বিজ্ঞান ও প্রযক্তি ডেস্ক : এনেসথেসিয়া একটি চিকিৎসা পদ্ধতি, যাতে কোনো ব্যক্তি অপারেশনের সময় যন্ত্রণা এড়াতে সমর্থ হয়। এনেসথেসিয়ায় বিভিন্ন রকমের ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যাকে এনেসথেটিক ড্রাগ বলা হয়। এ ওষুধ সাধারণত তিন ধরনের হয়-লোকাল বা স্থানীয়, রিজিওনাল বা আঞ্চলিক এবং জেনারেল বা সাধারণ এনেসথেসিয়া। স্থানীয় ও আঞ্চলিক এনেসথেসিকস বা অনুভূতিনাশক পদার্থ ব্যবহার করা হয় শরীরের বিশেষ একটি অংশ অবশ করতে। এ সময় রোগী অপারেশন চলাকালে জেগে থাকেন। জেনারেল বা সাধারণ এনেসথেসিয়া রোগীকে অপারেশন চলাকালে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়।
* কীভাবে এটি কাজ করে
যখন জেনারেল এনেসথেসিয়া কোনো ব্যক্তিকে দেওয়া হয়, তখন মস্তিষ্ক ও শরীরে স্নায়ুর সংকেত ব্যাহত হয়। এক্ষেত্রে, ব্যক্তি সম্পূর্ণ তার আশপাশের ব্যাপারে অজ্ঞাত থাকেন। এটা মস্তিষ্ককে ব্যথার অনুভূতি বোঝার অনুমতি দেয় না। ফলে অঙ্গটি/শরীরের সেই অংশটি যেটা এনেসথেসিয়া করা হয়েছে সেটা অবশ অবস্থায় থাকে। এনেসথেসিয়া শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াকে স্থির রাখতে সাহায্য করে, যেমন- হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ এবং শরীরের স্ট্রেস হরমোন নির্গমন।
* কার এটি প্রয়োজন
এনেসথেসিয়া কোনো ব্যক্তিকে দেওয়া হয় অত্যন্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে। ব্যথার ধরনের ওপর নির্ভর করে বা কী ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে এনেসথেসিয়ার ব্যবহার পরিবর্তন হয়। এটা সাধারণত ব্যবহার করা হয় যখন ত্বক ভেদ করার মতো চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করতে হচ্ছে, যেটাতে দীর্ঘসময় লাগতে পারে, শ্বাস গ্রহণকে প্রভাবিত করতে পারে বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে প্রভাবিত করতে পারে, যেমন- হৃদযন্ত্র বা মস্তিষ্ক।
* লোকাল বা রিজিওনাল এনেসথেসিয়া
এ এনেসথেসিয়ায় ব্যক্তি জেগেই থাকেন এবং চিকিৎসক এনেসথেসিয়া প্রয়োগ করেন অপারেশনের জায়গায়, যেমন- দাঁতের চিকিৎসায় মুখের মধ্যে, শ্রোণিসংক্রান্ত ছোট অপারেশনের জন্য পিঠের নিচের দিকে, এরকমই আরও অনেকভাবে। এক্ষেত্রে যে জায়গায় এনেসথেসিয়া প্রবেশ করানো হয় শুধু সে জায়গাটাই অবশ করা হয় এবং কোনো রকম ব্যথা ছাড়াই সার্জারি বা শল্যচিকিৎসা সম্পন্ন করা হয়।
* জেনারেল এনেসথেসিয়া
সাধারণত যে ব্যক্তি এ চিকিৎসা পদ্ধতিটি গ্রহণ করেন তিনি আগেই তার এনেসথেসিস্টের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় রোগীর কোনো শারীরিক জটিলতা বা চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনো সমস্যা আছে কিনা তা নির্ণয় করা হয়। ব্যক্তির আগের রোগের ইতিহাস যাচাই করে চিকিৎসক অনেক সময় কিছু ওষুধ নিতে নিষেধ করেন, যেগুলো এনেসথেসিয়ার আগে নিলে জটিলতা দেখা দিতে পারে। এনেসথেসিয়া সাধারণত দেওয়া হয়- ইনজেকশন বা সুঁচ প্রয়োগ, ইনহেলশন বা শ্বাস গ্রহণের দ্বারা, টপিক্যাল বা সাময়িক (চামড়ায় সরাসরি ব্যবহার বা শরীরের কোনো অংশের উপরি স্তরে ব্যবহার) লোশন, স্প্রে, আই ড্রপস, স্কিন প্যাচ বা চামড়ায় দাগ দেওয়ার মাধ্যমে। এনেসথেসিয়া প্রবেশ করানোর সময় বৈদ্যুতিক যন্ত্র ব্যবহার করা হয় যা শরীরের মুখ্য পরিমাপকগুলোর ওপর, যেমন-রক্তচাপ, হৃদস্পন্দনের হার এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের হার লক্ষ্য রাখতে সহায়ক হয়।
* জেনারেল এনেসথেসিয়া কতটা নিরাপদ
এ এনেসথেসিয়া খুবই নিরাপদ। এমনকি রোগীর গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলেও কোনো সমস্যা ছাড়াই রোগী সাধারণ এনেসথেসিয়া সহ্য করতে পারবে। কিন্তু কোনো ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে, রোগী কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনুভব করতে পারেন।
* স্বল্পমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
জেনারেল এনেসথেসিয়ার বেশিভাগ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অস্ত্রোপচারের পরপরই ঘটে অর্থাৎ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। অপারেশন শেষ হওয়ার পর এবং চেতনানাশক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর রোগী ধীরে ধীরে অপারেটিং রুম বা পুনরুদ্ধার কক্ষে জেগে উঠেন। এ সময় রোগী অলস এবং একটু বিভ্রান্তবোধ করতে পারেন। নিচের এ সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলোর যে কোনো একটিও অনুভব করতে পারেন
▶ বমি ভাব এবং বমি : এ জন্য ওষুধ ব্যবহার করা যায়।
▶ শুকনো মুখ : রোগী যখন জেগে উঠবে তখন মুখ শুষ্কবোধ হতে পারে। যদি খুব বেশি বমিভাব না হয় তবে এক চুমুক পানি পান শুষ্ক মুখ থেকে মুক্তি দিতে পারে।
▶ গলাব্যথা বা কর্কশতা : অস্ত্রোপচারের সময় শ্বাস নিতে সাহায্য করার জন্য গলার নিচে একটি টিউব ঢোকানো হয় যা অপসারণের পর সাময়িক গলাব্যথা হতে পারে।
▶ ঠান্ডা এবং কাঁপুনি : জেনারেল এনেসথেসিয়ার সময় শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়। তবে ডাক্তার এবং নার্স নিশ্চিত করবেন অস্ত্রোপচারের সময় তাপমাত্রা খুব বেশি যেন না কমে, তাহলে রোগী ঠান্ডার জন্য জেগে উঠতে পারেন।
▶ বিভ্রান্তি এবং অস্পষ্ট চিন্তা : রোগী যখন প্রথম এনেসথেসিয়া থেকে জেগে উঠবেন তখন বিভ্রান্ত, তন্দ্রাচ্ছন্ন বোধ করতে পারেন। এটি সাধারণত কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হয়, তবে কিছু বয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে বিভ্রান্তি কয়েক দিন বা সপ্তাহ স্থায়ী হতে পারে।
▶ পেশি ব্যথা : অস্ত্রোপচারের সময় পেশি শিথিল করার জন্য ব্যবহৃত ওষুধগুলো পরে পেশি ব্যথার কারণ হতে পারে।
▶ চুলকানি : অস্ত্রোপচারের সময় বা পরে মাদকদ্রব্য (অপিওড) ওষুধ ব্যবহার করা হলে রোগী চুলকানি অনুভব করতে পারেন।
▶ মূত্রাশয়ের সমস্যা : জেনারেল এনেসথেসিয়ার পর অল্প সময়ের জন্য প্রস্রাব করতে অসুবিধা হতে পারে।
▶ মাথা ঘোরা : যখন প্রথম সেরে উঠবে তখন মাথা ঘোরা হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রচুর তরল পানি গ্রহণ রোগী ভালো বোধ করে।
* দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
অধিকাংশ রোগী কোনো দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনুভব করেন না। তবে বয়স্ক ব্যক্তিদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে যা কয়েক দিনের বেশি স্থায়ী হয়। এর মধ্যে থাকতে পারে-
▶ পোস্টঅপারেটিভ প্রলাপ : কিছু রোগী বিভ্রান্ত হতে পারে, দিশেহারা হয়ে যেতে পারে বা অস্ত্রোপচারের পর কোনো কিছু মনে রাখতে সমস্যা হতে পারে। এ বিভ্রান্তি সাধারণত প্রায় এক সপ্তাহ পর অদৃশ্য হয়ে যায়।
▶ পোস্টঅপারেটিভ কগনিটিভ ডিসফাংশন : কিছু রোগী অস্ত্রোপচারের পর মেমরি সমস্যা বা অন্যান্য ধরনের জ্ঞানীয় দুর্বলতা অনুভব করতে পারে। এটি এনেসথেসিয়ার কারণে হওয়ার আশঙ্কা কম। ৬০ বছরের বেশি বয়সি ব্যক্তিদের এটি হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
এনেসথেসিয়া প্রয়োগের কাজটি অত্যন্ত সুক্ষভাবে এবং দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হয়। এনেসথেটিক ড্রাগস সিলেকশন এবং ডোজ, রোগীর বয়স, ওজন ও শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োগ করতে হয়। অন্যথায় বিভিন্ন ধরণের মারাত্মক জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন-ব্লাড প্রেশার কমে যাওয়া, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন হওয়া, শ্বাসকষ্ট, এমনকি শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া, খিঁচুনি, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। শুধু অপারেশনের সময়ই নয়, অপারেশন পরবর্তী পোস্ট অপারেটিভ টাইমেও রোগীকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করতে হয় সম্পূর্ণ রিকভারি না হওয়া পর্যন্ত। কারণ এ সময়ে এনেসথেটিক ড্রাগের প্রভাবে রোগীর ব্লাড প্রেশার, জ্ঞানের লেভেল ও অক্সিজেন লেভেল কমে গিয়ে রোগীর অবস্থার অবনতি হতে পারে।
এনেসথেসিয়ার আগে নিদ্রাহীনতা, খিঁচুনি, স্থূলতা, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ফুসফুসের রোগ, কিডনির রোগ, ড্রাগ অ্যালার্জি-এসব রোগ থাকলে ডাক্তারকে জানাতে ভুলবেন না। যদি ধূমপান ও প্রচুর পরিমাণে অ্যালকোহল গ্রহণ করেন, এমনকি রক্ত পাতলা ওষুধ গ্রহণ করলেও চিকিৎসককে জানাবেন। সার্জন এবং এনেসথেসিওলজিস্টের সঙ্গে যখন কথা বলবেন, তখন উদ্বেগ এবং প্রত্যাশা নিয়ে আলোচনা করতে ভুলবেন না। কথা বলা উচিত পূর্ববর্তী অস্ত্রোপচারের অভিজ্ঞতা, স্বাস্থ্যের অবস্থা, ওষুধের ব্যবহার, বিনোদনমূলক ড্রাগ ব্যবহার করেন কিনা এসব নিয়েও। কী খেতে পারেন কিংবা পান করতে পারেন না এবং কী ওষুধ গ্রহণ করা উচিত বা কী করা উচিত নয়, এসব পূর্ব ধারণার নির্দেশাবলি অনুসরণ করতে ভুলবেন না।
লেখক : কনসালটেন্ট, আইসিইউ ও এইচডিইউ, আদ্-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাপসাতাল, ঢাকা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।