জুমবাংলা ডেস্ক : বর্তমানে বিশ্বের ১৭৬টি দেশে ১ কোটি ৪৯ লাখের বেশি কর্মী কর্মরত আছেন বলে গত ৫ জুলাই জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তরে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ গত সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে জানান, কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে যাওয়া বাংলাদেশিদের সংখ্যা ১ কোটি ৫৫ লাখ ১৩ হাজার।
সম্প্রতি জনশুমারির তথ্য তুলে ধরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান (বিবিএস) ব্যুরো জানিয়েছে, ‘বিদেশে অবস্থানরত’ প্রবাসীর সংখ্যা ৫০ লাখ। বিবিএস প্রকাশিত জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ এর ন্যাশনাল রিপোর্টে এই তথ্য দেওয়া হয়। কাজেই প্রবাসী কর্মীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জানার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখা যায়, বিদেশে বর্তমানে কতজন বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মী আছেন এই তথ্য নেই কারও কাছেই।
বিদেশে কেউ যান স্থায়ীভাবে বসবাস করতে, কেউ উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে, আবার কেউ কাজ নিয়ে। এর মধ্যে কাজ নিয়ে অনেকেই গেছেন সরাসরি; আবার অনেকেই গেছেন কাজ খোঁজার উদ্দেশ্যে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ছাড়পত্র নিয়ে। ১৯৭৬ সাল থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিএমইটি ছাড়পত্র নেওয়া কর্মীর সংখ্যা ১ কোটি ৫৮ লাখ ৬৯ হাজার ৮৭৭ জন। একজন কর্মীর বিদেশে কাজের চুক্তি থাকে দুই থেকে তিন বছর। চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে তাকে দেশে ফিরে এসে আবার আবেদন করতে হয়। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে অনেক কর্মী ফেরত এসেছেন, আবার অনেকে কাজের উদ্দেশ্যে গেছেন। আবার একই ব্যাক্তি কর্মজীবনে তিন থেকে চারটি দেশেও গেছেন কাজের উদ্দেশ্যে, তাকেও একাধিকবার গণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ একই ব্যক্তি বারবার গণনার মধ্যে পড়ছেন।
বছরভিত্তিক ফেরত আসা কর্মীর তথ্য কারও কাছে থাকে না। তাই প্রকৃত অবস্থানরত কর্মীর সংখ্যা গন্তব্য দেশ ছাড়া কারও কাছে নেই।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি রিসার্চ মুভমেন্ট ইউনিট (রামরু) তাদের ২০১৯ সালের শ্রমবাজার বিষয়ক প্রতিবেদনে বলেছিল, ১৯৭৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ১ কোটি ২৮ লাখ কর্মী কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে অভিবাসন করেছে। অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে বর্তমানে ১ কোটি ২৮ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে কর্মরত আছেন। বাংলাদেশি অভিবাসীরা মূলত স্বল্পমেয়াদী চুক্তিভিত্তিক কর্মী, চুক্তি শেষে তাদের দেশে ফিরে আসতে হয়। বাংলাদেশে ফিরে আসা অভিবাসীদের তথ্য সংরক্ষণের কোনও প্রক্রিয়া নেই। ফলে বর্তমানে মোট কত জন কর্মী বিদেশে অবস্থান করছেন তাও জানার কোনও উপায় নেই।
তাছাড়া রামরু আরও জানায়, সর্বমোট অভিবাসনের দেশের সংখ্যা ১৭৩ হলেও ৯৫ ভাগ অভিবাসী মূলত ১৪ থেকে ১৫টি দেশেই অভিবাসিত হন। বাকি দেশগুলোতে সামান্য কিছু কর্মী গিয়ে থাকেন।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কাছে করোনা মহামারির সময় ফেরত আসা কর্মীর সংখ্যা আছে। সেটি প্রায় পাঁচ লাখ। সেই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে করোনায় কাজ হারিয়ে বিদেশ ফেরত কর্মীদের সহায়তা করার প্রকল্প চালু করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন জানিয়েছেন, বিদেশে এই মুহূর্তে কতজন কর্মী আছেন এই তথ্য আমাদের কাছে নেই।
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, এই বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১২ লাখ ১০ হাজার ২৫৬ জন কর্মী বিদেশে গেছেন বিএমইটি ক্লিয়ারেন্স নিয়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গেছেন সৌদি আরবে, এরপর মালয়েশিয়ায়। এ বছর প্রতি মাসে গড়ে এক লাখের বেশি কর্মী গেছেন বিদেশে।
সম্প্রতি ওমান সরকার বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা দেওয়া বন্ধ করেছে। ওমান সরকার জানায়, সেদেশে বর্তমানে বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ। আর বিএমইটির তথ্য বলছে, ১৯৭৬ সাল থেকে গত নভেম্বর পর্যন্ত ওমানে গিয়েছেন ১৮ লাখ ৮২ হাজার কর্মী।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের কর্মকর্তারা জানান, বিমানবন্দর দিয়ে প্রতিদিনই চাকরি হারিয়ে বিদেশ থেকে ফেরত আসছেন কর্মীরা। এর মধ্যে কেউ কেউ ডিপোর্ট হয়ে ফিরে আসেন। তাদের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে ফেরত পাঠানো হয়। সেজন্য সেই সংখ্যাটা আমাদের জানা থাকে। আবার প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকে ফেরত আসেন নিজ উদ্যোগে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিদেশে অবস্থানরত কর্মীর সংখ্যা বলা হয়েছে ৫০ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫৮ জন। এই সংখ্যা শুমারিকালের আগের ছয় মাসের তথ্য। আবার যারা শুমারির আগের দুই বছর অর্থাৎ ২০২০-২০২১ সালে দেশে স্থায়ীভাবে ফেরত এসেছেন তাদের সংখ্যা ৪৬ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬৬ জন বলে জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রবাসীদের তথ্যের গড়মিল প্রসঙ্গে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম সচিব ড. দিপংকর রায় জানান, যারা ছয় মাসের বেশি সময়ের জন্য বিদেশে গেছেন তাদেরই কেবল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ শুমারি চলাকালে দেশের ৫০ লাখ ৫৩ হাজার লোক দেশের বাইরে ছিলেন। কিন্তু যারা এ সময়ে ছুটি নিয়ে দেশে এসেছেন তারা প্রবাসী হিসেবে গণ্য হননি। তাদের খানার সদস্য হিসেবেই ধরা হয়েছে। আবার যারা পরিবারসহ বিদেশে স্থায়ী হয়েছেন তারাও শুমারির সংজ্ঞার কারণে হিসাবে আসেননি। কারণ শুমারি হয় খানাভিত্তিক। খানা না থাকলে সে হিসাব আসার সুযোগ নেই।
বিএমইটি বা অন্য সংস্থাগুলোর তথ্যের বিষয়ে ড. দিপংকর রায় বলেন, তাদের পরিসংখ্যানে প্রবাসীদের ফিরে আসার তথ্য থাকে না। তাই তাদের পরিসংখ্যানের সঙ্গে এটা তুলনীয় নয়। কারণ তারা মোট গমনকারী যোগ করে হিসাব করে থাকে। এটাকে পিরিয়ড অব টাইম বলা হলেও আমরা করেছি পয়েন্ট অব টাইম। অর্থাৎ শুমারিকালীন যারা বিদেশে ছিলেন শুধু তারাই এ হিসাবে এসেছেন।
প্রতিবেদন প্রকাশের পর অবশ্য প্রবাসীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় তৈরি হওয়ায় বিষয়টি বিবিএসের সঙ্গে বসে পরিষ্কার করবেন বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। গত ২৮ নভেম্বর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবন মিলনায়তনে জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, এখানে কিছু প্রশ্ন উঠেছে, বিষয়টি আমি ফলো করব।
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, কত লোক বিদেশ গেছে– সে বিষয়ে বিএমইটি থেকে যে তথ্য দেওয়া হয় সেটা ভুল। কারণ একই কর্মী যিনি হয়তো প্রথমে ওমানে গেছেন তারপর আবার সৌদি আরব গেছেন, তাকে কিন্তু দুই বার গণনায় ধরা হয়। অনেক প্রবাসী আছেন যারা তিন-চারটি দেশে গেছেন কাজের উদ্দেশ্যে। যার কারণে আমাদের জনশুমারির তথ্য , বিএমইটির তথ্যের সঙ্গে কোনও মিল নাই। এর প্রধান কারণ বিদেশগামী কর্মীর সঠিক সংখ্যা আমরা জানি না। একইভাবে ফেরত আসা কর্মীর সংখ্যা আমরা জানি না। আমরা শুধু গেলে সেটা কাউন্ট করছি। সঠিক তথ্য না জানলে আসলে বলা যাবে না বিদেশে আমাদের কর্মী কতজন আছে। এতে করে রেমিট্যান্সের হিসাব বলি আর যেকোনও হিসাবই বলি সেটার সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারবো না।
তিনি আরও বলেন, এখনকার যুগে এই তথ্য জোগাড় করা কোনও বিষয় না। ই-পাসপোর্ট , মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের পর এই কাজ খুব কঠিন হওয়ার না। আমাদের কিন্তু এরকন্ম কোনও না কোনও কৌশল বের করতে হবে। সঠিক তথ্য না জানলে কোনও সিদ্ধান্ত ঠিকভাবে নেওয়া যাবে না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।