জুমবাংলা ডেস্ক : বহুজাতিক ভিসা প্রসেসিং সার্ভিস সংস্থা ভিএফএস গ্লোবালে দালালদের দৌরাত্ম্য কমাতে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী।
তিনি বলেছেন, ভিসা প্রসেসিংয়ের কাজ যাতে দ্রুত ও সহজ হয় সেজন্য শাখা বাড়ানোসহ একাধিক কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য ইতালি সরকারকে অনুরোধ জানাব।
মঙ্গলবার (২১ মে) দুপুরে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, আজকে ইতালির রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বসবো। ইতালির ভিসা প্রক্রিয়া যাতে সহজ হয় সে বিষয়ে আলোচনা করব। একই সঙ্গে ভিসাপ্রত্যাসীদের যেন দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে না হয় এবং তাদের ভোগান্তি কমে, সে বিষয়গুলো নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীর দিক নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি। দেশের মানুষ ভোগান্তি ছাড়াই যেন বিদেশ যেতে পারেন তা নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য। ভিসা প্রসেসিং সেন্টারের বিষয়টি দূতাবাস দেখে। তারা একটি কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে। এটা একাধিক কোম্পানিকে দিয়ে আরও কিছু উইং বাড়ানোর কথা বলবো। এটা করা গেলে সমস্যার সমাধান হবে।
দালালদের দৌরাত্ম্য কমানোর জন্য কোনো পদক্ষেপ নেবেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, দালালদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করার জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে। আমার বিশ্বাস দালালরা এত শক্তিশালী নয় যে আমরা তাদের দমন করতে পারবো না। আশা করছি আমরা তাদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে আনতে পারবো এবং সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।
অভিযোগ উটেছে, লক্ষাধিক মানুষের পাসপোর্ট আটকে রেখেছে ভিএফএস। অ্যাপয়েন্টমেন্টের নামে বাণিজ্য করছে তাদের েএকটি চক্র। বিদেশ গমনেচ্ছু মানুষ হয়রানি আর ভোগান্তির শিক্ষার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা ইউরোপের শ্রমবাজার ধ্বংসের ষড়যন্ত্র।
২০০১ সালে ইতালি সরকার বাংলাদেশিদের ওয়ার্ক পারমিট বন্ধ করে দেয়। পরে ২০২০ সালে আবার তা চালু হয়। ২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর ভিসা প্রদানসহ যাবতীয় সেবা নির্দিষ্ট ফির বিপরীতে সম্পাদনের জন্য ইতালি দূতাবাসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় ভিএফএস গ্লোবাল। ২০২৩ সালের ২৭ মার্চ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইতালি সরকার বিশ্বের ২০-২২টি দেশে ৮২ হাজার ৭০৫ জনকে ওয়ার্ক পারমিট দেয়। এর মধ্যে শুধু বাংলাদেশিরা পায় ৩০ হাজারেরও বেশি।
সূত্র জানায়, ওয়ার্ক পারমিট পাওয়ার পর ভিসা প্রদানের সাক্ষাৎকার এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমার সিরিয়াল পেতে আবেদনকারীরা ভিএফএসের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে প্রার্থীদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট প্রদানে ভোগান্তি, দালাল চক্রের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাণিজ্য, লক্ষাধিক পাসপোর্ট এক থেকে দেড় বছর ধরে আটকে রাখাসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করে যাচ্ছে ভিএফএস।
বৈদেশিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের সঙ্গে ইন্ডিয়াসহ অন্যান্য দেশের প্রতিযোগিতা রয়েছে। বাংলাদেশে ইতালিয়ান অ্যাম্বাসির নিয়ম অনুযায়ী ভিসার আবেদনের জন্য ভিএফএস গ্লোবালের ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়। ভিএফএস গ্লোবাল গত বছর মে মাসের পর থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে চরম অব্যবস্থাপনা তৈরি করছে। কোনো ব্যক্তি দালাল এবং মোটা অঙ্কের টাকা ছাড়া অ্যাপয়েন্টমেন্ট পান না।
এদিকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না পেয়ে হাজার হাজার মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছেন। কেননা ইতালির আইন অনুযায়ী ওয়ার্ক পারমিটসহ ভিসার আবেদনপত্রটি ওয়ার্ক পারমিট বের হওয়ার দিন থেকে পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে অ্যাম্বাসিতে অবশ্যই উপস্থাপন করতে হবে। অথচ অ্যাম্বাসি সরাসরি আবেদন গ্রহণ করে না এবং অ্যাপয়েন্টমেন্ট জটিলতায় পড়ে অনেকেই ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ হারাচ্ছে। তাছাড়া বিগত সময়ে ওয়ার্ক পারমিটপ্রাপ্ত ৩০-৪০ হাজার আবেদনকারী পাসপোর্টসহ ভিসার আবেদন ভিএফএস গ্লোবালে জমা দিয়ে ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে অপেক্ষায় রয়েছেন। অথচ ইতালিয়ান সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী আবেদন দাখিলের ২০ দিন থেকে সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে ভিসা প্রদানের নির্দেশনা রয়েছে।
ভিএফএস গ্লোবাল বাংলাদেশ-এর মালিক নাহিদ নেওয়াজ। ফোন কলে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ইতালিতে বাংলাদেশিদের ভালো অবস্থান এবং সুনাম থাকার পরও বর্তমানে মালিকরা বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য আবেদন করতে ইতোমধ্যেই অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, বাংলাদেশে ভিসা প্রদানের জটিলতা হচ্ছে। আমরা ওয়ার্ক পারমিট বের করে দিলেও সময়মতো শ্রমিক এখানে আসতে পারে না। আমাদের কাজের ক্ষতি হয়। অর্থাৎ ইতালির শ্রমবাজারে বাংলাদেশের সুযোগ প্রায় ধ্বংসের মুখে। এ ক্ষতি অপূরণীয়। কেননা, ইউরোপে একমাত্র ইতালিতেই দক্ষ, অদক্ষ ও নিরক্ষর লোকও গিয়ে কাজ করার জন্য আবেদন করতে পারে। এ মানুষগুলো ইতালিতে যাওয়ার সুযোগ পেলে পরিবার এবং রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে এবং সে তার জীবনমান পরিবর্তন করতে পারে।
জানা গেছে, ভিএফএস গ্লোবাল ভিসা প্রসেসিং খরচ বাবদ জনপ্রতি ১৯ হাজার ৭২০ টাকা থেকে ২২ হাজার টাকা নিয়ে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী ভিসাপ্রত্যাশীরা কাগজপত্র জমা এবং সাক্ষাৎকারের জন্য ভিএফএস গ্লোবালের নিজস্ব ওয়েবসাইটে বুকিং বা অ্যাপয়েন্টমেন্ট গ্রহণ করে থাকে। ২০২২ সাল থেকে এ অ্যাপয়েন্টমেন্ট সহজলভ্য হলেও ২০২৩ সালের শুরুর দিকে অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য কালোবাজারি এবং ভিএফএসের যোগসাজশে একটি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়। ভিসাপ্রত্যাশীরা নিজে চেষ্টা করে কোনোভাবেই ওয়েবসাইটে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে পারে না।
ভিএফএসের নোটিশ মতে, প্রতি মাসের ২৫ তারিখ পরবর্তী মাসের অ্যাপয়েন্টমেন্ট প্রদান করা হবে। কিন্তু বাস্তবে ৯টায় অনলাইনে স্লট ওপেন করলে প্রথম তিন মিনিটে তিন হাজার অ্যাপয়েন্টমেন্ট শেষ হয়ে যায়, যা কি না রীতিমতো আলাদিনের দৈত্যের মতো কাজ। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কতিপয় ভিএফএসের কর্মকর্তা এবং দালাল সিন্ডিকেট। অ্যাপয়েন্টমেন্ট কালোবাজারিদের হাতে তুলে দিয়ে ভিএফএস-এ জমাকৃত পাসপোর্ট সঠিক সময়ে ডেলিভারি বন্ধ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়। ফলে ভিসাপ্রত্যাশীরা প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে দুই লাখ টাকা করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্রয় করতে বাধ্য হয়। যা একদম বিনামূল্যে প্রদানের ঘোষণা দেওয়া থাকে। ভিসাপ্রত্যাশীরা অ্যাপয়েন্টমেন্ট না পেলেও ভিএফএস কর্মকর্তা এবং দালালদের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে সহজেই যখন-তখন অ্যাপয়েন্টমেন্ট গ্রহণ করে থাকে।
সূত্র জানায়, ভিসাপ্রত্যাশীদের সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য সরবরাহ করা হয় না। আবেদন গ্রহণ করার পর কোনো আপডেট তারা আবেদনকারীকে প্রদান করে না। অ্যাপয়েন্টমেন্ট কবে পাবে, তাদের পাসপোর্ট এতদিন আটকে রাখার কারণ, আদৌ ভিসা সরবরাহ করা হবে কি না ইত্যাদি প্রশ্নের জবাব ভিএফএস বা দূতাবাস সরবরাহ করে না। এমনকি ভিএফএসের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য খুদেবার্তা ছাড়া আর কোনো মাধ্যম নেই। ফলে মাসের পর মাস এমন দোটানায় পড়ে নাজেহাল হয় আবেদনকারী বা তার পরিবার।
সূত্র মতে, ভিএফএসের অ্যাপয়েন্টমেন্ট জটিলতার কারণে অনেক ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ শেষ হয়েছে এবং দীর্ঘ সময় পর টাকার বিনিময়ে জমা দিলেও রিজেক্ট হয়েছে। ফলে ভিসাপ্রত্যাশীদের ১৮-২০ লাখ টাকা ক্ষতি হচ্ছে এবং টাকাগুলো আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের হাতে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন উপায়ে।
সরেজমিন অনুসন্ধানকালে দেখা যায়, ভিএফএসের ওয়েটিং রুমে ভিসাপ্রত্যাশী ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও হরহামেশা বেশকিছু দালালের বিচরণ পরিলক্ষিত হয়। এ বিষয়ে ভিএফএসের জিজ্ঞাসাবাদে নিতান্তই দায়সারা গোছের জবাব পাওয়া যায়।
সূত্র জানায়, গত ৩১ মার্চ থেকে ভিএফএস মেইলিং সিস্টেমের মাধ্যমে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার ঘোষণা দিলেও মেইলিং সিস্টেমে সিরিয়াল মেনটেনের কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। এতে একই অসংগতির পুনরাবৃত্তি ঘটে। গত ৯ মে ভিএফএস চিটাগাং থেকে মেইলিং অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া ২০ জন আবেদনকারীর ডকুমেন্ট জমা দেওয়ার কথা থাকলেও ৪০ জন মেসেজ পেয়েছেন বলে জানা যায়। যে অতিরিক্ত ২০ জন মেসেজ পেয়েছিলেন তাদের মেইলিং ডাটাবেজ চেক করে নানান ধরনের তথ্যের অসংগতি দেখা যায়। যার মধ্যে প্রধান অসংগতি হলো প্রটোকল ছাড়াই অতিরিক্ত ২০ জন অ্যাপয়েন্টমেন্টের কল পেয়েছিলেন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, অফিস চলাকালীন নির্ধারিত সময়ে ভিসা স্লট ওপেনিংয়ের নিয়ম থাকলেও গভীর রাতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভিসা স্লট ওপেন করে ভিএফএস।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, ২০২২-২০২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ১১ হাজার পাসপোর্ট ভিএফএস আটকে রাখে। এর মধ্যে ২০২২ সালে ৩৫ হাজার এবং ২০২৩ সালে ৭৬ হাজার পাসপোর্ট আটকে রাখা হয়। এতে ভিসার খরচ, ভিএফএস খরচ, দালাল খরচ, রেমিট্যান্স বঞ্চিতসহ দেশের ক্ষতি হয়েছে ৪১ হাজার ২২০ কোটি টাকা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।