জুমবাংলা ডেস্ক : বাংলাদেশে বর্তমানে এক ডজনেরও বেশি সংখ্যক মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে কিছু রয়েছে, যেগুলোর কাজ পুরোপুরি শেষ না করেই গত নির্বাচনের আগে ‘আংশিক উদ্বোধন’ ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ সরকার।
আবার এমন প্রকল্পও রয়েছে, দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানোর পরও যেগুলোর নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি।
এতে একদিকে যেমন খরচ বেড়েছে, তেমনি দীর্ঘদিন নির্মাণ কাজ চলার কারণে সৃষ্ট ধুলা-বালি, শব্দ দূষণসহ নানা সমস্যায় ভোগান্তি বেড়েছে সাধারণ মানুষের।
কিন্তু মেগা প্রকল্প গুলো কোনটি কতটুকু এগিয়েছে? সেগুলো শেষই-বা হবে কবে?
খুলনা-মংলা রেলপথ
প্রকল্পটি তিন বছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পেরিয়ে গেছে ১৩ বছর। মেয়াদ বাড়ার সাথে প্রকল্পের খরচ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
একযুগ পর এখন বাণিজ্যিক চলাচলের জন্য লাইনটি প্রস্তুত বলে জানাচ্ছেন প্রকল্পটির পরিচালক মো: আরিফুজ্জামান।
আরিফুজ্জামা বলেন, ‘আমাদের মূল নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এখন ফিনিশিংয়ের কিছু কাজ চলছে। মার্চের মধ্য বা শেষভাগে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু করতে পারবে।‘
ট্রানজিট সুবিধার আওতায় ভারত, নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহন সহজ করতে ২০১০ সালে খুলনার ফুলতলা রেলস্টেশন থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ স্থাপন প্রকল্প হাতে নেয় সরকার।
এরপর নানা জটিলতার পর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৭২১ কোটি টাকা।
গত এক যুগের সেটি কয়েক দফায় বেড়ে বর্তমানে ব্যয় দাঁড়িয়েছে চার হাজার ২৬০ কোটি টাকায়। তারপরও কাজ শেষ হয়নি।
নির্বাচনের আগে গত বছরের ১ নভেম্বর অনলাইনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে খুলনা-মংলা রেলপথ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
কাজ শেষ করতে এতো সময় লাগার পেছনে নকশা পরিবর্তন, ভূমি অধিগ্রহণে সময়ক্ষেপণ, মালামাল সরবরাহে দেরি, রূপসা নদীর ওপর রেলসেতু নির্মাণ ও করোনা মহামারিসহ নানার কারণ দেখাচ্ছেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা।
ঢাকা-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প
খুলনা-মংলা রেলপথের মতো ঢাকা-গাজীপুর রুটের বিআরটি প্রকল্পটিও এক যুগ পার করে ফেলেছে।
অথচ ২০১২ সালে সরকার অনুমোদন দেয়ার পর চার বছরের মধ্যেই কাজ শেষ করার কথা বলা হয়েছিল। পরে প্রকল্পের সময় আর ব্যয় বেড়েছে। সেইসাথে বেড়েছে মানুষের ভোগান্তিও।
অবশেষে প্রকল্পটির কাজ শেষ হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পটির পরিচালক মহিরুল ইসলাম খান।
খান বলেন, ‘আমরা কাজ প্রায় শেষ করে এনেছি। চলতি বছরের ডিসেম্বরেই গাড়ি চলাচল করতে পারবে বলে আশা করি।’
প্রকল্পের ধীরগতির বিষয়ে অবশ্য কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি তিনি।
২০১১ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রকল্পের প্রাথমিক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করে অর্থায়ন করেছে। ২০১২ সালের পহেলা ডিসেম্বর একনেক বিআরটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়।
শুরুতে ব্যয় ধরা হয় দুই হাজার ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এরপর কয়েক দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে প্রকল্পের সবশেষ ব্যয় দাঁড়িয়েছে চার হাজার ২৬৮ কোটি টাকা।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
পুরো নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচনকে সামনের রেখে গত দোসরা সেপ্টেম্বর ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের আংশিক উদ্বোধন ঘোষণা করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
ফলে প্রায় ২০ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ের মধ্যে অর্ধেক, অর্থাৎ বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত এখন ব্যবহার করা যাচ্ছে।
চলতি বছরের জুনের মধ্যেই এক্সপ্রেসওয়ের বাকি অংশের কাজ শেষ করে গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার কথা রয়েছে।
কিন্তু প্রকল্প পরিচালক বলছেন, চার মাসের মধ্যে কাজ পুরোপুরি শেষ করা সম্ভব হবে না।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম এস আকতার বলেন, ‘আমাদের যে টার্গেট, ওইভাবে আমরা আগাচ্ছি। তারপরও হয়তো আরেকটু সময় লাগতে পারে।’
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ফার্মগেট থেকে যাত্রাবাড়ী অংশের অনেক জায়গায় এখনো ঢালাই কাজ শেষ হয়নি।
প্রায় আট হাজার ৯৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০২০ সালের জানুয়ারিতে।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিকে এই প্রকল্পের ৭৩ শতাংশ অর্থায়ন করছে চীন ও থাইল্যান্ডের তিনটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। বাকি ২৭ শতাংশ অর্থ দিচ্ছে সরকার।
প্রকল্পটির নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হলে ঢাকা বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে উঠে যাত্রাবাড়ি পার হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত একটানে গাড়ি যেতে পারবে।
বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতোই নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ না করেই ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালটির ‘সফট ওপেনিং’ ঘোষণা করা হয়।
নির্বাচনের আগে গত সাতই অক্টোবর টার্মিনালটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বর্তমানে এই টার্মিনালের প্রায় ৯৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক এ কে এম মাকসুদুল ইসলাম।
ইসলাম বলেন, ‘চলতি বছরের শেষ কিংবা আগামী বছরের শুরুর দিকে আমরা পুরোপুরিভাবে অপারেশনে যেতে পারবো বলে আশা করছি। সেভাবেই কাজ এগোচ্ছে।’
প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন এই টার্মিনালের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর।
জাপানের আর্থিক সহযোগিতায় সেদেশের মিৎসুবিশি, ফুজিটা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং যৌথভাবে টার্মিনালটির নির্মাণ কাজ করেছে।
শুরুতে এ বছরের মধ্যেই টার্মিনালের সব কাজ শেষ করে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করার কথা জানিয়েছিলো কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু ইসরাইল-গাজা যুদ্ধের কারণে বিদেশী নির্মাণ সামগ্রী আমদানিতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। ফলে পুরোকাজ শেষ কিছুটা দেরি হওয়ার আশঙ্কা করছেন প্রকল্প পরিচালক।
তিনি বলেন, ‘শুরু থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আমরা মালামাল আনছি জাহাজে করে। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওযার পর জাহাজ আসতে ডিলে হচ্ছে। এর ফলে অনেক সময় পরিকল্পনামতো কাজ এগোনো যাচ্ছে না।’
তবে এই সমস্যা সমাধানে অবশ্য এখন বিকল্প রুট ব্যবহার করে নির্মাণ সামগ্রী আমদানির পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন ইসলাম।
পাতাল মেট্রোরেল
উড়াল মেট্রোরেলের পর এখন দেশের প্রথম পাতাল মেট্রো রেল নির্মাণের কাজ শুরু করেছে সরকার। এই প্রকল্পের আওতায় ৩১ কিলোমিটার মেট্রোলাইনে মোট ২১টি স্টেশন নির্মাণ করার কথা রয়েছে।
এর মধ্যে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর রেল স্টেশন পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার পাতাল মেট্রোরেল নির্মাণ করা হবে। সেখানে ১২টি পাতাল মেট্রো স্টেশন রাখা হচ্ছে।
আর পূর্বাচল রুটে ঢাকার নতুন বাজার থেকে নারাণগঞ্জের পিতলগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় ১১ কিলোমিটার পথ উড়াল মেট্রোরেল নির্মাণ করা হচ্ছে।
২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পাতাল মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কিন্তু এক বছর পর এসে প্রকল্পের তেমন কোন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। পাতাল রেলের মূল নির্মাণ কাজ তো দূরের কথা, এখনো ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নের কাজই শেষ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
প্রকল্পটির পরিচালক আবুল কাশেম ভূঁঞা বলেন, ‘যে ১২টি প্যাকেজে আমরা কাজটি করছি, সেগুলোর একটির আওতায় এখন পিতলগঞ্জ ডিপোর ভূমি উন্নয়নের কাজ চলছে। বাকি ১১টি প্যাকেজের দরপত্রের আহ্বান প্রক্রিয়াধীন আছে।’
কিন্তু উদ্বোধনের এক বছর পরেও কেনো মূল নির্মাণকাজ শুরু করা গেলো না?
তিনি বলেন, ‘কোনো কাজই আমাদের টেবিলে আটকে নেই। টেকনিক্যাল ও ফাইন্যান্সিয়াল মূল্যায়নের জন্য সব কাগজপত্র জাইকার কাছে পাঠানো হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বেশকিছু দিন পেরিয়ে গেছে, কিন্তু তারা এখনও কিছু জানাচ্ছে না। টেকনিক্যাল ও ফাইন্যান্সিয়াল মূল্যায়ন করে জাইকা সম্মতি দিলেই পুরোদমে কাজ শুরু হবে।’
২০২৬ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। অথচ কাজে এখনও দৃশ্যমান তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে যথা সময়ে নির্মাণ কাজ শেষ করা নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।
কাশেম বলেন, ‘আমাদের যে পরিকল্পনা ছিল, সেখানে ইতিমধ্যেই বেশখানিকটা পিছিয়ে পড়েছি। আমরা চেষ্টা করবো আগামীতে সেটি পুষিয়ে নেয়ার। তবে এভাবে কাজ আটকে থাকলে নির্ধারিত সময়ে শেষ করা কঠিন হবে।’
এতে প্রকল্প ব্যয়ও বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পাতাল মেট্রোরেল ইতিমধ্যেই দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্পগুলোর একটি। প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা।
এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন (জাইকা) ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ৩৯ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। বাকি ১৩ হাজার ১১১ কোটি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
বাংলাদেশ সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় শীর্ষে থাকা মেগা প্রকল্পগুলোর একটি হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
২০১৩ সালের অক্টোবরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণের প্রথম পর্যায় কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এর একযুগেরও বেশি সময় পর এখন বাণিজ্যিক উৎপাদনের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
চলতি বছরের শেষদিকে দু’টি চুল্লির একটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর।
আকবর বলেন,‘আশা করছি, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ আমরা উৎপাদনে যেতে পারবো এবং সেই বিদ্যুৎ সরাসরি জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ায় মানুষ সফল ভোগ করতে পারবে।’
২০২১ সালের দশই অক্টোবর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম চুল্লির উদ্বোধন করার হয়।
এরপর দুই বছর পর ২০২৩ বছরের অক্টোবরে রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানির প্রথম চালান বুঝে পায় বাংলাদেশ।
কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে এটি জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে, সেই লাইন পুরোপুরি প্রস্তুত না থাকায় উৎপাদন যাওয়া সম্ভব হয়নি।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সচরাচর অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো নয়। কারণ, এই কেন্দ্র একবার চালু হলে এরপর চাইলেই সাথে সাথে বন্ধ করা সম্ভব না।
তাই এক্ষেত্রে উৎপাদন শুরুর আগেই গ্রিড সিস্টেম নিশ্চিত করতে হয়। এই সঞ্চালন লাইনের কাজ করছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ।
সেপ্টেম্বর নাগাদ প্রথম ইউনিটের এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করার মতো সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত হয়ে যাবে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এছাড়া ২০২৫ সালের শেষের দিকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটেও উৎপাদন শুরু হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক আকবর।
একক প্রকল্প হিসেবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প।
এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রাথমিকভাবে এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ ধরা হয়েছে। এই প্রকল্পের ৯০ শতাংশ অর্থায়ন করছে রাশিয়া।
১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২৮ বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতেও সহযোগিতা করছে রাশিয়ার আনবিক শক্তি কর্পোরেশন ‘রোসাটম’। তারা প্রয়োজনীয় জ্বালানিও সরবরাহ করছে।
মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন কয়লাভিত্তিক একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে সরকার। এটিও বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক একটি মেগা প্রকল্প।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০১৪ সালে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনের (জাইকা) সাথে একটি ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করে সরকার।
তবে নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের অগাস্টে। ইতিমধ্যেই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রের দু’টি ইউনিটের একটিতে উৎপাদনও শুরু হয়ে গেছে।
প্রকল্পটির পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন,‘নির্ধারিত সময়ের একমাস আগেই আমরা কাজ শেষ করেছি। গত ডিসেম্বরেই প্রথম ইউনিটে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে, যা ইতিমধ্যেই জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে।’
গত জানুয়ারিতে দ্বিতীয় ইউনিটেও পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এ পর্যায়ে সফল হলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই হয়তো আমরা পুরোপুরিভাবে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারব।’
এখন পর্যন্ত এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি কয়লার ব্যবস্থা করছে প্রকল্পটির অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান জাইকা। তবে চুক্তি অনুযায়ী, পুরোদমে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হলে প্রতিষ্ঠানটি আর জ্বালানি নিশ্চিত করতে বাধ্য থাকবে না।
অন্যদিকে, রিজার্ভ সংকটের মধ্যে কয়লা আমদানি করে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র সচল রাখা কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আজাদ বচলেন, ‘বিষয়টি মাথায় রেখেই আমরা জাইকার সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি যেন তারা সামনেও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করে।’
তবে জাইকা এটি করবে কী-না, সেটি এখনও নিশ্চিত নয়।
প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘তারা এখনো কিছু জানায়নি। তবে আমরা আশা করছি, তারা জ্বালানি নিশ্চিত করবে। যদি রাজি না হয়, সেক্ষেত্রে জ্বালানির বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিবে।’
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫১ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা।
এর মধ্যে জাইকার অর্থায়ন রয়েছে প্রায় ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। বাকি টাকার অর্থায়ন করছে বাংলাদেশ সরকার। একই সক্ষমতার অন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে এটি ব্যয়বহুল।
এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, প্রকল্পটিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশাপাশি কয়লা লোড-আনলোড জেটি, টাউনশিপ, সঞ্চালন লাইন এবং সংযোগ সড়ক নির্মাণসহ আরো বেশকিছু খরচের খাত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
পদ্মাসেতু রেল সংযোগ
পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত প্রায় ১৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ রেল ট্র্যাক নির্মাণ করছে সরকার।
২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। এর প্রায় পাঁচ বছর পর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে প্রকল্পটির আংশিক উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়।
২০২৩ বছরের ১০ অক্টোবর ঢাকার গেন্ডারিয়া থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৮২ কিলোমিটার অংশ ট্রেন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়।
বর্তমানে ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত অংশের নির্মাণ কাজ চলছে। প্রকল্প অনুযায়ী, চলতি বছরের জুনের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
প্রকল্পটির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন যে গতিতে কাজ চলছে, তাতে মনে হচ্ছে নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ করে ফেলতে পারবো।’
সার্বিকভাবে প্রকল্পটির ৯০ শতাংশেরো বেশি অংশের কাজ শেষ হয়েছে বলেও জানান তিনি।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি ২০১৬ সালের মে মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পায়।
সে সময় এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ২২ মে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করলে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা।
এই অর্থের মধ্যে প্রায় ২১ হাজার ৩৭ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে। বাকি অর্থ ব্যয় করছে বাংলাদেশ সরকার।
আরো যত প্রকল্প
আরো কিছু প্রকল্পের কাজ এখন চলমান রয়েছে।
উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যে উড়াল মেট্রোরেলের কাজ শেষ হয়েছে, সেটি এক কিলোমিটার বাড়িয়ে এখন কমলাপুর পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে।
নতুন অংশের প্রায় ২৬ শতাংশ নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। পুরো কাজ শেষ হবে ২০২৫ সালে।
একইসাথে, মেট্রোরেলের নদার্ন রুটে প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ লাইন নির্মাণে ভূমি অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে। সাভারের হেমায়েতপুর থেকে শুরু হয়ে রুটটি যাবে ভাটারা পর্যন্ত যাবে। উড়াল-পাতাল মিলিয়ে এই রুটটির নির্মাণকাজ শেষ হবার কথা রয়েছে ২০২৮ সালে।
ঢাকায় দ্বিতীয় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হিসেবে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ২০২৬ সালের জুনে চালু হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক শাহাবুদ্দিন খান।
ইতোমধ্যে প্রকল্পটির ৩০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলেও জানিয়েছেন খান। সরকার ২০১৭ সালের অক্টোবরে প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় সরকার।
প্রায় ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে মোট খরচ ১৬ হাজার ৯০১ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এর মধ্যে চীন ঋণ হিসেবে ৬৫ শতাংশ খরচ দিচ্ছে।
এদিকে, দেশের প্রথম এবং একমাত্র গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের জন্য ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এরমধ্যে সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে আট হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা।
২০২০ সালে অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই প্রকল্পে ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপান।
বাকি অর্থের মধ্যে সরকার দিচ্ছে দুই হাজার ৬৭১ কোটি টাকা এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দুই হাজার ২১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে।
ঋণ ও রিজার্ভ
গত দুই বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে।
২০২১ সালের অগাস্টে যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল প্রায় ৪৮ বিলিয়ন ডলার, সঙ্কটের কারণে সেটি অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে ২০ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার।
তবে রিজার্ভ কমে যাওয়ায় সরাসরি তেমন কোন প্রভাব পড়েনি মেগা প্রকল্পগুলোতে। কারণ প্রকল্পগুলোর প্রায় সবগুলোরই কাজ চলছে বিদেশি অর্থায়নে।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম এস আকতার বলেন, ‘তারা টাকা দিচ্ছে, আমরা কাজ করছি। ফলে বাংলাদেশের ডলার সঙ্কটের তেমন কোনো প্রভাব আমাদের কাজের ওপর পড়ছে না।’
বাংলাদেশে চলমান মেগা প্রকল্পগুলোতে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পাশাপাশি রাশিয়া, চীন, জাপান, ভারত-সহ আরো কয়েকটি দেশ অর্থায়ন করছে।
ফলে মেগা প্রকল্পের ব্যয়জনিত কারণে অর্থনীতিতে আপাতত তেমন কোনো চাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তবে আগামী কয়েকে বছরের মধ্যেই পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘২০২৭ সালের দিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেলসহ আরও কয়েকটি মেগা প্রকল্পের ঋণ পরিশোধে সময় চলে আসবে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তখন অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে।’
কাজেই বিষয়টি মাথায় রেলে সে অনুপাতে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানো সম্ভব না হলে অর্থনীতি সংকটের মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন তিনি।
হোসেন বলেন, ‘বিদেশী মুদ্রার আয়ের ফ্লো বাড়ানোর দু’টি উপায় হচ্ছে রেমিট্যান্স আয় এবং রপ্তানি বাড়ানো। এটি নিশ্চিত করতে পারলে সঙ্কট সামাল দেয়া কঠিন হবে না।’
এক্ষেত্রে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স যেন হুন্ডি বা অন্য কোন অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে না আসতে পারে, সেটি নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই প্রধান অর্থনীতিবিদ।
রেমিট্যান্স এবং রফতানি আয় বাড়াতে ব্যর্থ হলে সঙ্কট মোবাবেলার শেষ উপায় হিসেবে সরকারের হাতে থাকবে ‘রিফাইনান্সিং’ করা। অর্থাৎ নতুন ঋণ দিয়ে পুরনো ঋণকে পরিশোধ করা।
তবে এই তিন উপায়ের মধ্যে সর্বোত্তম বিকল্প হিসেবে সরকারের আয় বাড়ানোর প্রতিই নজর দেয়া উচিত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘রিফাইনান্সিং করে তো আপনি প্রবলেমটাকে পোস্টপোন করছেন, সলভ করছেন না। তাছাড়া নতুন ঋণ নিয়ে রিফাইনান্সিং তো বার বার করতেও পারবেন না।’
সূত্র : বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।