আন্তর্জাতিক ডেস্ক : অক্টোবরের সাত তারিখ। প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মাত্র ২০ মিনিটের ব্যবধানে ৫ হাজারের বেশি রকেট আঘাত হানে ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থাপনায়। আর এর মূলে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। সেই হামলায় সমর্থন দেয় লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ।
হামলার পর লেগে যায় ইসরায়েল–হামাস সংঘাত। আর নতুন করে আলোচনায় আসে লেবাননের ইরান-সমর্থিত শিয়াপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। সংঘাত নিয়ে এবার প্রকাশ্যে কথা বললেন হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ। শুক্রবার এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘আমরা হামাসের জয় চাই।’ তবে গাজায় চলমান সংঘাত বন্ধেরও আহ্বান জানান তিনি।
হিজবুল্লাহ কারা?
হিজবুল্লাহ একটি শিয়া মুসলিম সংগঠন, যা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। লেবাননের সবচেয়ে শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এটি। এক প্রতিবেদনে হিজবুল্লাহ নিয়ে এমন কথাই বলেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। আর কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরা বলছে, ‘হিজবুল্লাহ’ শব্দের মানে ‘আল্লাহর দল’।
বিবিসি বলছে, গত শতকের আশির দশকের প্রথম দিকে এই হিজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী শিয়া সমর্থিত দেশ ইরানের মাধ্যমেই লেবাননে এই হিজবুল্লাহর আন্দোলন শুরু হয়। ইসরায়েলকে টেক্কা দিতেই এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলিউশনারি গার্ডস কর্পসের মাধ্যমেই এর প্রতিষ্ঠা।
লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় দেশটির দক্ষিণাঞ্চল নিজেদের দখলে নেয় হিজবুল্লাহ। ১৯৯২ সাল থেকেই দেশটির জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে আসছে সংগঠনটি। লেবাননের প্রথম সারির রাজনৈতিক দল হিসেবেও এদের বিবেচনা করা হয়।
হিজবুল্লাহ আসলে কী চায়?
প্রতিষ্ঠার প্রথমেই নিজেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে হিজবুল্লাহ। প্রকাশ করা হয়েছিল তাদের ইশতেহার। তাতে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের আধিপত্য বন্ধ করা হবে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরার এক প্রতিবেদন সে কথাই বলছে।
হামাসের মতো হিজবুল্লাহরও শক্তিশালী সামরিক শাখা রয়েছে। লেবাননে ইসরায়েলি ও মার্কিন বাহিনীর ওপর বেশ কয়েকবার ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে সেই সশস্ত্র বাহিনী। একের পর এক হামলার জেরে লেবানন থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয় ইসরায়েল। ২০০০ সালের ওই ঘটনার জন্য পুরো ‘কৃতিত্ব’ দেওয়া হয় হিজবুল্লাহকে।
ওই ঘটনার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের প্রায়ই জানান দিয়েছে হিজবুল্লাহ। বিবিসির মতে, হিজবুল্লাহর রয়েছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাজারো সেনা। লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে রয়েছে ক্ষেপণাস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডার। ইসরায়েল সীমান্তে প্রায়ই নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দেয় এরা। পশ্চিমা রাষ্ট্র, ইসরায়েল, উপসাগরীয় রাষ্ট্র ও আরব লীগ এরই মধ্যে হিজবুল্লাহকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
ইসরায়েলের সঙ্গে হিজবুল্লাহর দ্বন্দ্ব
ইসরায়েলিদের ওপর হামলা করলেও ইসরায়েলের সঙ্গে হিজবুল্লাহর বড়সড় সংঘর্ষের ঘটনা খুব একটা দেখা যায়নি। তবে ২০০৬ সালে একবার এই দুই পক্ষের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। ওই সময় সীমান্ত এলাকায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করেছিল হিজবুল্লাহ। তাতে দুই ইসরায়েলি সেনাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। মূলত ইসরায়েলে বন্দি নিজেদের সেনা ফিরিয়ে আনতেই এটি করা হয়।
ওই অভিযানের পর লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে হামলা শুরু করে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। উদ্দেশ্য ছিল হিজবুল্লাহকে পুরোপুরি নির্মূল করা। ৩৪ দিন ধরে চলে এই হামলা। একে বলা হয় ‘জুলাই যুদ্ধ’। আল–জাজিরা বলছে, এই যুদ্ধে লেবাননের এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়। মারা যায় ১৬৫ ইসরায়েলি।
তবে হিজবুল্লাহকে পুরোপুরি নির্মূল করা যায়নি। ওই সময়ও টিকে থাকে হিজবুল্লাহ। ধীরে ধীরে আবারও নিজেদের যোদ্ধা বাড়াতে থাকে। এ ছাড়া আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রও জমা করতে থাকে। এর পর বর্তমান এই অবস্থানে দাঁড়ায়। ২০০৬ সালের ওই যুদ্ধকে নিজেদের জয় বলেই দাবি করেন ১৯৯২ সাল থেকে হিজবুল্লাহ প্রধানের দায়িত্বে থাকা হাসান নাসরাল্লাহ।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরা বলছে, সীমান্ত নিয়ে ইসরায়েলকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না এই হিজবুল্লাহ। একের পর এক কামানের গোলা, আর রকেট এসে আঘাত হানলে কি আর শান্তিতে থাকা যায়! হামলার কারণে লেবানন সীমান্ত এলাকা থেকে হাজার হাজার বাসিন্দাকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে ইসরায়েল সরকার।
২০২১ সালে সংগঠনটির প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ জানান, তাঁর এই বাহিনীতে ১ লাখ যোদ্ধা রয়েছে। তাদের কাছে যেসব ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, তা দিয়ে ইসরায়েলের যেকোনো স্থানে আঘাত হানা সম্ভব।
আমেরিকা বলছে, বছরের পর বছর এই হিজবুল্লাহকে লাখ লাখ ডলার দিয়ে যাচ্ছে ইরান। লেবাননের শিয়াপন্থীরা সব সময়ই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এই দলকে।
দুই দেশের দুই সংগঠন। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য প্রায় একই, ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের হটানো। এবার হামাসের সঙ্গে যখন ইসরায়েল সংঘাতে জড়িয়ে পড়ল, তখন বসে নেই হিজবুল্লাহ। সীমান্তে কার্যক্রম চালাচ্ছে। ইসরায়েলের অভিযোগ, ইরান এরই মধ্যে হিজবুল্লাহকে ৬ হাজার যোদ্ধা দিয়েছে। তারা সীমান্তে আছে।
তবে শুক্রবারের বক্তৃতায় সংঘাত ইস্যুতে নিজেদের পরবর্তী কার্যক্রম পুরোপুরিভাবে পরিষ্কার করেননি হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ। শুধু বলেছেন, হামাসের জয় চান। আবার এও বলেছেন যে, গাজায় যুদ্ধ বন্ধ হোক। তা না হলে এই অঞ্চলে সংঘাত লেগে যাবে।
এ অবস্থায় সংগঠনটির অবস্থান কোনদিকে যাবে, তা সময়ই বলে দেবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।