আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাসুদ পেজেশকিয়ান এগিয়ে আছেন। আগামী ৫ জুলাইয়ের রান-অফ ভোটে জিতেও যেতে পারেন তিনি। তার পক্ষে ইরানকে পরিবর্তন করা কতটা সম্ভব, লিখেছেন সালাহ উদ্দিন শুভ্র।
ইব্রাহিম রাইসি এক মাসের বেশি সময় আগে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর ইরানে হয়ে গেল প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ওই নির্বাচনে চার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। শেষ পর্যন্ত ভোট গণনায় টিকে আছেন দুই প্রার্থী। এর মধ্যে বড় ব্যবধানে এগিয়ে আছেন মধ্য বা উদারপন্থি প্রার্থী মাসুদ পেজেশকিয়ান। তিনি ২ কোটি ৪০ লাখ ভোট পেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী কট্টরপন্থি কূটনীতিক সাঈদ জালিলি থেকে এক কোটিরও বেশি ভোটে এগিয়ে রয়েছেন। জালিলি পেয়েছেন ৯৪ লাখের চেয়ে কিছু বেশি ভোট।
কোনো প্রার্থী এককভাবে ৫০ শতাংশ ভোট না পাওয়ায় ৫ জুলাই দ্বিতীয় পর্যায়ের রান-অফ ভোট আয়োজিত হবে। ইরানের ইতিহাসে যা দেখা গিয়েছিল ২০০৫ সালে।
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, পেজেশকিয়ান ইরানের ধর্মকেন্দ্রিক শাসনের পক্ষে হলেও পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি, অর্থনৈতিক সংস্কার, উদার সমাজ এবং বহুদলীয় রাজনীতির পক্ষে।
মাসুদ পেজেশকিয়ান
রাজনীতিতে তুলনামূলক কম পরিচিত পেজেশকিয়ান মোহাম্মদ খাতামির (২০০১-২০০৫) সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর ২০০৮ সাল থেকে ইরানের সংসদে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর তাব্রিজের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। পেজেশকিয়ান এর আগে তাব্রিজ ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সায়েন্সেসেরও প্রধান ছিলেন। যা উত্তর ইরানের অন্যতম প্রধান চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। উল্লেখ্য, ইরানের সর্বশেষ সংস্কারপন্থি প্রেসিডেন্ট ছিলেন মোহাম্মাদ খাতামি।
এবারের প্রতিযোগিতায় ইরানের শীর্ষস্থানীয় সংস্কারপন্থি জোটের সমর্থন পান পেজেশকিয়ান। তাদের সমর্থনে পেজেশকিয়ান গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ব্যাপক প্রচার চালান। সাবেক প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির অধীনে দুই মেয়াদে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা জাভেদ জারিফসহ অনেক সাবেক সংস্কারবাদী রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রীদের উপস্থিতি তার প্রচারকে শক্তিশালী করে। প্রাক নির্বাচনী জনমত জরিপে পেজেশকিয়ানের পক্ষে বেশি সমর্থন পাওয়া যায়। পাঁচটি টেলিভিশনে প্রেসিডেন্ট বিতর্কে তিনি দেশি এবং বিদেশি নীতি উভয় বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। পেজেশকিয়ান ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পৃক্ততার জন্য অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক উভয় ক্ষেত্রেই সংস্কার শুরু করতে চান। প্রেসিডেন্টের বিতর্কে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা বাণিজ্য অংশীদারদের আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে একটি বাধা হিসেবে কাজ করছে। তিনি সংস্কারপন্থি রুহানি প্রশাসনের সময় ইরান এবং বিশ্ব শক্তির মধ্যে যে পারমাণবিক চুক্তি হয়েছিল তা-ও জোরালোভাবে সমর্থন করেন। পেজেশকিয়ান বাধ্যতামূলক হিজাব পরাসহ নারীকেন্দ্রিক বিষয়গুলো নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। ২০২২ সালের শেষ দিকে হিজাব না পরায় মাসা আমিনির মৃত্যুর পর ‘ইসলামিক ড্রেস কোড’ বিলের বিরুদ্ধে সংসদে তিনি বিরোধিতা করেন।
মধ্যপন্থিদের সমস্যা
বিবিসি জানাচ্ছে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে চুক্তিটি হয়েছিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স এবং জার্মানির সঙ্গে। এ সমঝোতায় ইরানের ইউরেনিয়াম মজুদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ হয়। চুক্তি অনুযায়ী তেহরান তাদের কিছু পরমাণু স্থাপনা বন্ধ করতে অথবা পরিবর্তনে সম্মত হয়। এ ছাড়া ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের অনুমতিও দেওয়া হয়। যার বিনিময়ে ইরানের ওপর আরোপিত অনেক আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এ চুক্তিটি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়ে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে এ চুক্তি বাতিল করে দেন।
ফরেন পলিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, এই পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইরানে সংস্কারবাদী এবং মধ্যপন্থিরা জনপ্রিয়তা পায়। তবে দ্রুত রাজনৈতিক দৃশ্যপট নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়। ক্রমে মধ্যপন্থিরা ইরানের রাজনীতিতে প্রান্তিক হয়ে পড়ে। ২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইব্রাহিম রাইসির বিজয়ের পর সরকার থেকে মধ্যপন্থিদের সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে দেওয়া হয়। চলতি নির্বাচনেও দেশটির গার্ডিয়ান পরিষদ পেজেশকিয়ান ছাড়া সংস্কারবাদী আন্দোলনের প্রধান কয়েকজন নেতাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে। পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ওবামা প্রশাসনের সময় তেহরান-ওয়াশিংটন সম্পর্কের উন্নতি নিয়ে আয়েতুল্লাহ খামেনি বিরোধিতা করেন। এরপর দেশটির ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) সামরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা, এপ্রিল মাসে ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপের ঘটনায় মধ্যপন্থিরা আরও প্রান্তি হতে থাকে। এ ছাড়া ইরানে মার্কিন নাবিকদের গ্রেপ্তার, পারস্য উপসাগরে টহল নৌকা জব্দ করা, সিরিয়ায় কুদস ফোর্সের কার্যক্রম সম্প্রসারণ এবং পশ্চিমা বিরোধী অক্ষের প্রতি ইরানের ব্যাপক সমর্থন উত্তেজনা বাড়িয়েছে। মধ্যপন্থিদের কাজ আরও কঠিন করে তুলেছে। আইআরজিসির পদক্ষেপ বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও নিরুৎসাহিত করে।
আয়াতুল্লাহ খামেনি
ফরেন পলিসি আরও বলছে, হাসান রুহানির শাসনামলে ইরানে দেশব্যাপী কয়েক দফা বিক্ষোভ হয়। সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে ব্যাপক সামাজিক অসন্তোষ দেয়। ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে অর্থনৈতিক সংকটে বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়, যেখানে রুহানি সরকারের উদ্দেশ্যে বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দেয়, ‘সংস্কারবাদী, নীতিবাদীর, দিন শেষ’। ২০১৯ পেট্রোলের দাম বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায়ও বিক্ষোভ হয়। এসব বিক্ষোভ বর্তমান ইরান সরকারের বিরুদ্ধেও হয়েছে। ২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইরানের ইতিহাসে সর্বনিম্ন ভোটার উপস্থিতি ছিল। দেশটির মাত্র ৪৮ শতাংশ ভোটার ভোট দেয়। তবে এতে রাইসি ৬২ শতাংশ ভোটে জেতেন।
পুলিশ হেফাজতে মাসা আমিনি নামে এক তরুণীর মৃত্যুর পর ২০২২-২৩ সালে নারী স্বাধীনতার দাবিতে তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয়। নারীর অধিকারের দাবিতে তীব্র বিক্ষোভেও তখনকার রাইসিকে লক্ষ্য করে প্রায় কোনো স্লোগান ছিল না। বিক্ষোভকারীরা তাদের সমস্যার জন্য সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ খামেনিকে সরাসরি দায়ী করে। যা প্রমাণ করে যে, ইরানের সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের সমস্যার সমাধান আসবে বলে মনে করে না, সর্বোচ্চ নেতা খামেনিকেই তারা প্রাথমিক বাধা হিসেবে চিহ্নিত করে।
যদিও ইরানের সংবিধান প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে সরকারপ্রধান হিসেবে মনোনীত করে। তবে সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি গত কয়েক দশক ধরে উল্লেখযোগ্যভাবে তার প্রভাব বিস্তার করে রেখেছেন। সমান্তরাল প্রতিষ্ঠান তৈরি করে নিজের ক্ষমতার সম্প্রসারণ করেছেন খামেনি। মন্ত্রিসভার সদস্যদের ওপর ব্যক্তিগত ভেটো প্রদানের ক্ষমতা তাকে আরও শক্তিশালী করেছে। যার মাধ্যমে তিনি নিজের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করেছেন এবং প্রেসিডেন্টের কর্র্তৃত্ব সীমিত করেছেন।
নীতি পরিবর্তন
আল আরাবিয়া বলছে, ইরানের ক্ষমতা শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম লিডার আলী খামেনির হাতে নিহিত, তাই এর ফলাফল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে মিলিশিয়া গোষ্ঠীর প্রতি সমর্থনের বিষয়ে কোনো বড় নীতিগত পরিবর্তন ঘটাবে না। তবে প্রেসিডেন্ট প্রতিদিন সরকার পরিচালনা করেন এবং ইরানের নীতির সুরকে প্রভাবিত করতে পারেন। গাজায় ইসরায়েলি হামলা এবং লেবাননের হিজবুল্লাহর সঙ্গে সংঘাতের সময়ে ইরানে এ নির্বাচন হলো। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনির বয়সও এখন ৮৫। এ সময় তিনি পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের উত্তরসূরি বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকবেন। তিনি চাইবেন এমন একজন অনুগত প্রেসিডেন্ট, যার মাধ্যমে নিজের উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে পারেন। উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় নিহত রেইসি যেমন ছিলেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জালিলির জয় হলে ইরানের পররাষ্ট্র ও অভ্যন্তরীণ নীতি আরও বেশি পশ্চিমাবিরোধী মোড় নেবে। তবে পেজেশকিয়ানের বিজয় পশ্চিমের সঙ্গে উত্তেজনা কমাতে, অর্থনৈতিক সংস্কার, এবং রাজনৈতিক বহুত্ববাদের সম্ভাবনা বাড়াতে পারে। তাদের আরও মত, খামেনি সর্বোচ্চ নেতা হয়ে সর্বাধিক প্রভাব খাটালেও, প্রেসিডেন্টকে দৈনন্দিন কাজগুলো করতে হয়। ফলে রাষ্ট্রের সুর পরিবর্তনের সুযোগ তার হাতেও রয়েছে। ফরেন পলিসি বলছে, ইরানি সমাজের অনেকে বিশ্বাস করে যে তাদের উন্নতি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে নেই। সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে খামেনির ৩৫ বছরের শাসনামলে সরকারগুলোর ক্ষমতা ক্রমে হ্রাস পেয়েছে। পেজেশকিয়ান সংস্কারপন্থি প্রার্থী হলেও খামেনির কথার বাইরে যাওয়ার জোর ঘোষণা নেই তার। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, খামেনি দেশের জন্য সামগ্রিক দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করেন। খামেনি পররাষ্ট্র নীতিসহ সাধারণ নীতিগুলো নির্ধারণ করেন এবং সরকারকে অবশ্যই তার নির্দেশাবলির সঙ্গে মিলিয়ে চলতে হবে। তবে খামেনিকে মেনে নিয়েই সংস্কারপন্থিদের পক্ষে সম্ভব ইরানে কিছু পরির্বতন আনা।
ইরানের অর্থনীতি, সামাজিক ও নাগরিক স্বাধীনতার কোনো উন্নতি হয়নি। অসন্তুষ্ট নাগরিকরা বারবার সংস্কারবাদী ও মধ্যপন্থিদের ওপর আশা করে নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে চেয়েছে। তবে প্রতিবারই তাদের হতাশা ও ক্ষোভ বেড়েছে।
পেজেশকিয়ানকেও উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হবে। সর্বোপরি ইরানের ভূরাজনৈতিক অবস্থান, আইআরজিসির কারণে সেখানে রক্ষণশীল দলগুলোর আধিপত্য বেশি। এমন জটিল পরিবেশে প্রস্তাবিত সংস্কার বাস্তবায়নে পেজেশকিয়ানের অনিশ্চিয়তা বেশি। মনে করা হচ্ছে, খামেনি পেজেশকিয়ানেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য বেছে নিয়েছেন যেন নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি বাড়ে। আর তিনি জিতলেও খামেনির মূল নীতি পরিবর্তনের সুযোগ না পান।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।