ধর্ম ডেস্ক : আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছেন। মানুষ নিজ জীবনে আল্লাহর আনুগত্য ও পৃথিবীর বুকে তাঁর আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করে।
আর এটা মানব সৃষ্টির অন্যতম উদ্দেশ্যও বটে। ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করো, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি।
’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৩০)
আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের অর্থ
পবিত্র কোরআনে প্রতিনিধি বোঝাতে ব্যবহৃত ‘খলিফা’ শব্দের অর্থ নির্ণয়ে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, মানুষ আল্লাহর শরিয়ত প্রতিষ্ঠা, বিধান বাস্তবায়ন ও একত্ববাদের আহ্বানের ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রতিনিধি। আর আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মানুষকে আল্লাহ প্রতিনিধি বলেছেন। কেননা সে আল্লাহর মুকাল্লাফ (ইসলামী আইনের অধীন ব্যক্তি) ব্যক্তিদের ভেতর তার বিধান প্রয়োগ করে। (তাফসিরে ইবনুল জাওজি, পৃষ্ঠা-২৬)
প্রতিনিধিত্ব আল্লাহর অনুগ্রহ
পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব লাভ করা মুমিনের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই তোমাদের পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছেন। সুতরাং কেউ কুফরি করলে তার কুফরির জন্য সে নিজেই দায়ী হবে। ’ (সুরা : ফাতির, আয়াত : ৩৯)
ব্যক্তি হিসেবে নবীরাই আল্লাহর প্রতিনিধি
পৃথিবীতে ব্যক্তি হিসেবে নবী-রাসুলরাই ছিলেন সরাসরি আল্লাহর প্রতিনিধি। এ জন্য যেকোনো নবীকে আল্লাহর খলিফা বলার সুযোগ আছে। পবিত্র কোরআনে দাউদ (আ.)-কে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, ‘হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, অতএব, তুমি লোকদের মধ্যে সুবিচার কোরো এবং খেয়ালখুশির অনুসরণ কোরো না, কেননা তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। ’ (সুরা : সোয়াদ, আয়াত : ২৬)
সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিকে খলিফাতুল্লাহ বলা যাবে?
তাঁদের পরে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিকে ‘খলিফাতুল্লাহ’ বা আল্লাহর প্রতিনিধি সম্বোধন করা অনুচিত। এক ব্যক্তি ওমর (রা.)-কে খলিফাতুল্লাহ বলে সম্বোধন করলে তিনি তাকে ভর্ত্সনা করে বলেন, ‘তোমার অমঙ্গল হোক! তুমি কতই না দূরবর্তী সম্বোধন করলে। আমার মা আমার নাম রেখেছেন ওমর। তুমি যদি এই নামে আমাকে সম্বোধন করো আমি তা মেনে নেব। অতঃপর বড় হলে আমার উপনাম হয়েছে আবু হাফস। তুমি আমাকে এই নামে সম্বোধন করলে আমি তা মেনে নেব। অতঃপর তোমরা আমার ওপর তোমাদের বিষয়গুলো তথা খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করেছ এবং নাম রেখেছ আমিরুল মুমিনিন। তুমি যদি এই নামে সম্বোধন করো, সেটাই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে। ’ (আল ফুতুহাতুর রব্বানিয়্যাহ, পৃষ্ঠা-৫৬)
মুমিনরা পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি
আল্লাহ মানবজাতিকে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টি করলেও পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করেন কেবল মুমিনরা। কেননা অবিশ্বাসীরা আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের শর্তগুলো ভঙ্গ করেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে আল্লাহ তাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে তিনি অবশ্যই তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদের এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের দ্বিনকে, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন। আর তাদের ভয়ভীতির পরিবর্তে তাদেরকে অবশ্য নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে, আমার কোনো শরিক করবে না। অতঃপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারা সত্যত্যাগী। ’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৫৫)
আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব লাভের শর্ত
উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধিত্ব লাভের দুটি শর্ত আরোপ করেছেন : ঈমান আনা ও নেক কাজ করা। উভয় শর্তের অধীনে আছে আরো একাধিক শর্ত। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো—
১. আসমান তথা আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন
২. দ্বিনি লক্ষ্য অর্জনে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার
৩. অন্তরে আল্লাহর নির্দেশের প্রতি সম্মান প্রদর্শন
৪. আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ভালোবাসাকে সব কিছুর ওপর প্রাধান্য দেওয়া
৫. পরকালকে ইহকালের ওপর প্রাধান্য দেওয়া
৬. বিশুদ্ধ ঈমান ও আমলের মাধ্যমে পরকালের পাথেয় সংগ্রহ
৭. সমাজ ও রাষ্ট্রের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন; যেমন—অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান, কূটনীতি, প্রযুক্তি ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন
৮. জগত্বাসীকে মহান স্রষ্টার সঙ্গে যুক্ত করা এবং তাঁর পথে আহ্বান। (সুন্নাতুল্লাহ, পৃষ্ঠা-১৭১)
প্রতিনিধিত্ব পরিবর্তনশীল
পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব ও বৈশ্বিক নেতৃত্ব পরিবর্তনশীল। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সে বলল, শিগগিরই তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের শত্রু ধ্বংস করবেন এবং তিনি তোমাদেরকে পৃথিবীতে তাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন। অতঃপর তোমরা কী করো তা তিনি লক্ষ করবেন। ’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১২৯)
আল্লাহ অযোগ্যকে প্রতিনিধিত্ব দেন না
আল্লাহ পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধিত্ব যোগ্য ব্যক্তিদের জন্যই নির্ধারণ করেছেন। সুতরাং যারা অন্তরের বিশুদ্ধ বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে ভালো কাজ, বুদ্ধিবৃত্তি, শারীরিক সক্ষমতা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক ক্ষমতায় বলীয়ান হবে তারাই পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করবে এবং তারাই বৈশ্বিক নেতৃত্বের মুকুট লাভ করবে। যোগ্যতার ভিত্তিতে পৃথিবীর নেতৃত্ব মানুষের হাতবদল হতে থাকে। নিম্নোক্ত আয়াতগুলো থেকে যা অনুধাবন করা যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি কিতাবে প্রত্যাদেশ দ্বারা বনি ইসরাঈলকে জানিয়েছিলাম, নিশ্চয়ই তোমরা পৃথিবীতে দুইবার বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমরা অতিশয় অহংকারে স্ফীত হবে। অতঃপর এই দুইয়ের প্রথমটির নির্ধারিত কাল যখন উপস্থিত হলো, তখন আমি তোমাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছিলাম আমার বান্দাদেরকে, যুদ্ধে অতিশয় শক্তিশালী; তারা ঘরে ঘরে প্রবেশ করে সব ধ্বংস করেছিল। আর প্রতিশ্রুতি কার্যকর হয়েই থাকে। অতঃপর আমি তোমাদেরকে পুনরায় তাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত করলাম, তোমাদেরকে ধন ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা সাহায্য করলাম এবং সংখ্যায় গরিষ্ঠ করলাম। ’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৪-৬)
ধৈর্যই মুমিনের করণীয়
প্রায় শতাব্দীকাল যাবৎ মুসলিম জাতি পৃথিবীর নেতৃত্ব থেকে ছিটকে পড়েছে এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে তারা কোণঠাসা। ফলে মুমিনের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আমরা আল্লাহর প্রতিনিধি। তাহলে কেন আমরা বৈশ্বিক নেতৃত্বে নেই। এমন পরিস্থিতিতে মুমিনের করণীয় হলো ধৈর্য ও প্রত্যয়ের সঙ্গে নিজেদের বৈশ্বিক নেতৃত্বের যোগ্য করে তোলা। অবিশ্বাসীদের মন্তব্য ও তাচ্ছিল্যের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা। আর অন্তরে এই বিশ্বাস রাখা যে আমরা যোগ্য হলে আল্লাহ অবশ্যই আমাদেরকে নেতৃত্বে সমাসীন করবেন। কেননা আল্লাহর অঙ্গীকার হলো, ‘অতএব, তুমি ধৈর্য ধারণ করো, নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। যারা দৃঢ়বিশ্বাসী নয়, তারা যেন তোমাকে বিচলিত করতে না পারে। ’ (সুরা : রোম, আয়াত : ৬০)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।