্ষতাও হারিয়ে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
হেরে যাবে মানুষ?: এজিআইয়ের বিকাশ নিয়ে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ হলো, এ প্রযুক্তি একদিন মানুষকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। প্রযুক্তির স্বাধীন চিন্তা করার, কোনো কাজ করার ক্ষমতা মানুষের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে। অর্থাৎ এজিআইয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে মানুষ। এ প্রযুক্তিই উল্টো তখন মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করবে কিনা, তাই শঙ্কার বিষয়!
সতর্কবার্তা
২০১৪ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রয়াত বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পূর্ণ বিকাশ মনুষ্যজাতিকে মুছে দিতে পারে। এআইয়ের গডফাদারখ্যাত ইয়োশুয়া বেঙ্গিও, জিওফ্রে হিন্টন এবং ইয়ান লেকুনও বিভিন্ন সময়ে হকিংয়ের অনুরূপ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। হিন্টন তো রীতিমতো এজিআইকে পারমাণবিক হুমকির চেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দেখেছেন।
যুদ্ধাস্ত্র তৈরিসহ বিধ্বংসী কার্যক্রমে উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার মানব সভ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছেন গবেষকরা। সম্প্রতি অ্যান অ্যাকশন প্ল্যান টু ইনক্রিভ দ্য সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অব অ্যাডভান্সড এআই শীর্ষক গবেষণাপত্রে বলা হয়, আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স (এজিআই) ও অ্যাডভান্সড এআইয়ের উত্থান আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকে দুর্বল করে দিতে পারে। গবেষণাপত্রটি তৈরি করতে এক বছরের বেশি সময় ধরে দুই শতাধিক ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করা হয়। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আমেরিকা ও কানাডা সরকারের প্রতিনিধি, ক্লাউড পরিষেবা সরবরাহকারী, এআই নিরাপত্তা সংস্থা, সিকিউরিটি ও কম্পিউটিং বিশেষজ্ঞরাও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
এআইয়ের মাধ্যমে বিধ্বংসী ঘটনা ঘটার আশঙ্কা কমানোর জন্য কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের ক্ষেত্রে নীতিমালা বেঁধে দেওয়া ও এর সক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার পরামর্শ গবেষকদের। যদিও কোনো দেশ, সংস্থা বা কোম্পানি প্রোগ্রামিং নিয়ে কী করছে, তা পর্যবেক্ষণে রাখা বর্তমান পরিস্থিতিতে দুরূহ।
তথ্যসূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, বিবিসি ও সিএনএন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।