জাকির আবু জাফর : ‘মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা স্বপ্নের মধ্যে বাস করে।’ বচনটি আবুল ফজলের। ন্যান্সি টার্নার নামে একজন সমাজবিজ্ঞানীর ভাষ্য- ‘আমরা যদি স্বপ্ন না দেখতাম, তাহলে জীবন অসহ্য হয়ে উঠত।’ দুটো বচনই গুরুত্বপূর্ণ! দুটোই স্বপ্নের সঙ্গে জীবনের ঘনিষ্ঠতার কথা বলে। জীবনের জন্য স্বপ্ন প্রয়োজন।
স্বপ্ন কী? স্বপ্ন হলো আশা জাগিয়ে রাখা। স্বপ্ন জীবনকে জাগিয়ে রাখার রসদ। স্বপ্ন, দুঃখ সহ্য করার উপায় এবং খারাপ থেকে ভালো অবস্থানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটি উপলক্ষ। মানুষের বর্তমান যদি দুঃসহ হয়ে ওঠে, যদি চলমান সময়টি কষ্ট এবং হতাশার হয় তবে খুব সহসা ভালো সময় আসবে, সুখের সময় আসবে এবং দুঃসময় কেটে যাবে, এমন আশা মনে জাগিয়ে রাখাই স্বপ্ন। আজ যে অবহেলিত কাল সে মূল্যবান হবে এমন আশাই স্বপ্ন।
আজ গণতন্ত্র নেই, কাল গণতন্ত্র ফিরবে! আজ মানবাধিকার নেই, সহসা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে- এমন আশার জ্যোতিই স্বপ্ন। দুঃশাসন থেকে সুশাসনে ফেরার আশাই স্বপ্ন!
আমরা কত কত স্বপ্ন দেখেছি। দেখছি। হয়তো দেখতে থাকবো আরো। যেমন দেখছে এ দেশের কোটি কোটি মানুষ। দেখছে বিশ্বের নির্যাতিতরা, যাদের অধিকার লুট হয়ে গেছে। যাদের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। যারা প্রতিহিংসার শিকার। অকারণ অবিচারে নিষ্পেষিত।
কেন মানুষ হয়ে ওঠে মানুষের শত্রু। কেন মানুষই মানুষের সবচেয়ে বড় ভয়! কী করে অন্যায়ভাবে মানুষের ওপর নির্যাতন করে মানুষ। কী করে মানুষ কেড়ে নেয় মানুষের অধিকার!
গোটা দুনিয়ায় নিপীড়িত মানুষের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। আমরা বলছি, ক্রমাগত আধুনিক হচ্ছি আমরা! হ্যাঁ হচ্ছিই তো! না হলে মানুষ মারার জন্য আণবিক বোমা তৈরি হতো কেমন করে! আণবিক বোমার মালিকরা একটি কালো ব্যাগে সেই বোমার বোতাম নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন কী করে!
এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে মিসাইল ছোড়ার আয়োজন কি হতো! জঙ্গি বিমান থেকে ফসফরাস বোমা ঢালেন কেমন করে! এসবই তো আধুনিকতার ছবি। মানুষ আধুনিক হয়েছে। সেই সাথে আধুনিক হয়েছে মানুষের ওপর মানুষের নির্যাতনের ধরন।
নির্যাতন অতীতে দেখেছে মানুষ। এখনো দেখছে! ভবিষ্যতেও দেখবে। পৃথিবীতে শক্তির পূজারিরা অসহায় মানুষের পক্ষে দাঁড়ায় না কখনো। ক্ষমতাবানদের সাথেই থাকেন ক্ষমতাবানরা। তাই যেখানে নিপীড়িত মানুষরা প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে, সেখানেই অত্যাচার নির্যাতন বেড়েছে। যেখানে বঞ্চিতরা নিজেদের অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার হয়েছে, সেখানেই বঞ্চনার শিকার হয়েছে।
এত কিছুর পরও স্বপ্ন দেখে মানুষ! ভাবে-সব আঁধার ঠেলে উঠে আসবে মুক্তি। এ আশায় লড়াই করে মানুষ। সংগ্রাম করে। প্রতিবাদ প্রতিরোধ করে।
এই যে স্বপ্ন মানুষের! কী সেই স্বপ্ন! একটি মানবিক সমাজ নির্মাণের। একটি গণতান্ত্রিক সমাজের। একটি মানবাধিকার রক্ষার আয়োজনের। এমন সমাজের যেখানে মানুষ অন্তত তার ইচ্ছার বাস্তবায়নে কোনো বাধায় আটকাবে না।
মানুষ স্বপ্ন দেখে নিজেদের নেতা নিজেরা নির্বাচন করে সমাজকে এগিয়ে নেবার! যাকে ইচ্ছে তাকে ভোট দেবার স্বাধীনতাই কামনা করে মানুষ। যেমন আমরা করছি। এটুকু কি খুব বড় চাওয়া! আধুনিক সভ্যতা তবে কী! জবরদস্তি করে লক্ষ্য হাসিল তো বন্য সমাজের হতে পারে।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজ বা দেশ এখন খুব সামান্য চাওয়া! এখন বড় চাওয়া হলো- আমার দেশ অর্থনীতিতে পৃথিবীর সুপার পাওয়ার হবে। প্রযুক্তি-বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে। একজনও বেকার থাকবে না। শিক্ষা-দীক্ষায় প্রথম শ্রেণীর হবে। কোনো পরাশক্তি আমাদের ওপর চোখ তোলার সাহস করবে না। হ্যাঁ, এসব বড় চাওয়া কঠিনই বটে।
তাই একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চাওয়ার গল্পটি খুব অল্প নয় কি! হ্যাঁ এই অল্পটুকুই এদেশের প্রতিটি নাগরিকের স্বপ্ন! না, বর্তমানে শুধু নয়। অতীত থেকেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার বুঝে পেতে। নিজের অধিকার ফিরে পেতে। সেই আগুন ঝরা একাত্তরের কথা আমরা ভুলব কেন! কিন্তু মনেও কি রেখেছি! না, রাখিনি। আমরা মুখে যা বলি তা করি না। যা করি তা বলি না। অথচ মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত যা বলি তা-ই করা।
একটি মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজের স্বপ্ন দেখা কি অপরাধ! ঐতিহ্যধারী সমাজ চাওয়া কি অনুচিত! নিশ্চয়ই না। তবে? তবে আর কি, আমরা এসব চাইব। এসব স্বপ্ন দেখব!
মানুষের আদি থেকেই এ স্বপ্নের সূচনা। কাল থেকে কালান্তরে বেড়েছে এ স্বপ্নের পরিধি। আমরা যারা সবুজ শ্যামল বাংলাদেশের ভূগোলে বসত করি আমাদের স্বপ্নটি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে।
কেন? কারণ আমরা বরাবর এই স্বপ্নটি বুকে চেপে পথ চলি। কখনো কখনো স্বপ্নটি আমাদের উত্তেজনা চাগিয়ে দেয়। মনে হয় আমাদের স্বপ্নের নাওটি খুব সহসা ভিড়বে কূলে। মনে হয় আমাদের স্বপ্নের গন্তব্য খুব নিকটে। কিন্তু না, দেখতে দেখতে নাওটি মাঝ দরিয়ায় সরে যায়। হঠাৎ ঝড়ের তাণ্ডবে ভেঙে যায় গণতন্ত্রের মাস্তুল! ফলে গন্তব্য হয়ে যায় আরো সুদূর!
কিন্তু কেন আমাদের স্বপ্নের পাখিটি অধরা থেকে যায়। স্বপ্নের তরীটি কূলে ভেড়াতে পারি না কেন! কোথায় আমাদের সমস্যা! কোথায় আমরা পরাজিত! আমাদের স্বপ্ন কি অসম্ভব কিছু! তাও তো নয়। মানুষ হিসেবে আমরা আমাদের ন্যূনতম অধিকার আশা করতেই পারি। এমন একটি সমাজ চাইতেই পারি- যেখানে থাকবে আমাদের ন্যূনতম অধিকার। থাকবে শিক্ষা চিকিৎসা ও মুক্তভাবে বসবাসের সুযোগ। ভাতের এবং ভোটের অধিকার। আমি কেন আমার শাসক বেছে নিতে পারব না!
সময়টি তো আধুনিক। ব্যবস্থাপনায় আধুনিকতার ছোঁয়া সর্বত্র। আধুনিক সকল সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে মানুষ। এমন আধুনিক যুগে একজন আরেকজনের অধিকার লুট করবে এটি কি ভাবা যায়!
গোটা পৃথিবীতে এখন মুক্তবাজার অর্থনীতির ঢেউ। পরিবারে ছেলেমেয়েরাও অতি অল্প বয়সে স্বাধীনতার বুলি আওড়ায়। সেখানে সমাজ বা রাষ্ট্রে নাগরিক স্বাধীনতা থাকবে না এটি মানা যায়! জবরদস্তির খেলা চলতেই থাকবে, এটি কী করে চিন্তা করা যায়!
আমাদের অপরাধ কী! আমাদের সমস্যাই বা কোথায়! আমরা কি তবে জাতি হিসেবে আধুনিক নই! এখনো সভ্য হয়ে উঠিনি! কিংবা নিদেনপক্ষে ন্যূনতম শিক্ষিত হতে পারিনি!
অন্যের অধিকার লুণ্ঠন, অবৈধ উপায়ে রাষ্ট্রের সম্পদ লুট করা ঘৃণার কাজ হওয়ার কথা শিক্ষিতজনের কাছে। লজ্জিত হওয়ার কথা তার। অন্যকে হীন বা খাটো করলে নিজেই খাটো হয় এ কথা মনে রাখার কথা। অথচ আমরা কত সহজে এসব অসুন্দর কাজ করে গর্ববোধ করি!
তবে এটিও সত্যি, যারা সুস্থতার স্বপ্ন দেখেন তারা তাদের স্বপ্নে অটল থাকেন না। অথবা যা মুখে বলেন তা মনে দৃঢ়তার সাথে পোষণ করেন না। আসলে চিন্তা কথা ও কাজ যদি এক রেখায় না দাঁড়ায় তবে স্বপ্ন কখনো সফল হয় না। হবেও না। বিশ্বাসের সাথে উচ্চারিত হবে কথা। আর কথা অনুযায়ী হবে কাজ। তবেই স্বপ্ন রূপ নেবে বাস্তবতায়। যদিও সময় বেশি লাগবে কিছুটা। লাগুক। তবুও বেঁচে থাক আমাদের স্বপ্নগুলো। মনে রাখতে হবে- স্বপ্ন মরে গেলে আর কিছুই বেঁচে থাকে না!
লেখক : কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।