বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন : সম্মিলিত সনাতন জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিনকে ঘিরে সংঘর্ষে চট্টগ্রামে নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ ছয় বছর ধরে আইনি প্রাকটিস করছেন। গত বছর হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে নিবন্ধিত হন।
নিহত আলিফ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মামলার সাথে যুক্ত ছিলেন না বলে নিশ্চিত করেছেন আইনজীবীরা।
কাজ শেষে আদালত থেকে বাড়ি ফেরার পথে এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন মি. ইসলাম।
আদালতের বিপরীত দিকে অবস্থিত স্থানীয়ভাবে পরিচিত রঙ্গম গলি বা মেথর পট্টির ভেতরে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে হত্যা করা হয় বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে।
এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি আজ বুধবার কর্মবিরতি পালন করেছে।
একইসাথে আগামীকাল বৃহস্পতিবারও কর্মবিরতির ঘোষণা দেয়া হয়েছে বলে জানান আইনজীবী নেতারা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, এ হত্যার ঘটনায় পাওয়া ভিডিও ফুটেজ দেখে অভিযুক্তদের শনাক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে এ ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে সাত জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এছাড়া ঘটনার পর পুলিশের ওপর হামলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজে বাধাদানের অভিযোগে অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত আরও ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র মো. রইস উদ্দিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা যে ভিডিও পেয়েছি তা দেখে শনাক্তের চেষ্টা করছি। সেই সাথে আইনজীবী নিহতের ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে আমরা সাত জনকে গ্রেফতার দেখাচ্ছি। এছাড়া পুলিশের ওপর হামলা, কাজে বাধাদানের অভিযোগে আরও ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।”
এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে দেশের বেশ কয়েকটি আইনজীবী সমিতিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়।
সকালে চট্টগ্রামের আদালত প্রাঙ্গণে একটি জানাজা এবং সেখানকার জামিয়াতুল ফালাহ মসজিদে আরেকটি জানাজা হয়েছে নিহত আলিফের।
পরে জামিয়াতুল ফালাহ মসজিদের দ্বিতীয় জানাজায় ভূমি উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ, চট্টগ্রামের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, জামায়াতে ইসলামীর চট্টগ্রাম নগরীর আমীর শাহজাহান চৌধুরী এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমসহ প্রচুর মানুষ অংশ নেন।
পরে বিকেলে গ্রামের বাড়ি চুনতিতে দাফন করা হয় নিহত আলিফকে।
কে ছিলেন নিহত এই আলিফ ?
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি এলাকার বাসিন্দা ছিলেন নিহত সাইফুল ইসলাম আলিফ। ২০১৮ সাল থেকে চট্টগ্রামে প্রাকটিস শুরু করেন এবং পরবর্তী সময়ে হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে নিবন্ধিত হন।
চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “উনি চট্টগ্রাম বারের রেগুলার আইনজীবী ছিলেন। পাঁচ-ছয় বছর প্রফেশনে আছেন, ২০১৮ সাল থেকে চট্টগ্রামে প্রাকটিসে আছেন। গত বছর হাইকোর্ট বারে সনদ পেয়েছেন।”
তবে, প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যমে তাকে সহকারী কৌশুলী হিসেবে উল্লেখ করা হলেও তিনি রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা ছিলেন না বলে জানান মি. রাজ্জাক।
ব্যক্তিগতভাবে নিহত সাইফুল ইসলাম আলিফকে চিনতেন বলে জানান এই আইনজীবী নেতা।অসুস্থতাজনিত কারণে বাঁকা হয়ে হাঁটতেন বলেও জানান। ।
তিনি বলেন, “জন্মগত থেকে হয়তো একটু অসুস্থতা ছিল। একটু বাঁকা হয়ে হাঁটতেন।”
মি. ইসলামের তিন বছরের এক মেয়ে রয়েছে। একইসাথে নিহতের স্ত্রী আবারও সন্তানসম্ভবা বলেও জানান তিনি।
সাত ভাই–বোনের মধ্যে আলিফ তৃতীয় ছিলেন বলে জানান তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন সেশন জজ কোর্টের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মো. রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী।
বেশ কয়েকজন আইনজীবীর সাথে কথা বলে জানা যায়, বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন নিহত সাইফুল ইসলাম আলিফ।
একইসাথে লোহাগাড়া উপজেলার বিএনপির লিগ্যাল এইড কমিটির সদস্য ছিলেন বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের (বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের সংগঠন) রাজনীতির সাথেও জড়িত ছিলেন তিনি। এ সংগঠনের ভোটার তালিকায় রয়েছে তার নাম।
এ হত্যাকাণ্ডের পর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের বিচার দাবি করেছেন।
একইসাথে আরেকটি স্ট্যাটাসে নিহত আলিফ বিএনপি–জামায়াত সমর্থিত আইনজীবী প্যানেলের বলে দাবি করেছেন।
কী হয়েছিল আদালতে ?
রাষ্ট্রপক্ষের কয়েকজন আইনজীবী এবং নেতা মঙ্গলবার আদালতে যা ঘটেছে তার বর্ণনা দিয়ে এটাকে অস্বাভাবিক ঘটনা বলে দাবি করেন।
রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় গ্রেফতারকৃত সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে মঙ্গলবার চট্টগ্রামের আদালতে হাজির করা হলে তাকে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয় আদালত।
এ খবর পেয়ে সেখানে বিক্ষোভরত তার অনুসারীরা তার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে এবং তাকে কারাগারে নিয়ে যেতে বাধা দেয়।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুলিশ লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। পরে আদালত (চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট) চত্বরে ভাঙচুর করা হয়।
সিএমএম কোর্টের জামিনের আদেশের বিরুদ্ধে মি. দাসের আইনজীবীরা মহানগর দায়রা জজ আদালতে যায়।
এতো দ্রুত (একই দিনে) নিম্ন আদালতের (সিএমএম কোর্ট) আদেশের বিরুদ্ধে কীভাবে উচ্চ আদালতে (মহানগর দায়রা জজ আদালত) গেলেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন চট্টগ্রামের আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মি. রাজ্জাক।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “নিম্ন আদালত (সিএমএম কোর্ট) জামিনটা রিজেক্ট করছে। জেলখানায় নিতে তাকে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। ইসকনের শ’খানেক বা দুই’শ অনুসারী পরে সেখানে অবস্থান নেয়। এবং ওপরের কোর্টে গিয়ে ওনাদের পক্ষের কিছু লইয়ার এপ্রোচ করলো ওনাকে জামিন দিতে হবে উপরের কোর্টে” জানান মি. রাজ্জাক।
বিষয়টির শুনানি বুধবার হবে জানিয়ে এজলাস থেকে আদালতের বিচারক নেমে যান বলে জানান এই আইনজীবী নেতা।
এ সময় মি. দাসের অনুসারী আইনজীবীরা ওই কোর্টের বাইরে অবস্থান নেয় বলে জানান তিনি।
“কোর্ট আমাদের জানায় যে, যেহেতু জুডিশিয়ারি একটা অর্ডার হয়ে গেছে আমি আজকে কোনোক্রমেই শুনানি করবো না এটা, শুনানি আগামীকাল হবে। আমরা বলছি আপনি যেহেতু কোনো অর্ডার পাস করেননি, এটাতে আমাদের কোনো দ্বিমত নাই। এটা বলে আমরা চলে আসছি,” বলেন মি. রাজ্জাক।
আবেদনের বিষয়ে এই খবর, পুলিশের লাঠিচার্জ এসবের জেরে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিক্ষোভরত অনুসারীরা সেখানে ভাঙচুর চালায় বলে জানান এই আইনজীবী নেতা।
এরপর সাধারণ মানুষ তাদেরকে ধাওয়া করলে তারা কোর্টের সামনের রাস্তায় চলে যায়।
কীভাবে নিহত হন সাইফুল ইসলাম?
কোর্ট প্রাঙ্গনের রাস্তার অপর পাশে অবস্থান নেয়া চিন্ময় দাসের অনুসারীরা আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের ওপর হামলা করেছে বলে দাবি করেন আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মি. রাজ্জাক।
তিনি বলেন, “সেখানেই আমাদের ওই লইয়ারকে পাইছে। হয়তো বাড়িতে চলে যাচ্ছিলো ও। ওখানেই ঝামেলার মধ্যে ওরে পাইছে। যখন ওর গলায় ব্যান্ড দেখছে এবং (আইনজীবীদের গলার সাদা ব্যান্ড) মুখে দাঁড়ি ছিল এই ছেলেটার” বলেন মি. রাজ্জাক।
পরে তাকে হাসপাতালে নেয়ার খবর পাওয়ার পর আইনজীবী সমিতির নেতারাও সেখানে যায় বলে জানান এই আইনজীবী নেতা।
বুধবার কর্মবিরতি পালন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন আইনজীবীদের ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য বৃহস্পতিবারও এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে সাইফুল ইসলাম আলিফের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে পরিচিত সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মি. চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে জানান কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তিনি।
আলিফকে আদালত চত্বরের মসজিদের সামনে থেকে টেনে রঙ্গম গলি বা মেথর পট্টিতে নিয়ে যাওয়া হয় বলে দাবি করেন তিনি।
পরে সাধারণ মানুষ যখন বলাবলি করছিল কোর্ট ভবন থেকে নামার ঠিক উল্টা দিকের রঙ্গম গলি বা মেথর পট্টিতে একজন আইনজীবীকে মেরে ফেলা হয়েছে তখন এ বিষয়ে খবর নেন আইনজীবীরা।
মি. চৌধুরী জানান এ খবরের পর সবাই ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে তাকে ফোন করে বিষয়টি জানান। সূত্র : বিবিসি বাংলা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।