গোলাম মওলা : দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই চলছে বিস্তার আলোচনা-সমালোচনা। চলতি বছরের শুরুতেই নতুন করে আলোচনায় আসে দুর্বল ব্যাংকগুলো আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে একীভূত হবে। ৯টি ব্যাংক ‘রেড জোনে’ অবস্থান করছে— কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করার পর আলোচনা আরও ঘনীভূত হয়েছে।
অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সম্প্রতি দেশের ব্যাংকগুলোকে নিয়ে লাল, হলুদ ও সবুজের যে তালিকা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, সেটি ধারণাভিত্তিক তালিকা। এই তালিকার ওপর ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেবে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে স্বেচ্ছায় একীভূত হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এতে দুর্বল এই ব্যাংকগুলোর আমানতকারীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। তারা এখন কোথায় যাবেন। দুর্বল ব্যাংক থেকে টাকা তুলে কোথায় রাখবেন। কারণ, সঞ্চয়পত্রের সুদ হারও ব্যাংকের চেয়ে এখন কম। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে—হাতে গোনা মাত্র ১৬টি ব্যাংক (৮টি দেশি ও ৮টি বিদেশি) ছাড়াও বাকি সব ব্যাংক সমস্যাগ্রস্ত।
উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই প্রতিবেদনে রেড বা ‘লাল’ তালিকায় ৯টি দুর্বল ব্যাংকের নাম উঠে আসে। ‘হলুদ’ তালিকায় অপেক্ষাকৃত কিছু দুর্বল ব্যাংকের নাম যুক্ত হয়। আর ‘সবুজ’ তালিকায় দেখানো হয় ভালো ব্যাংকগুলোকে। এই ভালো ব্যাংকের সংখ্যা মাত্র ১৬টি। এর পর থেকে তালিকায় থাকা ব্যাংক নিয়ে আর্থিক খাত-সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়।
ব্যাংকের আমানতকারীদের মধ্যেও এ নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দেয়। এই দুশ্চিন্তার মধ্যেই রেড জোন থেকে বের হয়ে আসতে গিয়ে অনেক ব্যাংক আমানত সংগ্রহে বেপরোয়া সুদ অফার করছে গ্রাহকদের। কোনও কোনও ব্যাংক ১৩-১৪ শতাংশ পর্যন্ত সুদ অফার করছে। এ হিসাবে আমানত সংগ্রহ করলে এসব ব্যাংককে ঋণ দিতে হবে ১৬-১৭ শতাংশ সুদে। এ প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে কিছু নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানও আমানত পেতে ১৭-১৮ শতাংশ সুদ অফার করছে। কোনও কোনও ব্যাংক সাড়ে পাঁচ বছরে টাকা দ্বিগুণের প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্র ও বন্ডের চেয়েও বেশি সুদের অফার করছে দুর্বল এসব ব্যাংক।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অসম সুদে আমানত সংগ্রহের যে নীতিতে নেমেছে দুর্বল ব্যাংকগুলো, সেটিও ভালো লক্ষণ নয়। কারণ, চটকদার অফারে অনেকে না বুঝে ব্যাংকে আমানত রাখবেন। সেক্ষেত্রে মূল টাকা না পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কে আছেন ব্যাংকে আমানত রাখা গ্রাহকরাও। অনেকে মূলধন হারানোর শঙ্কা করছেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘চটকদার অফার পেয়েই উচ্চ সুদে আমানত রাখা উচিত হবে না। টাকা ফেরত দিতে পারে এমন প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে দেখতে হবে—ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি কেমন।’ তিনি উল্লেখ করেন, কোনও ব্যাংকে টাকা রাখার আগে দেখতে হবে— ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে কারা আছেন, ঋণ অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা থাকছে কিনা।
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘লিকুইডিটি না থাকলে আগ্রাসী হয়ে ডিপোজিট বাড়ানোর চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক অনেক ব্যাংকের জন্য। তবে মনে রাখতে হবে, যে ব্যাংক সবসময় ধার করে চলে—সেই ব্যাংক ভালো ব্যাংক নয়। ভালো ব্যাংক সেগুলো—যেগুলোর মূলধন কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানের সম্পদের বিপরীতে মূলধনের অনুপাত সক্ষমতা বেশি।’
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘কারও চটকদার অফারে বা কারও কথায় গ্রাহকদের দুর্বল ব্যাংকে যাওয়া উচিত না। কারণ, ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের গ্রাহকরা এখনও তাদের টাকা ফেরত পায়নি।’ তিনি উল্লেখ করেন, আমানতকারীকে দেখতে হবে—ব্যাংক বারবার কেন্দ্রীয় বা অন্য কোনও ব্যাংকের শরণাপন্ন হচ্ছে কিনা। তারল্য সংকটে পড়ে ব্যাংক যদি বারবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যায়, তার মানে তাদের হাতে টাকা নেই। আমানতকারীদের মূল টাকা ফেরত দেবে কোত্থেকে। তিনি বলেন, ‘টাকা রাখার আগে দেখতে হবে ব্যাংকের প্রফিটেবলিটি কেমন, রিটার্ন কেমন, প্রফিট কী হচ্ছে।’ এমনকি ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত হচ্ছে কিনা, গ্রাহকদেরও সে ব্যাপারে ধারণা রাখা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, দুর্বল ব্যাংকগুলো ভালো ব্যাংকগুলোর সঙ্গে একীভূত হলে তার আমানতকারীদের স্বার্থের কোনও হানি হবে না। মঙ্গলবার (১২ মার্চ) এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো চাইলে স্বেচ্ছায় একীভূত হতে পারবে।’ তিনি বলেন, ‘যে তালিকা নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে, সেটি ধারণাভিত্তিক তালিকা। এই তালিকার ওপর ভিত্তি করে কোনও সিদ্ধান্ত হবে না। এটা ব্যাংকের স্বাস্থ্য দেখার কোনও সঠিক পদ্ধতি নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগ নানা সময়ে ব্যাংকের তালিকা করে থাকে। এসব তালিকায় কোন পরিস্থিতি হলে কী হতে পারে, তা বিবেচনায় নেওয়া হয়। ব্যাংকের স্বাস্থ্য যাচাই করে দেখার একমাত্র উপাদান নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন। ফলে অন্য কোনও তালিকা বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ নেই।’
মেজবাউল হক আরও বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলো চাইলে স্বেচ্ছায় একীভূত হতে পারবে। সেটি না হলে আগামী বছরের মার্চে নীতিমালা অনুযায়ী, যারা দুর্বল তালিকায় পড়বে, তাদের একীভূত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।’
এর আগে গত ৪ মার্চ ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, চলতি বছরের মধ্যে ৭ থেকে ১০টি দুর্বল ব্যাংককে সবল বা ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংকস হেলথ ইনডেক্স (বিএইচআই) অ্যান্ড হিট ম্যাপ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে রাষ্ট্রীয় চারটি ব্যাংকসহ ৯টি ব্যাংককে রেড জোনে দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—ইয়েলো জোনে আছে ২৯টি ব্যাংক এবং গ্রিন জোনে আছে ১৬টি ব্যাংক।
‘গ্রিন জোন’ সূচকের দিক থেকে ভালো পারফরম্যান্সকে বোঝায় এবং ইয়োলো জোন মধ্যবর্তী অবস্থানকে বোঝায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি বিভাগ অর্ধবার্ষিক পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করছে।
এদিকে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত পর্যালোচনা চলাকালীন ৩৮টি ব্যাংকের অবস্থার অবনতি হয়েছে এবং ১৬টি ব্যাংকের অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এমন এক সময়ে এই প্রতিবেদন সামনে এসেছে, যখন দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণ নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা চলছে।
রেড জোনে আছে যেসব ব্যাংক
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ন্যাশনাল ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও এবি ব্যাংক।
ইয়েলো জোনে থাকা ব্যাংক
ইয়েলো জোনে রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকসহ ১৯টি বেসরকারি ব্যাংক এবং আটটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক আছে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলো হলো—আইএফআইসি, মেঘনা, ওয়ান, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল, এনআরবি, এনআরবি কমার্শিয়াল, মার্কেন্টাইল, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ডাচ-বাংলা, প্রিমিয়ার, ব্র্যাক, সাউথইস্ট, সিটি, ট্রাস্ট, এসবিএসি, মধুমতি, ঢাকা, উত্তরা ও পূবালী ব্যাংক।
শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো হলো—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী, আল আরাফাহ, স্ট্যান্ডার্ড, ইউনিয়ন, এক্সিম ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক।
গ্রিন জোনে আছে যেসব ব্যাংক
গ্রিন জোনে থাকা ব্যাংকগুলো হলো—প্রাইম, ইস্টার্ন, হাবিব, এনসিসি, মিডল্যান্ড, ব্যাংক আলফালাহ, ব্যাংক এশিয়া, সীমান্ত, যমুনা, শাহজালাল ইসলামী, উরি, এইচএসবিসি, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন, সিটি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবং আইসিবি ইসলামিক ব্যাংককে এই বিশ্লেষণ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া তথ্য-উপাত্তের অভাবে বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটিজেনস ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংককে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।