লাইফস্টাইল ডেস্ক : শুরুতে একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো।
আপনি কে?
এই প্রশ্ন শুনলে বা পড়লেই কি মনে পড়ে যায় যে, আপনি একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সরকারি বা বেসরকারি চাকরিজীবী, উদ্যোক্তা কিংবা ব্যবসায়ী? নিজের পেশা ছাড়া আর অন্য কোনো কিছুই আপনার মাথায় আসে না? অন্য কোনো পরিচয়?
যদি না আসে, তাহলে বিষয়টি বড়ই চিন্তার। এর অর্থ হলো—আপনি জীবনে পেশা বা অর্থ উপার্জনকারী কাজ ছাড়া কিছুই বোঝেন না। উহাই আপনার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। এমনকি নিজের মানসিক পরিচয়টিও আপনি পেশা দিয়েই সংজ্ঞায়িত করছেন।
এ ধরনের মানসিক অবস্থাকে উন্নত বিশ্বে ‘ওয়ার্কইজম’ নামে অভিহিত করা হয়। মূলত আমেরিকাতেই এই শব্দের প্রচলন বেশি। ওয়ার্কইজম হচ্ছে এমন একটি ধারণা, যাতে বিশ্বাস করা হয়—পেশা বা পেশাগত কাজ শুধু অর্থ উপার্জনের জন্যই প্রয়োজনীয় নয়। বরং একজন ব্যক্তির সামগ্রিক পরিচয় এবং জীবনের মূল উদ্দেশ্যও নির্ধারণ করে এটি। সেই সঙ্গে এই বিষয়টিও বলে যে, মানবসভ্যতার কল্যাণের নিমিত্তেই কাজের কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র ‘অর্থবোধক’ কাজই পারে আপনার জীবনকে সফল করতে, আর কিছু নয়।
এসবের মূল মাজেজা হলো, আপনি জীবনে কাজ ছাড়া আর কিছু বুঝবেন না। আমেরিকাতে এবং কিছু ক্ষেত্রে ইউরোপে যেমন এই ওয়ার্কইজমকে মূলত পেশার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আর এই বিষয়টিকে এতবার ব্যক্তি মানুষের কানে কানে এবং উচ্চস্বরে বলা হয় যে, এতে বিশ্বাস স্থাপনে বাধ্য হতে শুরু করে মানুষ। ধরুন, আপনাকে বারবার যদি কেউ কানের কাছে এসে একই কথা বলতে থাকে, তবে কিন্তু একসময় আপনিও তাতে বিশ্বাস রাখতে শুরু করতে পারেন অবচেতনে। ওয়ার্কইজমের ফাঁদ হলো, আপনি এতে মজে গেলে একসময় ভাবতে থাকবেন, কাজ, পেশা বা চাকরিই আপনার জীবনের সব। অফিস বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে আপনার বাসায় যাওয়াটাই তখন হয়ে দাঁড়ায় সময় নষ্ট। ব্যক্তিগত জীবনের জায়গা নিয়ে নেয় পেশাগত জীবন। সেটিই তখন হয়ে দাঁড়ায় জীবনের জ্বালানি। একজন ব্যক্তি তখন বেশি প্রাধান্যও দেয় কাজকেই, পরিবার বা ব্যক্তিজীবন হয়ে যায় গৌন।
ওয়ার্কইজমে দিনের ২৪ ঘণ্টাই আমরা কাজ নিয়েই চলি। অর্থাৎ, কাজই (সেটা পেশাও হতে পারে) হয়ে দাঁড়ায় একজন ব্যক্তির সারা দিনের রুটিনের ভরকেন্দ্র। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তিরও ভূমিকা আছে। মোবাইল ফোন, বিশেষ করে স্মার্টফোন আমাদের ব্যক্তি ও কর্মজীবনকে একে-অপরের সাথে একেবারে মিশিয়ে ফেলেছে। স্মার্টফোনের বদৌলতে এখন অফিসের পাশাপাশি বাসাতেও অফিস করতে হয় অনেককে! কারণ কর্মসংক্রান্ত ই–মেইল, ফোন কল, মিটিংয়ে উপস্থিত হওয়ার অনুরোধ বা হোয়্যাটসঅ্যাপ-মেসেঞ্জারে কর্মসম্পর্কিত বার্তার অবিরত বর্ষণে মাঝে মাঝে বোঝাই যায় না যে, বাসায় নিজের বিছানায় শুয়ে আছেন, নাকি অফিসের ডেস্কে বসে! এসবের কারণে আনুষ্ঠানিক কাজ থেকে নিজেকে বিযুক্ত করা এখন ঢের কঠিন। আর এভাবেই আমাদের মনে ঢুকে যায়, পানির অপর নাম নয়, বরং কাজের অপর নামই জীবন।
অবশ্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বরাবরই ব্যক্তি ও পেশাজীবনকে এভাবে মিশিয়ে ফেলার বিরোধী। তাদের মতে, এর ফলে মানুষের সত্যিকারের অবসর আর মেলে না। বিশেষ করে, জটিলতা সৃষ্টি হয় ব্যক্তিজীবনে। আসুন, এসব জটিলতা নিয়ে সবিস্তারে জেনে নেওয়া যাক।
যেসব সমস্যা হয়
প্রথমত, ওয়ার্কইজম আপনার ওপর ভর করার অর্থ হলো আপনি অফিসে অতিরিক্ত সময় দিচ্ছেন এবং অতিরিক্ত কাজ করছেন। অতিরিক্ত কাজ করার মানেই যে সব কাজ কার্যকরী হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। অনেক উদ্যোক্তা, উচ্চপর্যায়ের নির্বাহী, সদ্যই চাকরিতে ঢোকা ফ্রেশার বা শিক্ষার্থীরাও কখনো কখনো কাজকে সম্মান অর্জনের একমাত্র উপায় বলে মনে করে থাকেন। সেই মনোভাব থেকে আসে ক্রমশ নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ঘোড়দৌড়ে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা। এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীরা সহকর্মীদের প্রতিযোগী ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে চান না এবং তাঁদের ছাড়িয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের ইচ্ছায় অফিসকে নিজের জীবনের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, অতিরিক্ত পরিশ্রম ও অতিরিক্ত কাজই সাফল্যের একমাত্র চাবিকাঠি। তবে এই জায়গাটিতেই মানের চেয়ে পরিমাণকে আমরা অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলি।
মনোবিদদের মতে, প্রত্যেক ব্যক্তিরই মানসম্মত কাজ করার একটি সীমা আছে। সেই সীমা অতিক্রম করে কাজ করলে, তাতে ভুল-ভ্রান্তি হওয়ার আশঙ্কা প্রবল থাকে। যখনই কেউ অতিরিক্ত কাজ করবে, তখনই তার মানসম্মত কাজের পরিমাণ ক্রমশ কমতে থাকবে। যখন আপনি ঠিকমতো ঘুমাবেন, পেশা–সম্পর্কিত কাজ থেকে সঠিক সময়ে নিজেকে বিযুক্ত করে ফেলতে পারবেন এবং ব্যক্তি জীবনে প্রয়োজনীয় সময়টুকু ব্যয় করতে পারবেন, তখনই আপনার পক্ষে পেশার জন্য রাখা নির্দিষ্ট সময়ে আক্ষরিক অর্থেই মনযোগী হওয়া সম্ভব হবে। আপনি তখন মানসম্মত কাজ উপহার দিতে পারবেন। সেই সঙ্গে আপনার জীবনও হয়ে উঠবে স্বাস্থ্যকর ও অর্থপূর্ণ।
দ্বিতীয়ত, ওয়ার্কইজম আপনার ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যকে নষ্ট করে ফেলে। ব্যক্তিজীবন বলতে তখন আর কিছু থাকে না। সবই হয়ে যায় পেশাজীবন। ফলে অর্থ উপার্জনকারী না হলেই কোনো কাজ আপনার প্রাধান্যের তালিকায় থাকে না। একবার ভেবে দেখুন তো, প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গে আড্ডা দিলে তো কোনো অর্থ উপার্জন হয় না। কিন্তু এটি ছাড়া কি আপনার জীবন পানসে হয়ে যাবে না? মাঝে মাঝে আমরা সেটিই হওয়ার দৌড়ে থাকি, যে রূপে আমাকে অন্যরা দেখতে চায়। এই দৌড়ে অংশ নেওয়ার অর্থই হলো, আপনাকে কেবল দৌড়াতেই হবে। কারণ যা-ই করুন না কেন, শেষ পর্যন্ত আপনার মনে হবে—যথেষ্ট নয় কিছুই। এর পরিণতিতে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি খুব বেশি। এমনও হতে পারে যে, জীবনকে শুধুই আখ পেষার কল ছাড়া আপনার আর কিছুই মনে হবে না। কারণ, কাজের মাঝে আপনি নিজেকে হারিয়ে ফেলছেন যে!
সমাধান কী
১. পেশাগত কাজ ও ব্যক্তিজীবনের মধ্যে ফারাক তৈরি করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট সীমানা এঁকে ফেলতে হবে। একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা ঠিক করা প্রয়োজন, যার পরে আপনি শুধু নিজের ব্যক্তিজীবনের জন্যই বরাদ্দ থাকবেন। হ্যাঁ, জরুরি প্রয়োজনে এর কিছুটা এদিক-সেদিক হতেই পারে। কখনো কখনো হয়তো প্রয়োজনেই পেশাজীবনকে একটু বেশি সময় দিতে হবে। আবার কখনো দিতে হতে পারে ব্যক্তিজীবনকে। কিন্তু পারতপক্ষে এই বিভক্ত ব্যবস্থার ব্যত্যয় করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, ড্রিম জব হোক, আর যাই হোক—পেশাজীবন কখনো আপনার জীবনের একমাত্র অর্থ হতে পারে না।
২. শুধু পেশাগত লক্ষ্য নির্ধারণ করলে হবে না। ব্যক্তিজীবনের জন্যও লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। এবং সেসব লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টাও করতে হবে। বুঝতে হবে যে, শুধু পেশাজীবনের লক্ষ্য অর্জনই পুরস্কার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দেয় না। ব্যক্তিজীবনও দেয়। এবং ব্যক্তিজীবনের লক্ষ্য অর্জনে যে মানসিক প্রশান্তি পাওয়া যায়, তার স্বাদ সত্যিই তুলনাহীন।
৩. পেশাজীবনের ইঁদুর দৌড়ে আমরা আসলে ঢুকে যাই কিছু ছোট ছোট অর্জনের লোভে। মনুষ্য জীবনের বড় অর্জনগুলো সম্পর্কে আমাদের ওয়াকিবহাল হতে হবে, ভাবতে হবে। দেখবেন, যে অ্যাসাইনমেন্টের জন্য আপনি আজ নিজের জন্য কোনো সময়ই বরাদ্দ রাখলেন না, সেটি আসলে এক মাসে কয়েকবারই করতে হয়। এতেই যে আপনার চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন হয়ে যাবে, তা কিন্তু নয়। সুতরাং দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
৪. পেশাগত কাজের কোনো ঝামেলাকে ব্যক্তিগত সমস্যার মতো করে দেখা যাবে না। অর্থাৎ, দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এতে করে দেখবেন অফিসের ঝামেলা ঘরে এসে দানা বাঁধবে কম। আবার অফিসের সমস্যাকে ব্যক্তিগতভাবে না নিলে, সেটি সমাধান করতে পারবেন ঠান্ডা মাথায়। ফলে অফিসেও সাফল্য লাভের সম্ভাবনা বাড়বে বৈ কমবে না।
৫. ক্যারিয়ারে কী পেতে চান—সে সম্পর্কে নিজের সাথে খোলামেলা বোঝাপড়া করার চেষ্টা করুন। পরিবার, বন্ধুবান্ধব বা সমাজ আপনাকে কী হিসেবে দেখতে চায়, সেই ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নিজেকে নিজে কীভাবে দেখতে চান, তা বুঝতে শিখুন। মনে রাখবেন, অন্যের আয়নায় নিজেকে সুন্দর দেখার চেয়ে নিজের আয়নায় আসল আমিকে দেখে চিনতে পারাটা গুরুত্বপূর্ণ।
৬. অনেকে অফিসের সহকর্মীদের মধ্যেই নিজের জীবনকে সীমাবদ্ধ করে ফেলেন। গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্রেই আমরা জীবনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সময় ব্যয় করি। তাই অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে ভালো ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা অবশ্যই উপকারী। তবে সেটিই ‘একমাত্র’ হলে ঢের বিপদ। কারণ, সেক্ষেত্রে আড্ডাতেও বারবার উঠে আসবে শুধু কাজের হিসাব। এসব আলোচনা থেকে কিছুটা দূরে থাকতে হলে তাই কর্মক্ষেত্রের বাইরেও সময় কাটানোর মতো পরিমণ্ডল তৈরি করে নিতে হবে। সেই সঙ্গে নতুন নতুন শখে মজতে পারেন। ধরুন, বই পড়া আপনার শখ, বা ছবি আঁকা, ঘুরতে যাওয়া কিংবা ক্রাফটিং। এগুলো কোনো অর্থ উপার্জন হয়তো করবে না, কিন্তু আপনাকে বুক ভরে শ্বাস নিতে সাহায্য করবে। মাথায় চেপে থাকা কর্মক্ষেত্রের চাপকে এক তুড়িতে উড়িয়েও দিতে পারবে।
সমস্যা ও সমাধান সম্পর্কে তো জানা হলো। এবার তবে একবার চেষ্টা করেই দেখুন। এতে সফল হলে হয়তো এরপর থেকে আপনার পরিচয় কেউ জানতে চাইলে, আর শুধু পেশার মধ্যে আটকে থাকতে হবে না।
তথ্যসূত্র: দ্য আটলান্টিক, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, সাইকোলজিটুডে ডট কম, দ্য হিল, হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ ও ফোর্বস
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।