আন্তর্জাতিক ডেস্ক : আরবি ভাষায় ‘ওয়াকাফা’ শব্দটি থেকে এসেছে ‘ওয়াকফ’– যার অর্থ সম্পত্তির হাতবদল। ভারতে যখন কোনও ব্যক্তি মুসলিম আইনের আওতায় ধর্মীয় বা দাতব্য কারণে তার সম্পত্তি দান করেন, তখন সেটাকেই বলে ওয়াকফ সম্পত্তি। এর মধ্যে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, আশ্রয়কেন্দ্র বা শুধু জমি সব কিছুই থাকতে পারে।
যে কাজের জন্য সেটি দান করা হয়েছে, সেটি ছাড়া অন্য কোনও কাজে ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবহার করা যায় না, এবং এটি কাউকে বিক্রি বা হাতবদলও করা যায় না।
অন্যভাবে বললে, ভারতে হিন্দু সমাজের মধ্যে যেটাকে ‘দেবোত্তর সম্পত্তি’ বলে গণ্য করা হয়, মুসলিম সমাজে মোটামুটি তারই অনুরূপ সংস্করণ হলো ওয়াকফ।
সোমবার (৭ এপ্রিল) বিবিসির এক প্রতিবেদনে ভারতের নতুন ওয়াকফ আইনে পরিবর্তনের বিষয় সমূহ বর্ণনা করা হয়। এতে বলা হয়, ভারতের পার্লামেন্ট গত সপ্তাহে উত্তপ্ত তর্কবিতর্কের পর যে মুসলিম ওয়াকফ (সংশোধনী) বিলটি পাশ করেছে, তারপর গোটা দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা শত শত কোটি ডলার মূল্যের যাবতীয় ওয়াকফ সম্পত্তি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা হবে, তার পুরো পদ্ধতিটাই এখন বদলে যেতে চলেছে।
বিলটি নিয়ে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় গত বৃহস্পতিবার দীর্ঘ বিতর্ক ও ভোটাভুটি গড়িয়েছে মাঝরাত পর্যন্ত। প্রধান বিরোধী দলগুলো বিলটির বিরোধিতায় একজোট হয়েও এর পাস হওয়া ঠেকাতে পারেনি, পরদিন (শুক্রবার) রাজ্যসভাতেও অনায়াসেই উতরে গেছে সরকারের আনা এই বিল।
এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু কার্যত রেকর্ড সময়ের মধ্যে শনিবার বিলটিতে তার সম্মতি দিয়ে দিয়েছেন, যার ফলে এটি এখন ভারতের একটি আইনে পরিণত হয়েছে। তবে ইতোমধ্যে এই বিলটিকে চ্যালেঞ্জ করে অন্তত চারটি পিটিশন সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা হয়েছে, যেগুলো করেছেন এআইএমআইএম, কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি বা আরজেডি এর মতো দলের নেতারা এবং অন্তত একটি সিভিল রাইটস গোষ্ঠী।
তারা প্রত্যেকেই দাবি করছেন, এই বিলটি চূড়ান্ত অসাংবিধানিক এবং দেশের সংখ্যালঘু নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করছে। এখন সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে কী অবস্থান নেয় এবং মামলাগুলো শুনানির জন্য গ্রহণ করে কি না, সেটাই দেখার।
‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড’-সহ ভারতের মুসলিম সমাজের অসংখ্য সংগঠনও ঠিক একই যুক্তিতে বিলটির তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। কিন্তু সরকার পাল্টা যুক্তি দিচ্ছে, দেশে মুসলিমদের ওয়াকফ সম্পত্তির পরিচালনা পদ্ধতিকে স্বচ্ছ্ব ও দুর্নীতিমুক্ত করে তুলতেই এই আইনটি প্রণয়ন করা দরকার ছিল।
এখন নতুন এই বিতর্কিত আইনটিকে নিয়ে সরকার ও বিরোধীপক্ষ ঠিক কী বলছে, এই আইনে ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনায় ঠিক কী ধরনের পরিবর্তন আসবে এবং ভারতের বাইরে বাংলাদেশেও এই আইনটি কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে- এই প্রতিবেদনে নজর দেওয়া হয়েছে সে দিকেই।
প্রধানমন্ত্রী মোদী বনাম খাড়্গে, ওয়াইসি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ওয়াকফ বিল পাস হওয়ার ঘটনাটিকে দেশের জন্য ‘ওয়াটারশেড মোমেন্ট’ বা এক পালাবদলের মুহূর্ত বলে বর্ণনা করেছেন।
নিজস্ব এক্স হ্যান্ডলে তিনি পোস্ট করেন, যে পদ্ধতিতে এতকাল ওয়াকফ বা মুসলিম সম্পত্তিগুলো পরিচালনা করা হত, সেই ‘ওয়াকফ সিস্টেমটাই দশকের পর দশক ধরে স্বচ্ছ্বতা আর জবাবদিহিতার অভাবের সমার্থক হয়ে উঠেছিল!’
তিনি লিখেছেন, ‘পার্লামেন্টে যে আইনটি এখন পাস হলো তাতে (এই পদ্ধতির) স্বচ্ছ্বতাই শুধু বাড়বে না, নাগরিকদের অধিকারও সুরক্ষিত হবে।’
তবে এই বিলটির নিন্দায় বিরোধী শিবির ‘ইন্ডিয়া’ জোট শুধু এককাট্টাই ছিল না, পার্লামেন্টেও প্রায় সব বিরোধী দলই এই বিলটির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। তারা এই বিলটিকে বর্ণনা করেছে সংখ্যালঘুদের অধিকার খর্ব করার জন্য শাসক দল বিজেপির আর একটি প্রচেষ্টা হিসেবে।
প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গেও মনে করিয়ে দিয়েছেন, লোকসভায় ভোটাভুটির সময় বিলটির পক্ষে যেখানে ২৮৮টি ভোট পড়েছে, সেখানে বিপক্ষেও কিন্তু ২৩২টি ভোট পড়েছে- সুতরাং পার্লামেন্টারিয়ানদের একটা বড় অংশই বিলটির তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তিনি এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘এটা থেকেই আমরা বুঝতে পারি বিভিন্ন বিরোধী দলের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও এই বিলটি আসলে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
এই বিলটির আগাগোড়া সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিলেন অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের সভাপতি তথা হায়দ্রাবাদের এমপি আসাদউদ্দিন ওয়াইসি, যিনি এখন আইনটির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টেরও শরণাপন্ন হয়েছেন। পার্লামেন্টে ও পার্লামেন্টের বাইরে তিনি যুক্তি দিয়েছেন, এই বিলটির আসল উদ্দেশ্য মোটেও সংস্কার নয়, বরং সংসদের গরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করে মুসলিমদের অধিকারকে ছিনিয়ে নেওয়া।
তিনি বলেন, কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরের ওয়াকফ বোর্ডগুলোতে গরিষ্ঠ সংখ্যক সদস্য যাতে অমুসলিম হতে পারেন, সেই পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে এই বিল। এখন একই জিনিস কিন্তু আপনি হিন্দু বা জৈন এনডাওমেন্ট বোর্ডে অথবা শিখদের গুরুদোয়ারা প্রবন্ধক কমিটিতে করতে পারছেন না- ফলে এই গোটা পদক্ষেপটাই অসাংবিধানিক ও মুসলিমবিরোধী।
দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বিলটি নিয়ে পার্লামেন্টকে বিভ্রান্ত করেছেন বলেও অভিযোগ তোলেন তিনি।
ওয়াকফ বিলটি আনা কোন প্রেক্ষাপটে?
ইসলামী পরম্পরা অনুসারে যখন কোনও মুসলিম ব্যক্তি সমাজের উপকারের স্বার্থে ধর্মীয় বা দাতব্য কারণে তার সম্পত্তি আল্লাহ্-র নামে দান করেন, সেটাকে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে চিহ্নিত করা হয়।
ভারতে বসবাসকারী প্রায় ২০ কোটি মুসলিমের জন্য এই ওয়াকফ সম্পত্তির গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ এগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা বা কবরস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভারতে রয়েছে বিপুল পরিমাণ ওয়াকফ সম্পত্তি- যার বাজার মূল্য শত শত কোটি ডলারের সমপরিমাণ বলে ধারণা করা হয়।
এই সব সম্পত্তি নিয়ন্ত্রিত হত ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ অ্যাক্ট অনুসারে, যাতে প্রতিটি রাজ্য স্তরে এই সম্পত্তিগুলোর পরিচালনার জন্য ওয়াকফ বোর্ড গঠনের কথা বলা আছে। এই বোর্ডগুলোতে থাকেন সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের মনোনীত প্রার্থীরা, মুসলিম আইনপ্রণেতারা (এমপি বা এমএলএ), স্টেট বার কাউন্সিলের সদস্যরা এবং ওয়াকফ সম্পত্তির ম্যানেজার বা পরিচালকরা।
গত বছরের অগাস্ট মাসে এই ওয়াকফ আইনটি সংশোধন করার জন্য বিজেপি জোট সরকার পার্লামেন্টে একটি বিল আনে। সরকারের তখন বক্তব্য ছিল, ওয়াকফ প্রশাসনের আধুনিকীকরণ নিশ্চিত করতে এবং এই পদ্ধতির ‘আইনি ফাঁকফোকরগুলো’ বন্ধ করতেই এই বিলটির প্রস্তাবনা। কিন্তু ভারতের মুসলিম নেতারা ও বিরোধী দলগুলো তখন থেকেই বলে আসছে, মুসলিমদের সম্পত্তির ওপর সরকার যাতে আরও বেশি ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে পারে একমাত্র সেই কারণেই এই সংশোধনীগুলো আনা হয়েছে।
এরপর বিলটিকে আরও যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিলটিতে সামান্য কিছু পরিবর্তন করে সেই কমিটি ছাড়পত্র দেওয়ার পর চলতি মাসে সেটি সভায় পেশ করা হয়।
নতুন আইনে কী কী সংশোধনী আনা হল?
নতুন ওয়াকফ আইনে সম্ভবত সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো কোনটাকে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে চিহ্নিত করা হবে, সেই সংজ্ঞাটাই পাল্টে দেওয়া!
ঐতিহাসিকভাবে ভারতে বহু ভবন ও জমিজমা এতকাল আইনগতভাবে বৈধ ওয়াকফ সম্পত্তি বলে স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে, যেগুলো হয়তো শুধু মুখের কথায় (ওরাল ডিক্লারেশন) বা সামাজিক রীতিনীতি মেনে দান করা হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু সেগুলো বহুদিন ধরে একটানা মুসলিম সমাজ ব্যবহার করে আসছে, তাই তাদের ওয়াকফ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে অসুবিধা হয়নি।
এখন নতুন আইনে বলা হয়েছে কোনও সম্পত্তিকে ওয়াকফ বলে দাবি করতে হলে সংশ্লিষ্ট ওয়াকফ বোর্ডকে তার স্বপক্ষে বৈধ নথিপত্র জমা দিতে হবে।
বিতর্কিত কেসগুলোতে- বিশেষ করে সেই জমিটা যদি সরকারি মালিকানাধীন ‘খাস জমি’ বলে দাবি থাকে- সেখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সরকারের ওপরেই ন্যস্ত থাকবে।
দ্বিতীয়ত, নতুন আইনে মুসলিম নন, এমন ব্যক্তিরাও ওয়াকফ বোর্ড ও ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হতে পারবেন।
তৃতীয়ত, এতদিন ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে কোনও বিতর্কের ক্ষেত্রে ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। কিন্তু নতুন আইনে বিচারবিভাগীয় হস্তক্ষেপেরও সুযোগ রাখা হয়েছে- যার অর্থ যেকোন পক্ষ চাইলে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন।
এছাড়া নতুন আইনে দেশের সব ওয়াকফ সম্পত্তির জন্য একটি ‘সেন্ট্রালাইজড রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম’ গঠনেরও প্রস্তাব করা হয়েছে- আইনটি বলবৎ হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে সব বিদ্যমান ওয়াকফ সম্পত্তিকে ওই রেজিস্টারে নথিভুক্ত করাতে হবে। নতুন করে কোনও সম্পত্তিকে যদি ওয়াকফ হিসেবে নথিভুক্ত করাতে হয়, তাহলে সেটার জন্য আবেদনও এই সিস্টেমের মাধ্যমেই সংশ্লিষ্ট ওয়াকফ বোর্ডের কাছে পেশ করতে হবে।
কোনও ওয়াকফ সম্পত্তির সার্ভে বা সমীক্ষা করানোর দরকার হলে তাতেও সরকারের ভূমিকা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি থাকবে, বস্তুত তারা এ ক্ষেত্রে ওয়াকফ বোর্ডের চেয়েও বেশি ক্ষমতাশালী হবে। সূত্র : চ্যানেল আই
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।