জুমবাংলা ডেস্ক : দেশের ভেতরেই হোক আর বিদেশ থেকে ‘রেমিট্যান্সই’ হোক, অর্থ প্রেরণ শিল্প বা পেমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি বর্তমান সময়ের এক অপরিহার্য আর্থিক সেবা উদ্যোগ। আগে ছিল ডাক ‘মানি অর্ডার।’ সাধারণ প্রয়োজনে ছিল ডাকযোগের ‘পোস্টাল মানি অর্ডার’ আর জরুরি প্রয়োজনে ছিল ‘টেলিগ্রাফিক মানি অর্ডার (টিএমও’।
প্রাচীন যুগে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মানুষ জরুরি চিঠিপত্র, খবর, টাকা-পয়সা পাঠানোর জন্য পেশাদার দূতের শরণাপন্ন হতো। কালের বিবর্তনে পত্রদূত, ডাকপাখি (কবুতর) থেকে ডাক হরকরা, পোস্টাল সার্ভিস, টেলিগ্রাফ হয়ে মানুষ প্রবেশ করেছে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ও প্লাস্টিক কার্ডের যুগে। সর্বশেষ ধাপে খবর বা টাকা-পয়সা লেনদেনের সুযোগ এসেছে ফোনে বা ইন্টারনেটে। আমরা এখন ফোনে বা ইন্টারনেটে খবর বা টাকা-পয়সা প্রেরণের যুগে। অর্থ প্রেরণের ‘মানি অর্ডার’-এর জায়গায় এসেছে স্বয়ংক্রিয় অর্থ প্রেরণ প্রযুক্তি। গড়ে উঠেছে দেশ-বিদেশের নানা এক্সপ্রেস কুরিয়ার এবং ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি। এসেছে বিকাশ, নগদ, রকেট, মানিগ্রাম, এমক্যাশ, ভিসা ও মাস্টার, সিকিওর ক্যাশ, নেক্সাস, আই-পে, কিউ ক্যাশ প্রভৃতি।
ব্রিটিশ লাট ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতায় ‘জিপিও’ গড়ার আগ পর্যন্ত মোঘল ডাক ব্যবস্থাই চালু ছিল এ দেশে। আজ সেই ডাকঘর, ডাকবাক্স, রানার, ডাক হরকরা, ডাক শকট, ডাক টিকিট কিছুই আর আগের মতো নেই। চিঠির স্থান দখল করেছে এসএমএস এবং ইন্টারনেটের বিভিন্ন ও বিচিত্র যোগাযোগ মাধ্যম। ‘মানি অর্ডার’-এর জায়গাও দখল করেছে বিকাশ-নগদ-রকেট-এমক্যাশ। কিন্তু বেসরকারি উদ্যোগে যেসব ‘পেমেন্ট’ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, তাদের সার্ভিস চার্জ সত্যি বলতে অসম্ভব চড়া। কী এমন খরচ এর টাকা মোবাইলে ওর কাছে পৌঁছে দিতে? সার্ভিস চার্জেরও তো একটা যুক্তি থাকতে হয়? হাজারে ২০ টাকা চার্জের কী যুক্তি? এ লাইনের পূর্বসূরি ‘বিকাশ’—কথাটি সত্য। ‘বিকাশ’ মানে ব্র্যাক ক্যাশ। এটা স্বেচ্ছাসেবী ব্র্যাক সংস্থাটির সহযোগী একটি কোম্পানি। এরা বলে স্বেচ্ছাসেবী এবং কল্যাণধর্মী।
ডাকসেবা অচল হয়ে যাবে ঠাহর করতে পেরে পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর ডাক বিভাগ বহু আগে থেকে বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনায় ডাকসেবার বৈচিত্র্য এবং নিবিড় গ্রাহকসেবার প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে। তারা অলস এবং অপ্রাসঙ্গিক ডাক স্থাপনার পূর্ণ বাণিজ্যিক সদ্ব্যবহারের পথ ধরেছেন, যাতে তাদের অহেতুক রাষ্ট্রীয় কোষাগারে থেকে মাইনে দিতে না হয়, আগের ওইসব মূল্যবান স্থাপনা থেকে সাধারণ মানুষও ফায়দা পায়। এক্ষেত্রে এক নম্বর সফল একটা উদাহরণ খাড়া করা যাক। পেমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি খাতেও আমাদের অনেক কিছু করার আছে। আমরা যে শতসহস্র কোটি টাকার রেমিট্যান্স পাচ্ছি প্রবাসীদের রোজগার থেকে, এর সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণের কাজ কেন আরো লাভজনকভাবে করতে পারছি না? কেন বিদেশী মুৎসুদ্দিদের দিতে হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার কমিশন বা সেবা চার্জ? বিদেশী মালিকানাধীন আরআইএ, ভিসা, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, পেপ্যাল, স্ট্রাইপ, অ্যামাজন পে, ফাস্ট ডাটা, পে নোভা—এরা না হয় সার্ভিস চার্জ তাদের দেশের মুদ্রায় হিসাব করে বলে আমাদের জন্য জুলুম মনে হয়। কিন্তু আমাদের দেশের বিকাশ, নগদ, রকেট, মানিগ্রাম, এমক্যাশ, ভিসা ও মাস্টার, সিকিওর ক্যাশ, নেক্সাস, আই-পে, কিউ ক্যাশসহ অধিকাংশ পেমেন্ট কোম্পানি এত চার্জ রাখবে কেন? ‘বিকাশ’ করেছে বলেই কি অন্যদেরও সেটা অনুসরণ করতে হবে? ‘বিকাশ’ কোম্পানি পাইওনিয়ার। তাই তারা সেবার একটা উচ্চ হার ধরেই যাত্রা করে। তাহলে ডাক বিভাগের ‘নগদ’ হাজারে ২০ টাকার সেই জুলুম কমিয়ে ৯ টাকায় আনল কী করে? তাতেও তো তাদের লাভ রেখেই তারা সেবা দিচ্ছে। কোটি কোটি টাকা প্রচারে-সম্প্রচারে-স্থাবরে-স্থাপনায় ব্যয় করছে। এত মানুষের মাইনে দিচ্ছে। বিদ্যুৎ ও টেলিকমের বিল দিচ্ছে। ব্যান্ড উইডথের ভাড়া দিচ্ছে। অন্যরা তাহলে কম্পিটিশনে নামছে না কেন?
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ডাক বিভাগের কথা আর কী বলব? তারা তো জানত ইন্টারনেট বিপ্লবে ডাকসেবা ভেসে যাবে। তাহলে আজ থেকে ১০-১২ বছর আগেই তাদের ভাবা উচিত ছিল কোটি কোটি গ্রাহকের এ সেবাপণ্য বা সেবার বাজারটা কীভাবে ধরে রাখা যাবে। বিশ্বজুড়ে সমাদৃত ডিএইচএল কী করছে? ডিএইচএল মানে জার্মান সরকারি ডাক বিভাগ (ডয়চে পোস্ট)। কেউ তাকে আর এখন জার্মান ডাক বিভাগ বলবে না। বলবে বিশ্বের অন্যতম নেতৃস্থানীয় কুরিয়ার এক্সপ্রেস এবং লজিস্টিক সলিউশন প্রোভাইডার। সারা দুনিয়ায় তাদের কর্মীর সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখ। তারাও মুনাফা করে। তবে সেবার নিয়মনিষ্ঠা, সততা, কর্তব্যপরায়ণতা, নিজস্ব পরিবহন, গুদাম, ট্রেকিং প্রযুক্তি, এয়ারলাইনসগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক, এমনকি নিজস্ব পরিবহন বিমানবহর, আচরণবিধি, গ্রাহক সেবার মান, সময়ানুবর্তিতা তাদের একটি দেশের ডাক বিভাগ থেকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এক্সপ্রেস কোম্পানির শিরোপা এনে দিয়েছে। পরিবেশবান্ধব সেবার আন্তর্জাতিক নীতি এবং কল্যাণধর্মী সেবা আদর্শেও তারা প্রায় শীর্ষে। এটা সম্ভব হয়েছে জার্মানদের দৃষ্টিভঙ্গি ও দূরদর্শিতার ফলেই। ২০০২ সালেই তারা এ লক্ষ্যে যাত্রা করে। ২০২০ নাগাদ ডিএইচএল বিশ্বের সেরা লজিস্টিক সলিউশন প্রোভাইডিং কোম্পানি। ডিএইচএলের মতো আরো নামজাদা কুরিয়ার কোম্পানি আছে বিশ্বজুড়ে; ফেডএক্স, ইউপিএস, টিএনটি, ওওসিএল, এক্সপিও, ডিএসভি। তারা কমবেশি সবাই মুনাফামুখী প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশের ডাক বিভাগ বা ডাকসেবা বহু প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। সুলতানি আমলে তার জন্ম, মোঘল আমলে বিকাশ, ব্রিটিশ যুগে আধুনিকতা অর্জন, পাকিস্তান আমলে সক্ষমতা বৃদ্ধি, বাংলাদেশ আমলে তার পরিপূর্ণ বিস্তৃতি। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ বেশ ঘটা করেই ৯ অক্টোবর ‘বিশ্ব ডাক দিবস’ পালন করে থাকে। তবে তার ডাক পরিষেবার মান খুবই পশ্চাদপদ, ধীরগতিসম্পন্ন, অনিশ্চয়তার দোষে দূষিত।
আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের ডাকসেবায় যে চমকপ্রদ বৈচিত্র্য আসেনি, এটাও অবশ্য ঠিক নয়। তবে প্রশ্ন হলো, কত মানুষ কত সুলভে ও সহজে এসব ডাকসেবার সুবিধা পাচ্ছেন? তথ্যপ্রযুক্তির বদৌলতে কুরিয়ার এবং লজিস্টিক সেবার মতো পেমেন্ট প্রসেসিং সেবা খাতেও বেসরকারি উদ্যোক্তারা সেবার এক আলাদা জগৎ গড়ে তুলেছেন। তাদের সেবা ব্যয়বহুল। তবে সুনিশ্চিত ও জবাবদিহিমূলক। সরকারি ডাককেও সেই প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। নইলে জনগণের খাজনার টাকা স্রেফ ডাকসেবার লোকসানের ভাঙা ঝুড়িতেই নিঃশেষ হতে থাকবে। তাদের তথ্যপ্রযুক্তিপুষ্ট আধুনিকতম ডাক ব্যবস্থা, যোগাযোগ অবকাঠামো, মেইল ট্র্যাকিং প্রযুক্তি, পেমেন্ট ট্র্যাকিং ব্যবস্থা, সব সহযোগী অনলাইন চ্যানেলের সঙ্গে সমন্বিত সেবা, মার্চেন্ট সার্ভিস, উন্নততর ই-কমার্স এবং অন্য সব ধরনের সেবায় আসতে হবে এবং সেবার ব্যয় যথাসাধ্য গ্রাহকের সাধ্যসীমার মধ্যে রাখতে হবে।
ডাক বিভাগের প্রায় ১০ হাজার পাকা স্থাপনা আছে সারা দেশে; কর্মী রয়েছেন প্রায় ৪০ হাজার। এ বিশাল জনশক্তি ও ভৌত অবকাঠামোকে সেবাবর্জিত, অলস ও অপ্রাসঙ্গিক রেখে বছর বছর জনগণের কর-খাজনার কোটি কোটি টাকা অপব্যয় করা আর চলতে দেয়া যাবে না। ডাক বিভাগ চাঙ্গা হয়ে উঠলে ডাকসেবার মান বাড়বে; ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মুনাফা প্রতিযোগিতাও কমবে। এর প্রমাণ ‘নগদ’ সেবা এরই মধ্যে ১ হাজার টাকা পাঠাতে ৯ টাকা চার্জ শুরু করেছে। অন্যরা নিচ্ছে হাজারে ২০ টাকা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মতো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও সেবামূলক ‘উইন্ডো’ চালুর সুযোগ আছে। এটা চালু হলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মতো অনলাইন টাকা স্থানান্তর ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড সেবায় উচ্চহারের সেবা ফির জুলুম থেকে মানুষ বাঁচবে।
লেখক : খন্দকার হাসনাত করিম
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।