অন্যরকম খবর ডেস্ক : বিপুল সংখ্যায় চেরি ফুল যখন ফুটে বর্ণিল হয়ে ওঠে জাপানের রাজধানী টোকিও, তেমনি নেদারল্যান্ডসের নাম আছে সেখানকার আশ্চর্য সুন্দর টিউলিপ বাগানের জন্য, তবে কানাডার মানিটোবা প্রদেশের একটি শহর যে জন্য আলোচনায় সেটা একেবারেই আলাদা। বছরের নির্দিষ্ট একটি সময় প্রচণ্ড ব্যস্ততা তৈরি হয় সেখানে। তবে সেটা ওই এলাকার বাসিন্দাদের নয়, সাপের।
প্রতি বসন্তে নিয়ম করে মানিটোবায় নিজেদের পাতালের আশ্রয় থেকে বের হয়ে আসে ৭০ হাজারের বেশি সাপ। আপনার যদি সর্পভীতি থাকে আর ওই সময় সেখানে উপস্থিত হন, তাহলে নিঃসন্দেহে আঁতকে উঠবেন। কারণ এভাবে কোনো জায়গা সাপে গিজগিজ করার এমন দৃশ্য পৃথিবীর আর কোথাও দেখতে পাবেন না। অপর দিকে সাপপ্রেমী হাজারো মানুষ বসন্তে সেখানে হাজির হন এই সরীসৃপদের দেখতে।
মানিটোবার নারসিসের থেকে ছয় কিলোমিটার উত্তরে আর্মস্ট্রং এলাকায় দেখা মিলবে নারসিসে স্নেক ডেনসের। প্রতি বসন্তে কয়েক দিন ধরে এখানকার পাতালের বিভিন্ন ফাটল, গর্ত থেকে পিলপিল করে বের হয়ে আসতে দেখা যায় রেড সাইডেড গারটার স্নেক নামে পরিচিত এই সাপগুলোকে। উদ্দেশ্য, মিলিত হয়ে সন্তান উৎপাদন।
মজার ঘটনা নারসিসের আশপাশের এলাকা সাপগুলোর যে কারণে পছন্দ, ঠিক একই কারণে অনেক কৃষক একে পরিত্যক্ত রেখে চলে গেছেন কয়েক দশক আগে। চুনাপাথরের ওপরে এখানে পাতলা মাটির আস্তর। পানির প্রবাহে ধীরে ধীরে ওই পাতলা স্তরের নিচে অসংখ্য গুহার সৃষ্টি করেছে। আর জায়গাটি কানাডার মতো দেশের বিবেচনায়ও অত্যধিক শীতল। এতে এটি হয়েছে সাপের শীতের আদর্শ আশ্রয়স্থল।
প্রতি বসন্তে এই সাপ বেরিয়ে আসার ঘটনা স্থায়ী হয় দশ দিনের মতো। তবে একেবারে নির্দিষ্ট সময়টা আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। মেঘ, শীতল তাপমাত্রা ও বৃষ্টি সাপগুলোকে তাদের পাতাল নিবাসেই রাখে।
এই সাপের বিষয়টি বাদ দিলে নারসিসকে এক রকম ভূতুড়ে শহরই বলতে পারেন। শহরটিকে টিকে থাকা সবচেয়ে নজরে পড়ার মতো স্থাপনা হলো, একটি বাড়ির ধ্বংসাবশেষের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বহু বছর আগে পরিত্যক্ত হওয়া একটি গ্যাস স্টেশন।
অনেক বিজ্ঞানী গবেষণার প্রয়োজনে যান জায়গাটিতে। তবে তাঁরা সাধারণত কাজ করেন বিভিন্ন ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে থাকা সাপের গর্তগুলোয়। তবে মানিটোবা ওয়াইল্ডলাইফ সার্ভিস এমন একটি জায়গায় পার্ক তৈরি করেছেন যেখানটায় আনুমানিক ৭০ হাজার এ প্রজাতির সাপের শীতকালীন আবাস। তাঁরা অবশ্য একে সাপের গর্ত না বলে ‘স্নেক ডেন’ বা ‘সাপের গুহা’ বলতে পছন্দ করেন।
তবে এত সাপ একসঙ্গে দেখাটা যতই ভয়ংকর মনে হোক, এরা মোটেই ক্ষতিকর নয়। অর্থাৎ এই সাপ বিষধর নয়। এগুলো আপনাকে কামড়াতেও পারে, তবে তাতে আপনার সে অর্থে কোনো সমস্যা হবে না।
পার্কটিকেও অন্য সাধারণ পার্কগুলোর মতোই মনে হবে প্রথম দেখায়। বসার জায়গা, বনের ভেতর নুড়ি বিছানো পথ, তৃণভূমি নজর কাড়বে আপনার। তবে এখানকার মূল আকর্ষণ চারটি বড় গর্ত। আপাতদৃষ্টিতে এগুলোকে ঝোপ-জঙ্গলে ঢাকা মনে হলেও কাছে যেতেই বুঝতে পারবেন এগুলোর মেঝেতে গিজগিজ করছে একটার গায়ের ওপর আরেকটা পিছলে যেতে থাকা অসংখ্য সাপ। নিজেদের পাতালের আশ্রয় ছেড়ে যারা এখানে এসেছে মিলিত হওয়ার জন্য। চওড়ায় সাপগুলোর বেশির ভাগ একটা মার্কার কলমের সমান, দৈর্ঘ্যে সর্বোচ্চ ১৮ ইঞ্চি।
স্নেক ডেনের বিভিন্ন জায়গায় বড় সাপেরা (পার্কে শোভা পাওয়া বিভিন্ন প্যানেলের লেখাগুলো যাঁরা পড়েছেন জানেন এগুলো স্ত্রী সাপ) পুরুষ সাপেদের সঙ্গে মিলে কুণ্ডলীর মতো তৈরি করেছে। এপ্রিলের শেষ ও মের গোড়ার দিকে বরফ গলে যাওয়ার ঠিক পরপর চুনাপাথরের এই গুহাগুলো থেকে সাপ বেরিয়ে আসে। লম্বা শীতনিদ্রার পর সাধারণত আগে পুরুষ সাপ জেগে ওঠে। তারপর তাদের ফাটল কিংবা গর্তের বাসা থেকে বের হয়ে মাটির ওপরে জড়ো হয় নারী সাপের অপেক্ষায়।
‘প্রথমে আমার খানিকটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়েছিল। কারণ, এগুলো একটার সঙ্গে একটি জড়িয়ে ছিল। কিন্তু যখন আপনি একটিকে হাতে তুলে নেবেন, তখন বুঝতে পারবেন যে সাপগুলো মোটেই বদমেজাজি নয়।’ উইনিপেগ থেকে পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসা এক নারী বলেন।
তাঁর চিকিৎসক স্বামী আবার এর তুলনা করেছেন ইন্ডিয়ানা জোন্স সিনেমার সঙ্গে। ‘মাটি কোথায় তা আপনি বলতে পারবেন না, কারণ এর ওপরে যা কিছু আছে তা কেবল নড়াচড়া করছে।’
এখানে ঠিক কত সংখ্যায় সাপ আছে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে অনেকেরই ধারণা, পার্ক এলাকাতেই আছে মোটামুটি ৭০হাজার সাপ। এর বাইরে থাকা সাপের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। মোটের ওপর সংখ্যাটি লাখখানেক হতে পারে।
নারসিসের সাপগুলো একটা সময় পর্যন্ত ছিল অবহেলিত। প্রথম ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীদের অনেকেই তাদের নির্মূল করার চেষ্টা করেছিল। এগুলো পোষা প্রাণীর দোকান ও স্কুলের ব্যবহারিক ক্লাসে ব্যবচ্ছেদের জন্য সরবরাহ করে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য চাষ করা হতো তখন। ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে এসে এর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়। কিন্তু এই সাপ এখন এই এলাকায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বছরে অন্তত একবার এদের জন্য পর্যটকের সমাগম হয় এলাকাটিতে।
মানিটোবার রাজধানী উইনিপেগ থেকে জায়গাটির দূরত্ব ১০০ কিলোমিটারের মতো। পর্যটকদের পাশাপাশি বাসভর্তি স্কুলের শিক্ষার্থীরাও আসেন আশ্চর্য এই বিষয়টি প্রত্যক্ষ করতে। কাজেই সর্পভীতি না থাকলে কানাডার পরবর্তী বসন্তে হাজির হয়ে যেতে পারেন নারসিসের সর্পরাজ্যে। ইনউডের নামে একটি গ্রামের কাছাকাছি গ্রামে অবস্থিত পার্কটিতে একে-অপরকে জড়িয়ে থাকা সারা এবং স্যাম নামে দুটি বিশাল আকারের সাপের মূর্তিও দেখা পাবেন। সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, অ্যামিউজিং প্ল্যানেট, সিবিসি নিউজ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।