জুমবাংলা ডেস্ক : ইন্টার্ন চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যেই রোগীর স্বজনদের মারধর বা লাঞ্ছিত করার অভিযোগ পাওয়া যায়। কেন তাদের এই আচরণ?
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতে বহির্বিভাগে ও জরুরি বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। এসব হাসপাতালে রোগীর চাপ এত বেশি থাকে যে তারা মাঝে মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। যদিও এটা কোনভাবেই কাম্য নয়। কোনো চিকিৎসক রোগীর স্বজনের গায়ে হাত তুলতে পারেন না। কেউ এমনটা করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
সর্বশেষ রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একজন রোগীর ছেলেকে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। ওই ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। পাশাপাশি অভিযুক্ত দুই ইন্টার্ন চিকিৎসককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
শুধু রাজশাহী নয়, এর আগে বগুড়া, বরিশাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। রাজশাহীতে দুই ইন্টার্ন চিকিৎসককে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও এর আগের কোনো ঘটনায় ইন্টার্ন চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা শোনা যায়নি।
কী হয়েছিল রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে?
রাজশাহী শহরের বোসপাড়ার বাসিন্দা ও স্থানীয় মোবাইল যন্ত্রাংশের মিস্ত্রী সুমন পারভেজ রিপন তার মা পিয়ার বেগমকে (৬০) শ্বাসকষ্টের কারণে গত ২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। ভর্তির পাঁচ দিন পরও চিকিৎসকেরা বলছিলেন না তার মায়ের কী হয়েছে। প্রতিদিন কিছু কিছু করে টেস্ট দেয়া হয়, রিপোর্ট দেখার পরও চিকিৎসকরা কিছু বলেন না। ৭ ফেব্রুয়ারি সকালে চিকিৎসকরা রাউন্ডে এলে রিপন তাদের কাছে জানতে চান, তার মায়ের কী হয়েছে? তখন তাকে কিছু বলেননি চিকিৎসকরা। ওই সময় তার মা চিকিৎসকদের কাছে তার অসুখের কথা জানতে চান। বরং তাদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চিকিৎসকেরা নিজেদের মধ্যে পড়াশোনার বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন। এতে রিপন বিরক্ত হয়ে বারবার প্রশ্ন করতে থাকেন।
সুমন পারভেজ রিপন বলেন, ‘আমার প্রশ্নের কারণে তারা আমাকে অশিক্ষিত বলে ক্ষুব্ধ হয়ে চলে যান। তখন মায়ের শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। আমি মাকে নেবুলাইজার দেয়ার উদ্যোগ নেই। এর মধ্যে একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক এসে আমাকে বলেন, আপনি তো মায়ের কী হয়েছে জানতে চান? আমাদের রুমে আসেন। আমি রুমে ঢুকতেই দেখি ১৫ থেকে ২০ জন অপেক্ষা করছে। এর মধ্যে একজন আনসারও আছে। একজন রুমের ছিটকানি বন্ধ করে দেয়। এরপর তারা আমাকে নির্দয়ভাবে পেটাতে থাকে। আধা ঘণ্টা ধরে তারা আমাকে পেটায়। এ সময় একজন আমাকে বলেন, বাইরে যদি এই ঘটনা বলি তাহলে তারা ইঞ্জেকশন দিয়ে আমার মাকে মেরে ফেলবে। বাইরে বের হয়ে যেন আমি সোজা হয়ে হাঁটি। পেটানোর এক পর্যায়ে আমি পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে ভিডিও চালু করে দেই। প্রথম দুই মিনিট ভিডিও দেখা গেলেও পরে আর দেখা যায়নি কারণে মোবাইল তখন ভিডিও চালু করা অবস্থায় পকেটে মধ্যে রেখে দেই।’
শুক্রবার বিকেলে রিপন বলেন, ‘আমি এখন একটা ফেসবুক পোস্ট লিখছি, কিছুক্ষণের মধ্যে পোস্ট করব। আমি বা আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য ওই চিকিৎসকরা দায়ী থাকবেন। ওই ঘটনার পর আমার মাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় এনে ফেলে রেখেছি। অথচ এখনো তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আমি নিজেও চিকিৎসা নিতে কয়েকটি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। কেউ চিকিৎসা করাতে রাজি হয়নি। পরে মুখ লুকিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। পরে চলে এসেছি। প্রচণ্ড অসুস্থ বোধ করছি। হাসপাতালের পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি। এখনো কোনো বিচার পাইনি।’
রিপনের সেই ৭ মিনিট ১০ সেকেন্ডের ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওটির প্রথম ২ মিনিট ১৫ সেকেন্ড দেখা গেলেও পরের অংশটুকু অন্ধকার। তবে মারধরের শব্দ, আকুতি, অশ্লীল কথাবার্তা এসব বোঝা যাচ্ছিল। রিপনকে বলতে শোনা যাচ্ছিল, ‘আর মাইরেন না ভাই। ম্যালা মাইর্যাছেন ভাই। আমাকে একটু পানি খেতে দেন। আমি মরে যাব। আমি ভুল করেছি। ক্ষমাই চাইছি। আর মাইরেন না। আমাকে মারার কথা আম্মাকে বইলেন না। আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়বে।’ এ সময় চিকিৎসকদের একজনকে রিপনকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করতে শোনা যায়। এক পর্যায়ে একজন চিকিৎসক বলেন, ‘বল মাফ চাইছস।’ তখন রিপন বলেন, ‘হ, মাফ চাইছি।’ এরপরও রিপনকে মারধরের শব্দ শোনা যায়। একজন তার মাথা ন্যাড়া করে দিতে চান। এছাড়া ‘চিকিৎসকদের মারতে চাওয়ায়’ রিপনের হাত কেটে নিতে চান আরেকজন।
এই ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শামীম আহমেদ বলেন, ‘এ বিষয়ে রিপন আমার কাছে অভিযোগ করেছে। আমি একটি বিভাগের সভাপতিকে প্রধান করে একটি কমিটি করেছি। রিপোর্ট পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে সাথে সাথে আমি ফরহাদ হাসান ও আলমগীর হোসেন নামে দুজন ইন্টার্ন চিকিৎসককে সময়িক বরখাস্ত করেছি।’
চিকিৎসকরা কেন রোগীর স্বজনের গায়ে হাত তুলবে? জানতে চাইলে শামীম আহমেদ বলেন, ‘এটা তো কোনোভাবেই কাম্য নয়। আসলে ১২ শ’ শয্যার হাসপাতালে রোগী থাকে সাড়ে তিন হাজার। বর্হিবিভাগে প্রতিদিন ছয় হাজারের বেশি রোগী আসে। সবকিছু মিলিয়ে প্রতিদিন ৩০ হাজার মানুষকে আমাদের হ্যান্ডেল করতে হয়। এসব কারণে অনেক সময় ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে। তবে কারো গায়ে হাত দেয়া কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ফরহাদ হাসান বলেন, ‘কেন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো, সেটা তো আমরা বলতেই পারি। কিন্তু পরিচালক মহোদয় আমাদের কোনো কথা বলতে নিষেধ করেছেন। যেহেতু তদন্ত চলছে, ফলে আমরা কিছু বলতে পারি না। তদন্ত অনুযায়ি যে ব্যবস্থা নেয়া হবে, সেটা আমরা মেনে নেব।’
গত পাঁচ বছরে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের অন্তত ১০ জন রোগীর স্বজন লাঞ্ছিত হয়েছেন। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর লাশ ওয়ার্ডে রেখে ওই মুক্তিযোদ্ধা ও তার ছেলেকে পিটিয়েছিলেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। জানতে চাইলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) রাজশাহী জেলার সভাপতি ডা. চিন্ময় কান্তি দাস বলেন, ‘একদিনে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। আমাদের সঙ্কটের মূলে যেতে হবে। হাসপাতালে ঢুকলেই দেখবেন শত শত অ্যাম্বুলেন্স। দালালদের চক্করে সাধারণ মানুষের পক্ষে সেখানে কাজ করা কঠিন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এসব ঘটনা দেখতে হবে। পাশাপাশি কোনো ঘটনা ঘটলে সেটার তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে সেটা যেই হোক। আমরা চাই সুষ্ঠু একটা চিকিৎসার পরিবেশ যেন গড়ে ওঠে।’
একই ধরনের ঘটনা বারবার?
গত ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে বরিশাল শের ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসাধীন গৌরনদীর রিজিয়া বেগম গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন ব্যক্তিগত কাজের অজুহাত দেখিয়ে চিকিৎসা দিতে অসম্মতি জানায় দায়িত্বরত চিকিৎসক। পরে বিনাচিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হলে রোগীর এক স্বজন চিকিৎসকের রুমে কথা বলতে যান। এসময় আনসার সদস্যদের সহযোগিতায় দায়িত্বরত চিকিৎসকরা তার ওপর হামলা চালায়। এ সময় সেখানে উপস্থিত বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী তামিম ইকবাল রাজু ও তার বন্ধু মুজাহিদ প্রতিবাদ করেন। চিকিৎসকরা তাদেরও মারধর করে মোবাইল ছিনিয়ে নেয়।
মৃত রোগীর স্বজন মো: নাসির বলেন, ‘আমার দাদি রিজিয়া বেগম অসুস্থ হয়ে পড়েন। দাদীকে একটু দেখার জন্য চিকিৎসককে বারবার অনুরোধ করি, কিন্তু তারা আসেনি। যার আধা ঘণ্টা পরে আমার দাদি মৃত্যুবরণ করেন। এরপর আমার চাচা ও আমি চিকিৎসকদের বলি, আপনারা কি মানুষ? আপনার মা-বাবা, অন্য কারো এমন হলে আপনি কী করতেন। এমন কথা বলায় তারা কয়েকজন মিলে আমাদের এলোপাথাড়ি কিল, ঘুসি মারতে শুরু করে। এমনকি আমার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি ছিনিয়ে নিয়ে ভেঙ্গে ফেলে। আমার দাদির লাশও আটকে রাখে।’
চিকিৎসকদের এ ধরনের ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘রোগীদের সাথে চিকিৎসকদের এ ধরনের আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। সবাইকে সহনশীল হতে হবে। আসলে আমাদের সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। এর প্রভাবের বাইরে নন চিকিৎসকরা। চিকিৎসকদের বুঝতে হবে এটা মহান পেশা। অন্য পেশাগুলোর সাথে মেলালে হবে না। রাজনৈতিক কারণে কেউ ক্ষমতাবান হয়ে অন্য কারো সাথে খাোপ ব্যবহার করতে পারেন না।’
বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালেও ২০১৯ সালে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের মারধরে আহত হয়েছিলেন হৃদরোগী মাজেদা বেগম (৫০), তার ভাই ও তিন ছেলেমেয়ে। কার্ডিওলজি বিভাগ থেকে মাজেদা বেগমকে অবজারভেশন ওয়ার্ডে স্থানাস্থর নিয়ে বাকবিতণ্ডার জের ধরে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারটির সাথে এই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। পরে রোগী ও তার লোকজনদের ছাড়পত্র দিয়ে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। ঢাকা মেডিক্যালেও গত বছর একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। রোগীর স্বজনের সাথে তর্কাতর্কির জেরে কর্মবিরতিতে যান ইন্টার্ন চিকিৎসকরা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তাফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, ‘এক চোখে দেখলে হবে না। চিকিৎসকরাও তো লাঞ্ছিত হচ্ছেন। এগুলোও দেখতে হবে। তবে আমি কারো পক্ষে সাফাই গাচ্ছি না। যে ঘটনায় যিনি অভিযুক্ত হবেন, তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা খুব শিগগিরই মন্ত্রীর সাথে এসব নিয়ে বসব। আশা করি সমাধানের একটা পথ বের হবে।’
সূত্র : ডয়চে ভেলে
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।