আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ তিন বছরে গড়িয়েছে। রণক্ষেত্রের অচলাবস্থায় ফল নির্ধারণকারী কোনও পরিবর্তন শিগগিরই হবে না বলে মনে করছেন পশ্চিমা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, মূল যুদ্ধ এখন রাজনৈতিক। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বাজি ধরছেন পশ্চিমাদের বিভক্তি ও দ্বিধার ওপর। তিনি আশা করছেন, রণক্ষেত্রে তিনি যা অর্জন করতে পারেননি, সেই জয় তার হাতে তুলে দেবে পশ্চিমারা।
যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া ও ইউক্রেনের পতনের পরিণতির আশঙ্কায় সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সহযোগিতার পরিমাণ বাড়িয়েছে ইউরোপীয় সরকারগুলো। সমন্বিতভাবে তাদের সরবরাহ বা প্রতিশ্রুত অস্ত্রের পরিমাণ ওয়াশিংটনের চেয়ে বেশি। আর্থিক সহযোগিতা অন্তর্ভুক্ত করলে তা দ্বিগুণ হতে পারে। যুদ্ধের প্রথম দিকের তুলনায় এটি বড় পরিবর্তন। কিন্তু এই পরিবর্তনও যুদ্ধের গতির ইউক্রেনের পক্ষে আনতে পারেনি।
এই যুদ্ধের সমাপ্তি কখন ও কীভাবে ঘটবে? ক্রেমলিন একরোখাভাবে স্পষ্ট করেছে, ইউক্রেন আত্মসমর্পণ করলেই কেবল তারা আলোচনায় বসবে। অপর দিকে ইউক্রেন একইভাবে বলেছে, তারা মস্কোর আক্রমণ মোকাবিলা করে যাবে। দুই বছর পরও ইউরোপে শান্তির কোনও ইঙ্গিত স্পষ্ট হচ্ছে না।
ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধে আগামীতে কী ঘটতে পারে, তা নিয়ে আটজন বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলেছেন মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফরেন পলিসি। তাদের মধ্যে চারজনের বক্তব্য তুলে ধরা হলো-
কলামিস্ট, ফরেন পলিসি ও সিনিয়র পলিসি ফেলো, ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স
রাশিয়ার ওপর দুই বছরের পশ্চিমা আর্থিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা থেকে আমরা কী শিখেছি? তিনটি প্রতিপাদ্য এগিয়ে যাওয়ার পথ নির্ধারণ করবে। প্রথমত, মস্কো নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তথ্য যুদ্ধে জয়লাভ করছে, কারণ সাধারণভাবে মনে করা হয় নিষেধাজ্ঞার এই ব্যবস্থাগুলো অকার্যকর। বিপরীত যুক্তি তুলে ধরা কঠিন: ক্রেমলিন ও এর সমর্থকরা নিষেধাজ্ঞার সাফল্য তুলে ধরার মতো সাহসী যে কাউকে ভয় দেখাতে সক্রিয়। (একটি সত্যিকারের প্রশ্ন: নিষেধাজ্ঞাগুলো যদি সত্যিই অকার্যকর হয়, তাহলে ক্রেমলিন কেন তাদের বিরুদ্ধে এত ব্যস্ত?) পশ্চিমা জনগণের মধ্যে নিষেধাজ্ঞার ব্যর্থতার প্রতি তির্যক বিতর্ক সহযোগিতা করছে না। সংবাদপত্রের শিরোনামগুলো সাধারণত সেমিকন্ডাক্টর ধরে রাখার জন্য রাশিয়ার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে এমন প্রতারণামূলক স্কিমগুলোর ওপর আলোকপাত করছে। চোরাচালান অবশ্যই বিদ্যমান, কিন্তু শিরোনামগুলোতে যা উঠে আসছে সে তুলনায় বাস্তব পার্থক্য আরও সূক্ষ্ণ। বৃহৎ চিত্রটি হলো, রাশিয়ার আধুনিক মানের প্রযুক্তির আমদানি যুদ্ধ-পূর্ব সময়ের তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ কমে গেছে। অথচ এখন রাশিয়ার অত্যাধুনিক চাহিদা এত বেড়েছে, যা এর আগে কখনও ছিল না। মস্কোর যুদ্ধযন্ত্রকে থামানোর জন্য এটি যথেষ্ট নয় এবং রফতানি নিয়ন্ত্রণকে আরও শক্তিশালী করার জন্য আরও কিছু করা দরকার। তবুও ৪০ শতাংশ কমে যাওয়া নিষেধাজ্ঞার একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য।
দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রভাব ক্রমবর্ধমানভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে-বিশেষ করে পশ্চিমা সরঞ্জাম এবং জ্ঞান থেকে বঞ্চিত খাতগুলোতে। যেমন-মহাকাশ ও জ্বালানি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় প্রযুক্তির অভাবের সময় রাশিয়ার সংস্থাগুলোকে ক্রমবর্ধমান রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। এস-সেভেন নামের একটি সাইবেরীয় এয়ারলাইনকে তাদের এয়ারবাস উড়োজাহাজগুলোকে বসিয়ে রাখতে হয়েছিল এবং ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশের অভাবে জানুয়ারিতে অনেক কর্মী ছাঁটাই করেছিল। একই মাসে রাশিয়ার একটি প্রধান তেল শোধনাগার লুকোয়েলের পশ্চিমা তৈরি কম্প্রেসার ভেঙে যাওয়ার পরে একটি ইউনিট বন্ধ করতে হয়েছিল। এই ধরনের আরও ঘটনা ২০২৪ সালে সামনে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি তুলে ধরছে যে, নিষেধাজ্ঞাগুলো ম্যারাথনের মতো, স্বল্প দৈর্ঘ্যের কোনও দৌড় প্রতিযোগিতা নয়। এগুলোর ক্রমবর্ধমান প্রভাব ধীরে ধীরে স্পষ্ট হবে। সীমাহীন চীন-রুশ বন্ধুত্বের বড় দাবির পরও চীনা সরঞ্জাম রাশিয়ার উচ্চ-প্রযুক্তির চাহিদা পুরোপুরি পূরণ করতে পারছে না, অন্তত এই পর্যায়ে।
তৃতীয়ত, রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের ভবিষ্যৎ নিয়ে পশ্চিমাদের মধ্যে বিতর্ক থাকবে এবং সমমনা মিত্রদের মধ্যে আলোচনায় প্রাধান্য পাবে। একদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ইউক্রেনে স্থানান্তরের জন্য চাপ দিচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোকে। তাদের যুক্তি এমনটি করা নৈতিক: আগ্রাসনকারীকে অবশ্যই মূল্য দিতে হবে। অন্যদিকে, বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি দেশ এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করছে। তাদের যুক্তি, এটি পশ্চিমা আর্থিক অবকাঠামো এবং মুদ্রার ওপর আস্থা নষ্ট করবে। ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক (এবং, আরও চমকপ্রদভাবে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ) এই সতর্ক শিবিরে যোগ দিয়েছে। বেলজিয়ামে রাশিয়ার বেশিরভাগ অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। ইইউ দেশগুলোর সম্মতি ছাড়া এগুলো নিয়ে কিছু করা যাবে না। তবুও ব্রাসেলস, প্যারিস এবং বার্লিন সম্ভবত অবস্থান পাল্টাবে না। বিশেষত নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ট্রান্স-আটলান্টিক সম্পর্ক অপেক্ষা ও পর্যালোচনার দিকে যাওয়ার কারণে। এর ফলে, ২০২৪ সালে রাশিয়ার রিজার্ভ বাজেয়াপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে হচ্ছে।
কনসালটিং সিনিয়র ফেলো, ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ
পশ্চিমা অস্ত্র সরবরাহের ওপর নির্ভরতা কমাতে ইউক্রেন ক্রমশ নিজস্ব উৎপাদনে মনোনিবেশ করছে। ফলাফল স্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ার নৌবহরে হামলায় নিজেদের উৎপাদিত সামুদ্রিক ড্রোন ব্যবহার করেছে। রাশিয়ার গভীরে প্রতিরক্ষা-সম্পর্কিত স্থাপনা ও অবকাঠামোতেও দেশে তৈরি অস্ত্র ও ড্রোন ব্যবহার করেছে তারা। যদিও কিয়েভ খুব কম এসব আক্রমণের বিষয়ে মন্তব্য করে। তবে এসব হামলা ইউক্রেনের তৈরি ড্রোন দিয়েই করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।
২০২৪ সালের প্রতিরক্ষা বাজেটে এখনও বিদেশি সরঞ্জাম কেনার জন্য প্রায় ৬.৮ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রেখেছে ইউক্রেন।
ইউক্রেন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির কারণে নিজের অস্ত্র শিল্পের বিকাশ ও প্রসারিত করতে চাইছে। এতে পশ্চিমা সরকার, প্রতিরক্ষা কোম্পানি ও বেসরকারি উদ্যোগের সহযোগিতা পাচ্ছে। যেমন- জার্মানির রাইনমেটাল চলতি বছর ইউক্রেনে সাঁজোয়া যান তৈরি শুরুতে চাইছে। কিয়েভের অ্যালায়েন্স অব ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগের সুবিধার্থে এবং উৎপাদন স্থানীয়করণের জন্য বিদেশি সংস্থাসহ ৬০টিরও বেশি সংস্থাকে নিয়োগ দিয়েছে। তুর্কি ড্রোন নির্মাতা বায়কার ঘোষণা দিয়েছে তারা ইউক্রেনে একটি ড্রোন কারখানা নির্মাণ শুরু করেছে।
অস্ত্র নির্মাণ ও তৈরির নতুন উপায়ে একটি পরীক্ষাগারে পরিণত হচ্ছে ইউক্রেন। খুব বেশি সরকারি নির্দেশনা ছাড়াই বেসরকারি খাত ও নাগরিক উদ্যোগগুলো ইলেকট্রনিক যুদ্ধ ব্যবস্থা, সাইবার নিরাপত্তা, হামলার ড্রোন, সামুদ্রিক ড্রোন, যুদ্ধাস্ত্র, যুদ্ধ ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি এবং আরও অনেক কিছুতে সহযোগিতার একটি বিকেন্দ্রীকৃত উদ্ভাবন ইকোসিস্টেম গড়ে তুলেছে। কিয়েভ একটি সমন্বয় মঞ্চ গড়ে তুলেছে। যেখান থেকে এসব উদ্যোগের জন্য হাজারো প্রকল্পের আবেদন পেয়েছে। ফলাফল হিসেবে কয়েক ডজন প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়েছে। ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি পরীক্ষিত নতুন অস্ত্রের সনদ প্রদানের প্রক্রিয়া সংস্কার ও ত্বরান্বিত করেছে। কীভাবে উদ্ভাবন করা যায় তা নয় বরং দক্ষ শ্রমের ঘাটতি, সরবরাহ শৃঙ্খলের বাধা, দুর্নীতি এবং রাশিয়ার আক্রমণের কারণে কীভাবে উৎদন বাড়ানো যায় তা হলো মূল চ্যালেঞ্জ।
ইউক্রেনের সামরিক শিল্পের ভিত্তি সম্প্রসারণের একটি সম্ভাব্য উপায় হলো, ন্যাটো ভূখণ্ডে পশ্চিমা কোম্পানির সঙ্গে লিখিত চুক্তির আওতায় যৌথ উৎপাদন। যা একটি নির্দিষ্ট বিনিয়োগ তহবিল দ্বারা পরিচালিত হবে। এটি শুধু পশ্চিমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইউক্রেনে ন্যাটো মানের অস্ত্রের স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করবে তা নয়, এতে মস্কোর কাছে একটি শক্তিশালী বার্তাও পাঠানো যাবে। আর তা হলো- মস্কোর হাতে হয়ত সময় নেই এবং অস্থিরতা থাকলেও পশ্চিমারা কিয়েভের পক্ষেই আছে।
ডেভিড পেট্রাউস
চেয়ারম্যান, কেকেআর গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের এবং সাবেক সিআইএ পরিচালক ও অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন জেনারেল
ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যেকোনও প্রশ্নের উত্তরের শুরুতে বলতে হবে, এটি অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। কারণ প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধের গতিপথ অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির ওপর নির্ভরশীল।
সবার আগে থাকবে, মার্কিন কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত কোন মাত্রার সহযোগিতা অনুমোদন দেবে। এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ পুরো ইউরোপ সমন্বিতভাবে যে সামরিক সহযোগিতা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র একাই প্রায় সমান সহযোগিতা করেছে। আরও নির্ভর করবে, পশ্চিমা ট্যাংক ও যুদ্ধবিমানের মতো নির্দিষ্ট অস্ত্র সরবরাহে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের ওপর। তাদের দেখাদেখি অন্যান্য দেশও এসব অস্ত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অতীতে।
আর্থিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ইউরোপীয় দেশগুলো ইউক্রেনকে দ্বিগুণ সহযোগিতা দিয়েছে। ফলে ইউরোপীয় সহযোগিতা কোন পর্যায়ে থাকবে তাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং রফতানি নিয়ন্ত্রণ কঠোর করার জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন প্রচেষ্টা এবং এগুলো এড়ানোর উদ্যোগ বন্ধ করাও গুরুত্বপূর্ণ। এখন পর্যন্ত যথেষ্ট সাফল্য থাকা সত্ত্বেও, নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর কৌশলগুলো বিকশিত হচ্ছে এবং তা ঠেকাতে নিয়মিত মনোযোগ প্রয়োজন হবে।
নিরাপত্তা সহায়তার মধ্যে আরও কিছু সরঞ্জাম বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অদূর ভবিষ্যতে ইউক্রেন এমন ব্যবস্থা পেতে পারে যা দেশটিকে আক্রমণকারী ড্রোন, রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিমান শনাক্ত করতে, চিহ্নিত করতে এবং ধ্বংস করতে সক্ষম করে তুলবে। ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ চাহিদার মধ্যে রয়েছে দূরপাল্লার নির্ভুল ক্ষেপণাস্ত্র, পশ্চিমা যুদ্ধবিমান, কামানের গোলাবারুদ এবং অতিরিক্ত ক্লাস্টার বোমা, যা রাশিয়ার আক্রমণ প্রতিরোধে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়েছে।
বলা বাহুল্য, যুদ্ধের গতিপথ ইউক্রেনীয় ও রুশদের সংকল্প ও দৃঢ়তার ওপর নির্ভর করবে। নতুন সেনা নিয়োগের সক্ষমতা, প্রশিক্ষণ, অস্ত্রে সজ্জিত করার ক্ষেত্রে দেশ দুটির নিজ নিজ সক্ষমতার ওপরও অনেক বেশি নির্ভর করবে। পুতিনের হাতে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধ এগিয়ে যেতে থাকলে ক্রমবর্ধমান হতাহতের সংখ্যা ও প্রাণহানির পর মানুষের এই সমর্থন অটুট থাকবে বলে ধরে নেওয়াও উচিত হবে না।
এগুলোর পাশাপাশি অনেক কিছু নির্ভর করবে উভয়পক্ষের মনুষ্যবিহীন সক্ষমতার ওপর। যেমন- ইউক্রেনের তৈরি সামুদ্রিক ড্রোনের হামলায় রাশিয়া বাধ্য হয়েছে ক্রিমিয়া থেকে নৌবহরের শক্তি সরিয়ে নিতে। এর ফলে কৃষ্ণ সাগর দিয়ে বিভিন্ন দেশে শস্য রফতানি করতে পারছে কিয়েভ।
পশ্চিমা দেশগুলোতে জব্দ থাকা রাশিয়ার ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রিজার্ভ যদি ইউক্রেনকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়া হয় তাহলে তা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। এতে রাশিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ইউক্রেন নিজেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরও সক্ষম করে তুলতে পারবে।
শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের গতিপথ নির্ভর করবে উভয়পক্ষের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ ও যুদ্ধক্ষেত্রে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতার ওপর। এছাড়া নতুন অস্ত্র ব্যবস্থা এবং অন্যান্য প্রযুক্তির বিকাশ, উৎপাদন ও মোতায়েন এবং নেতৃত্ব, কর্মকর্তা, সেনা ও ইউনিটগুলোর দক্ষতার উন্নয়নের ওপর তা কিছুটা নির্ভর করবে।
উভয় দেশের সেনাবাহিনীর জন্য বছরটি রণক্ষেত্রে কঠিন সময় হতে পারে। দুই বছর পরও যুদ্ধের কোনও সহজ সমাপ্তি দৃশ্যমান নয়।
২০২৩ সালে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অর্জনে ব্যর্থতা পশ্চিমাদের মধ্যে গভীর বিভাজন তৈরি করেছে। এই বিভাজন অপ্রত্যাশিত মনে হতে পারে, কিন্তু আশ্চর্যজনক নয়। যেকোনও বড় যুদ্ধে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তা শক্তিশালী প্রভাব ফেলে। সামরিক বিপর্যয় প্রায়ই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটকে তীব্র করতে পারে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার আক্রমণের ফলে ইউরোপ ও পশ্চিমাদের গড়ে ওঠা ঐক্যে এখন যুদ্ধ ও শান্তির শর্ত সম্পর্কিত ইস্যু গুরুতর পার্থক্যের জন্ম দিয়েছে। এই বিভাজনগুলো মার্কিন রাজনৈতিক শ্রেণির মধ্যে, যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যে, পশ্চিম ও পূর্ব ইউরোপ এবং মধ্য ইউরোপে তীব্র। ইউক্রেন রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করার জন্য চড়া মূল্য দিয়েছে, যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রেও দেশটি বিভাজন থেকে রক্ষা পায়নি। এ সব প্রকাশ্য বিভাজন রাশিয়ার আপাত ঐক্যের বিপরীত। গত জুনে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মস্কোতে ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনার গোষ্ঠীর বিদ্রোহের নিজের নিয়ন্ত্রণ আরও সুসংহত করেছেন।
যুদ্ধের দ্রুত ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের ফলে অভ্যন্তরীণ সমন্বয় রক্ষা করার জন্য সব পক্ষের সক্ষমতা পরীক্ষায় পড়বে। যদিও কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা রাশিয়াকে তার নিজ দেশের বিভাজন দমন করতে সাহায্য করতে পারে, তবে এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে পুতিনের যুদ্ধের বিশাল অর্থনৈতিক ও মানবিক ক্ষয়ক্ষতির কোনও রাজনৈতিক প্রভাব থাকবে না। যদিও আপাতত, প্রশ্ন হচ্ছে, পশ্চিমারা ইউক্রেন বিষয়ক অবস্থানের একাধিক বিভক্তি ঠেকাতে পারবে কিনা। রাশিয়ার চেয়ে পশ্চিমাদের বিশাল অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব মস্কোর সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহজেই জয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া উচিত। পশ্চিমারা এই সহযোগিতায় সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে ধীরগতিতে এগিয়েছে। ২০২৪ সাল আমাদের দেখিয়ে দেবে স্বল্প মেয়াদে রাশিয়ার বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে ইউক্রেনের টিকে থাকতে পশ্চিমারা প্রয়োজনীয় সহযোগিতার কৌশল গ্রহণ করতে পারছে কিনা। যে যুদ্ধ প্রত্যাশার চেয়ে দীর্ঘসময় ধরে চলছে।
ইউরোপের জন্য ইউক্রেনের যুদ্ধ দুটি ভিন্ন পথ হাজির করছে। একটি হলো নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থেকে সক্ষমতা বৃদ্ধিতে অনড় হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার সঙ্গে মহাদেশটির কৌশলগত সম্পর্কে অবনতি। অন্যটি হলো নিজেদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে ভূ-রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবনের একটি পথ, বিশ্বে মহাদেশটির ভূমিকা বাড়াতে কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি এবং এর ফলে ইউরেশিয়ায় ক্ষমতার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতার ভারসাম্য কীভাবে আসবে তা সম্পর্কে অবস্থান তৈরি। ইউরোপ যদি সত্যিকার অর্থে নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত থাকে, তাহলে মার্কিনিদের সঙ্গে রাখা সহজ হবে এবং ভবিষ্যৎ রুশ সরকারকে ভূখণ্ড সম্প্রসারণ করা থেকে বিরত রাখতে পারবে। ইউরোপীয় ভূখণ্ডের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিতে মস্কোকে বৈধ ভূমিকা পালনে রাজি করানো যেতে পারে। বিকল্প হলো, ইউরোপীয়রা আশা করতে পারে ভবিষ্যৎ মার্কিন প্রেসিডেন্ট মস্কো ও বেইজিংয়ের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার সম্ভাবনা নির্ধারণ করে দিতে পারেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।