বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : পড়ার নেশা আমার ছোটবেলা থেকেই। বাবাও পড়েন, তবে শুধু পত্রিকা আর ম্যাগাজিন, বেশির ভাগই রাজনৈতিক। আমার তাতে মন ভরে না। আমি গল্প পড়তে চাই, কিন্তু গল্পের বই কেনার রীতি সেই গণ্ডগ্রামে সেকালে ছিল না।
তাই মাঝে মাঝে সিঁড়ির ঘরে ঢুঁ মারি। ওখানে কয়েকটা বস্তা আছে, দৈনিক পত্রিকা আর ম্যাগাজিনে ঠাঁসা। সেই বস্তাগুলো খুলি। যদি কিছু পাওয়া যায়।
মাঝে মাঝে পেতামও। হয়তো অপঠিত ম্যাগাজিন কিংবা পুরোনো কোনো ধুলো জমা বই। সেদিনও পেয়েছিলাম, একটা পুরোনো পাঠ্যবই। বাংলা বই।
আকারে ছোট, ষাট-সত্তর দশকের বইগুলো ছোটই হতো। অনেকটা পকেটবুক সাইজের। প্রথম দিকের কয়েকটা পৃষ্ঠা ছিল না। তাই কোন ক্লাসের বই বলতে পারব না।
সেই বইয়ের একটা গল্প ছিল, নাম ভুলে গেছি, তবে দুই পণ্ডিতের লড়াই জাতীয় কিছু একটা হবে।
ব্রিটিশ আমল। পাশাপাশি দুটো গ্রাম। পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে তাদের জুড়ি নেই। কিন্তু দুই গ্রামের একটিতেও কোনো স্কুল নেই, অধিকাংশ মানুষ তাই মূর্খ। গ্রাম দুটোর নাম ভুলে গেছি। তাই এখন কাল্পনিক নাম দিতে পারি। ধরা যাক, একটা গ্রামের নাম উত্তরগাঁও এবং পাশেরটার নাম দক্ষিণগাঁও।
উত্তরগাঁওয়ের লোকদের খেয়াল হলো, তাদের গাঁয়ে একটা স্কুল দরকার। মোড়ল-মাতব্বররা বসে সিদ্ধান্ত নিলেন, একটা স্কুল করবে। সরকারি নয়, তাই গাঁয়ের ধনী লোকদের দানের টাকায় দেয়া হবে মাস্টারের বেতন। স্কুল করা হলো, শহর থেকে চোস্ত ইংরেজি জানা একজন মাস্টার নিয়ে এসে চালু হলো স্কুল।
স্কুল ভালোই চলছিল, কিন্তু ব্যাপারটা হজম করতে পারল না দক্ষিণগাঁওয়ের লোকেরা। উত্তরগাঁওয়ের ছেলেমেয়েরা স্কুলে পড়াশোনা শিখে এগিয়ে যাবে, আর তাদের গ্রাম পিছিয়ে থাকবে, এ হতে পারে না। তারাও বসে সিদ্ধান্ত নেয়, একটা স্কুল তৈরি করবে এবং সেটা দ্রুত। সত্যি সত্যি তারাও স্কুল বানায়, একজন ভালো ইংরেজি জানা শিক্ষক নিয়োগ দেয়।
দুই স্কুলই চলছিল, কিন্তু যতটা আবেগ নিয়ে শুরু হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত সেই আবেগটা আর টিকে থাকেনি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুব বেশি নয়। ধনীরাও টাকা দিতে কার্পণ্য করছেন। শুধু শিক্ষার্থীদের বেতনের টাকায় মাস্টারের বেতনে কুলাচ্ছিল না।
এই অবস্থায় দুই গ্রামের সাধারণ মানুষ বুঝতে পারল, দুটো স্কুল রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বরং দুই স্কুলের শিক্ষার্থীদের যদি এক স্কুলে নেয়া হয়, তাদের বেতনের টাকায় দিব্যি মাস্টারের বেতন পরিশোধ করা সম্ভব। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, একটা স্কুল বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু কোনটা?
ঠিক হলো, যে স্কুলের শিক্ষক বেশি মেধাবী, সেই স্কুল টিকে থাকবে। তখন মেধার বিচার করা হতো, কে কতটা ইংরেজি জানে, তার ভিত্তিতে। সুতরাং দুই গ্রামের লোকেরা মিলে দিনক্ষণ ঠিক করল। দুই গ্রামের মাঝখানে যে বটতলা আছে, সেখানে হবে দুই পণ্ডিতের লড়াই। লড়াই হবে অবশ্যই ইংরেজিকে ভিত্তি করে। যিনি যত ভালো ইংরেজি জানেন তিনি বিজয়ী হবেন এবং তার স্কুল টিকে থাকবে। কিন্তু সমস্যা হলো- দুই গাঁয়ের কেউ ইংরেজি জানেন না। তাই দুই পণ্ডিতকেই একই সঙ্গে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। যথারীতি লড়াই শুরু হলো, দুই গাঁয়ের লোকে লোকারণ্য বটতলা। কে বিজয়ী হয়, দেখার জন্য তাদের আগ্রহের শেষ নেই।
যথাসময়ে লড়াই শুরু হলো। প্রথমে উত্তরগাঁও স্কুলের পণ্ডিত একটা কঠিন ইংরেজি প্রশ্ন করলেন, দক্ষিণগাঁয়ের পণ্ডিত অবশ্য উত্তরটা দিলেন ঠিকঠাক মতো। উত্তরগাঁওয়ের পণ্ডিত স্বীকার করলেন যে, দক্ষিণগাঁওয়ের পণ্ডিত ঠিকঠাক উত্তর দিয়েছেন। দক্ষিণগাঁওয়ের লোকের হাততালি দিল, প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলো দক্ষিণগাঁওয়ের লোকেরা।
জনতার কোলাহল কমে এল, এবার দক্ষিণগাঁওয়ের পণ্ডিত উত্তরগাঁওয়ের পণ্ডিতকে প্রশ্ন করলেন। প্রশ্নটা খুব সহজ, আসলে গ্রামবাসীদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে ফাঁদে ফেলা হয়েছিল, উত্তরগাঁওয়ের পণ্ডিতকে। দক্ষিণগাঁওয়ের পণ্ডিত প্রশ্ন করেছিলেন, ‘I don’t know’ এই বাক্যটার বাংলা অর্থ কী হবে?
সহজ প্রশ্ন, তাই সহজভাবেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন উত্তরগাঁওয়ের শিক্ষক, বলেছিলেন, এই বাক্যের অর্থ ‘আমি জানি না।’ কিন্তু গাঁয়ের মূর্খ জনতা কি সেটা বোঝে! তারা দেখল উত্তরগাঁওয়ের পণ্ডিত ইংরেজি বাক্যটার অর্থ জানেন না। দক্ষিণগাঁওয়ের লোকেরা হাততালি দিল, উত্তরগাঁয়ের লোকেদের নাক কাটা পড়ল লজ্জায়। শেষমেষ উত্তরগাঁয়ের পণ্ডিতকে বিদায় করে সেই স্কুলটা বন্ধ করে দেয়া হলো।
সেই কিশোরবেলায় গল্পটা আমাকে নাড়া দিয়েছিল। লেখক হাস্যরসের মাধ্যমে উত্তরগাঁয়ের পণ্ডিতকে বিদায় করেছিলেন, তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন, বুদ্ধির খেলায় হেরে গিয়ে কীভাবে উত্তরগাঁওয়ের পণ্ডিতকে অপদস্ত হতে হয়েছিল। কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা ইনজাস্টিস মনে হয়েছিল। উত্তরগাঁয়ের পণ্ডিত হারেননি, তাকে চালাকি করে হারানো হয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা, উত্তরগাঁওয়ের লোকেরাই আগে লেখাপড়ার মর্মটা বুঝতে পেরেছিল, তাদের স্কুলটাকেই কিনা উঠিয়ে দিতে হলো! এ জন্য সেই লেখককে আমি আজও ক্ষমা করতে পারিনি। পরে যখন লেখালেখিতে এলাম, তখন মনে হয়েছিল, গল্পটা আমি নতুন করে লিখব। এতদিনে সেই সুযোগ পাওয়া গেল।
আমরা বরং গল্পে ফিরে যাই। দক্ষিণগাঁওয়ের লোকেরা তাদের, পণ্ডিতকে যখন কাঁধে তুলে উল্লাস করছে, উত্তরগাঁয়ের পণ্ডিত তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন, চালাকিটা কোথায়। কিন্তু কে শোনো কার কথা। তখন উত্তরগাঁয়ের পণ্ডিত গেলেন, সেই গ্রামের মোড়লের কাছে, মোড়ল নিরক্ষর হলেও একেবারে মূর্খ নন। তিনি বুঝলেন, তাদের পণ্ডিতকে কীভাবে কথার মারপ্যাঁচে ফেলে হারানো হয়েছে।
মোড়ল চেঁচিয়ে, ধমক দিয়ে বললেন, থাম সবাই, প্রতিযোগিতা শেষ হয়নি এখনো। একটা-দুটো ইংরেজির মানে একজন না-ই জানতে পারেন। তার মানে এই নয়, তিনি খারাপ পণ্ডিত। কিন্তু বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, সেটাই যদি না জানেন, সেই পণ্ডিত ছাত্রদের কী পড়াবেন?
কী, তাদের পণ্ডিত বাংলা জানে না, কঠিন ইংরেজি যিনি পানির মতো সহজে জবাব দিতে পারেন, তিনি বাংলা জানবেন না, তা কী করে হয়। আসলে উত্তরের পণ্ডিত হারটা হজম করতে পারেননি, তাই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। দক্ষিণের পণ্ডিতের উচিত এর দাঁতভাঙা জবাব দেয়া। তাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে আবার মঞ্চে তুলে দেয়া হলো। ততক্ষণে পণ্ডিতের মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে, বুঝতে পেরেছেন ইটের বদলে পাটকেল খেতে হবে এখন।
উত্তরগাঁয়ের পণ্ডিত মৃদু হেসে তার ঝোলায় হাত ঢোকালেন। বের করে আনলেন একটা বাংলা বই। বললেন, দক্ষিণের পণ্ডিত, আপনি যেমন জ্ঞানী, তেমনি বুদ্ধিমান। কিন্তু বাংলাটা পড়তে এখনো শেখেননি৷ এই নিন, পড়ে বলুন, এই বইটার নাম কী?
উত্তরের পণ্ডিত বইটা হাতে নিয়ে ঝটপট পড়ে ফেললেন, বইয়ের প্রচ্ছদে লেখা ছিল, ‘এই বইয়ের নাম কী?’
সবাই শুনল সেটা, কিন্তু বুঝল না। তারা বুঝল উত্তরগাঁওয়ের পণ্ডিত যে প্রশ্নটা করেছেন, সেটাই আউড়েছেন দক্ষিণের পণ্ডিত, কিন্তু বইয়ের নামটা তিনি পড়তে পারেননি। বাংলাই যিনি পড়তে পারেন না, তাকে পণ্ডিত হিসেবে কীভাবে রাখা যায়!
*যুক্তিবিদ্যার এই প্যারাডক্সটার নাম ‘What’s the name of this book?’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।