স্পোর্টস ডেস্ক : ১৬ বছর ধরে আন্তর্জাতিক খেলা না হলেও বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামকে দেশের সেরা উইকেট হিসেবে প্রশংসা করে গেছেন তারকাখ্যাত ক্রিকেটাররা। ক্লাইভ লয়েড থেকে শুরু করে পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক ওয়াসিম আকরামসহ দেশি-বিদেশী বহু বিখ্যাত ক্রিকেটাররা এই উইকেটের প্রশংসা করেছেন। অথচ এই ভেন্যু প্রত্যাহার করে নেওয়ায় সেরা উইকেট হিসেবে পরিচিত চান্দু স্টেডিয়ামের পিচ নিয়ে চিন্তিত নবীন খেলোয়াড়রা।
এই মাঠে আগে থেকেই ভালো মানের পাঁচটি উইকেট (পিচ) রয়েছে। এখন এসব দেখভাল করার টাকা কে দেবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বগুড়ার ছেলে ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম ২০২০ সালের আগস্টে শ্রীলঙ্কা সফরকে সামনে রেখে বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাসে পা রেখেছিলেন ব্যক্তিগত অনুশীলনে ঘাম ঝরাতে। টানা দুই ঘণ্টা অনুশীলন শেষে নিজের ভেন্যু হিসেবে পরিচিত শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম নিয়ে ফেসবুকে আবেগঘন এক স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন।
সেখানে মুশফিক লিখেছিলেন, শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম দেশের সেরা টার্ফ উইকেট। শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে নিয়মিত অনুশীলন করেন জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের রিতু মনি, খাদিজাতুল কুবরা, শারমিন সুলতানা, জাতীয় দলের শফিউল ইসলাম, তৌহিদ হৃদয় এবং অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিশ্বকাপজয়ী তানজিদ তামিম।
মুশফিকুর রহিমের দেশসেরা সেই টার্ফ উইকেটের মাঠ শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম এখন ভালো নেই। এ মাঠ থেকে বিসিবি ক্রিকেট ভেন্যু বাতিল এবং জনবল প্রত্যাহারের ১০দিন না যেতেই মাঠটি বেহাল হয়ে পড়েছে। পরিচর্যা না থাকায় নষ্ট হতে চলেছে উইকেট।
স্থানীয় ক্রিকেটার ফজলে রাব্বী বলেন, এখনই উইকেট ফেটে উঠছে। পানি দিতে হবে, রোলিং করতে হবে, কিন্তু রোলারসহ সব কিছু নিয়ে গেছে। বিসিবি যে হঠাৎ কি করল, কিছুই বুঝতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, এই উইকেট বাংলাদেশে একটাই। উইকেট নষ্ট হলে আবার বানানো অনেক কষ্টকর। হয়তো আর সম্ভব হবে না, কিন্তু এটা সত্যি আমাদের মতো নতুন খেলোয়াড়দের জন্য অনেক বড় সমস্যা।’
মাঠে যে প্রিমিয়ার লিগ খেলা নিয়ে বিসিবির সঙ্গে জেলা ক্রীড়া সংস্থার বিরোধ প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে, সেই প্রিমিয়ার লিগ খেলতে আসা নবীন ক্রিকেটাররা মাঠের দশা দেখে হতাশ। নবীন খেলোয়াড়দের ভাষ্য, পরিচর্যার অভাবে দেশসেরা পিচ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে শুধু মাঠ থাকবে, কিন্তু সেখানে ক্রিকেট অনুশীলন সম্ভব হবে না।
শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে প্রিমিয়ার লিগে মঙ্গলবার মখোমুখি হয়েছিল জাতীয় দলের ক্রিকেটার শফিউল ইসলামের নিউ মুন স্টার ক্লাব ও সূত্রাপুর স্পোর্টিং ক্লাব। শফিউল বলেন, সব ক্রিকেটারই বলেন, শহীদ চান্দুর মতো স্টেডিয়াম আর নেই। এ মাঠে সব খেলোয়াড় খেলতে চান। আমি চাই মাঠে খেলা হোক, বগুড়ায় আগে যে রকম পরিবেশ ছিল, তা ফিরে আসুক। তাহলে বগুড়া থেকে আরও ভালো ক্রিকেটার তৈরি হবে। স্টেডিয়াম থাকলে নতুনদের মনে সাহস আসে। ভালো ভালো খেলোয়াড় যখন আসে, তাদের খেলা দেখে নতুনরা অনুপ্রাণিত হয়।
নিউ মুন স্টারের নবীন ক্রিকেটার রাফিউল ইসলাম বলেন, স্টেডিয়াম থেকে বিসিবি তাদের জনবল প্রত্যাহার করেছে। মাঠ পরিচর্যার আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম বগুড়া থেকে সব ঢাকায় নিয়ে গেছে। এখন মাঠ পরিচর্যার লোক নেই। এ মাঠের উইকেট দেশসেরা। অথচ পরিচর্যার অভাবে মাত্র দু’সপ্তাহে সেটি নষ্ট হওয়ার পথে। কয়েক দিন আগে প্রিমিয়ার লিগ শুরুর দিকে এ মাঠে ৫০ ওভারে ৩০০ রান তুলেছেন খেলোয়াড়েরা। এখন ৫০ ওভারে ১৫০ রান তুলতে হিমশিম অবস্থা।
আন্তর্জাতিক ভেন্যু ঘোষণার পর থেকেই বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে এসেছেন বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটাররা। তারা এই উইকেট দেখে প্রশংসা করে গেছেন এবং স্টেডিয়ামে রাখা স্মারক বইয়ে মন্তব্য লিখে গেছেন। চান্দু স্টেডিয়ামের সেই স্মারক বইয়ের পাতায় দেখা যায়, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দুবার বিশ্বকাপ জেতানো অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড থেকে শুরু করে পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক ওয়াসিম আকরাম, শ্রীলঙ্কার সাবেক অধিনায়ক মাহেলা জয়াবর্ধনে, কুমার সাঙ্গাকারা, নিউজিল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার স্কট স্টাইরিস, ইংল্যান্ডের ক্রিকেটার রবি বোপারা, আফগানিস্তানের ক্রিকেটার মোহাম্মদ নবী, জিম্বাবুয়ের সাবেক অধিনায়ক ব্রেন্ডন টেইলরের মতো তারকা ক্রিকেটাররা শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের প্রশংসায় ভেসেছেন।
স্মারক বইয়ে মন্তব্য আছে বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান, মিনহাজুল আবেদীন, হাবিবুল বাশার, খালেদ মাসুদদেরও। শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের প্রশংসা করতে ভুল করেননি মাশরাফি বিন মর্তুজা, মোহাম্মদ আশরাফুল, মুশফিকুর রহিম, মমিনুল হক কিংবা নারী ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক জাহানারা আলমের মতো তারকা ক্রিকেটাররাও।
পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক ও কিংবদন্তী বোলার ওয়াসিম আকরাম বগুড়ার এই স্টেডিয়ামকে ‘বিউটিফুল গ্রাউন্ড’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। ভারতের সাবেক কোচ ও ধারাভাষ্যকার রবি শাস্ত্রি লিখেছেন, ‘চমৎকার মাঠ, সঙ্গে সেরা পিচ ও উইকেট।’
শ্রীলঙ্কার সাবেক অধিনায়ক মাহেলা জয়াবর্ধনে এ মাঠ নিয়ে মন্তব্য লিখেছেন, ‘বর্তমান সময়ের সুযোগ–সুবিধাসম্পন্ন দারুণ এক মাঠ। আশা করি, দীর্ঘদিন এই মাঠ আন্তর্জাতিক ভেন্যু হিসেবে থাকবে।’
শুধু বিদেশি ক্রিকেটার নয়, বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের কাছেও নান্দনিক ভেন্যু শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান এই ভেন্যুকে নিয়ে ২০১৪ সালে তার অনুভূতি লিখেছিলেন, ‘এই মাঠের সঙ্গে আমার অনেক অনুভূতি জড়িয়ে আছে।
২০১৩ সালে বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক মিনহাজুল আবেদীন লেখেন, ‘খুবই চমৎকার মাঠ। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, আমার ক্যারিয়ারে আমি এই মাঠে খেলার সুযোগ পাইনি।
২০১৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার মন্তব্য লেখেন, ‘খুব সম্ভবত এটা বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্বোধ্য উইকেটগুলোর মধ্যে একটি। বাংলাদেশ দলের আরেক সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাহমুদও এই ভেন্যুতে খেলতে এসে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। তার মন্তব্য ছিল, ‘আমার জীবনে খেলার সুযোগ হওয়া সেরা মাঠগুলোর একটি হলো বগুড়ার এই মাঠ। আমি বিশ্বাস করি, এটা অন্যতম সেরা ভেন্যু।
বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বলেন, জাতীয় নারী দলের ক্রিকেটার রিতু মণি প্রতিদিন সকালবেলা প্রায় ২৫ কিলোমিটার পথ সাইকেল ও স্কুটি চালিয়ে সারিয়াকান্দি থেকে শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে এসে অনুশীলন করে তারকা হয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, শারমিন সুলতানা অনুশীলনের জন্য এখনো গাবতলী থেকে এখানে এসে নিয়মিত অনুশীলন করেন। এ স্টেডিয়াম অনুশীলন করেই আজকের তৌহিদ হৃদয় ও তানজিদ তামিম। অনূর্ধ্ব- ১৯ বিশ্বকাপে দেশের জন্য জয়ের শিরোপা এনেছে। শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের কারণেই বগুড়া ক্রিকেটে এত সাফল্য অর্জন করেছে। দেশের স্বার্থে, ক্রিকেটের স্বার্থেই যেকোনো মূল্যে বিসিবির সঙ্গে জেলা ক্রীড়া সংস্থার ঝামেলা মিটমাট করে ফেলা দরকার। চান্দু স্টেডিয়ামের উইকেট ঠিক রাখতে মাসে কমপক্ষে ৪০ হাজার টাকা প্রয়োজন। এত টাকা কোথা থেকে আসবে।
বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সঙ্গে বিরোধের জেরে ২ মার্চ শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম থেকে মালামাল, জনবল প্রত্যাহারসহ ভেন্যু বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে স্টেডিয়ামের মূল মালিক জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) কাছে স্টেডিয়ামটি হস্তান্তরের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে চিঠি দেয় বিসিবি।
এনএসসি সচিব বরাবর পাঠানো বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। ওই দিনই শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে কর্মরত বিসিবির ১৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বগুড়া থেকে প্রত্যাহার করে মিরপুরে বিসিবির কার্যালয়ে রিপোর্ট করতে বলা হয়। স্টেডিয়ামে থাকা রোলার, সুপার সপার, পিচ কাভারসহ মাঠ ও খেলার যাবতীয় সরঞ্জাম এবং ড্রেসিংরুমের আসবাবপত্রও ঢাকায় নিয়ে গেছে বিসিবি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।