লাইফস্টাইল ডেস্ক : ঘুমের মধ্যে কিছু সময়ের জন্য শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়াকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় স্লিপ অ্যাপনিয়া। এটি একটি রোগ এবং চিকিৎসকরা মনে করেন এটি মানুষের জন্য একটি গুপ্তঘাতক। ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী বাপ্পী লাহিড়ীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়েছে ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার সবচেয়ে সাধারণ ধরন অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়াকে।
কিন্তু এই রোগটি সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা কম। এই রোগে ভুগলেও অনেক সময় ভুক্তভোগী বুঝতে পারেন না। ঢাকায় চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশেও স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে।
স্লিপ অ্যাপনিয়া কী?
যাদের স্লিপ অ্যাপনিয়া আছে, তাদের ক্ষেত্রে ঘুমের বার বার ব্যাঘাত ঘটে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে। জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ জানিয়েছেন, কোনো ব্যক্তির স্লিপ অ্যাপনিয়া যখন হয় তখন সেই ব্যক্তি ঘুমানোর অল্প সময়ের মধ্যেই অনেক জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকেন।
তিনি বলেন, ওই ব্যক্তির শ্বাস নেয়ার গতি অনেক বেড়ে গেলে এক পর্যায়ে হঠাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। তবে কিছুক্ষণ শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ থাকার পর আবার তা শুরু হয়। অধ্যাপক আব্দুল্লাহ উল্লেখ করেন, এই যে শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটছে, এটাকে অ্যাপনিয়া বলা হয়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেউ ঘুমের মধ্যে যখন জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, তখন হঠাৎ করে শ্বাস-প্রশ্বাস পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় কেন? এই প্রশ্নে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ বলেছেন, বার বার যখন শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া হয়, তখন যে বাতাস বের হয় তাতে শরীর থেকে মূলত কার্বন ডাই অক্সাইড বেরিয়ে যায়।
তিনি উল্লেখ করেন, কার্বন ডাই অক্সাইডের লেভেল কমে গেলে একজন মানুষের শরীরে থাকা সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। এরপর কিছুক্ষণ দম বন্ধ থাকার কারণে শরীরের সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমে আবার কার্বন ডাই অক্সাইডের লেভেল বেড়ে গেলে তখন নার্ভাস সিস্টেম আবার উজ্জীবিত হয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস ফিরে আসে। অধ্যাপক আব্দুল্লাহ বলেন, এই পরিস্থিতিটা বেশ জটিল এবং এক্ষেত্রে অনেকে সময় একজন মানুষের মৃত্যুও ঘটে।
অ্যাপনিয়ায় আক্রান্তের অভিজ্ঞতা কেমন?
ঢাকায় একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত একজন নারী এই রোগের জন্য নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন গত দুই বছর ধরে। নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষাজীবনে তার উচ্চতার তুলনায় শরীরের ওজন অনেক বেড়ে যায়। তখন ঘুমের মধ্যে নাক ডাকা এবং জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়ার বিষয়টি তিনি বুঝতে পারেন। কিন্তু ওই সময়ে তার দম বন্ধ হয়ে যেতো না। তবে বছর তিনেক আগে এক রাতে ওই নারী টের পান যে হঠাৎ করে তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ফলে তার ঘুম ভেঙে যায় এবং তিনি হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসেন। এরপর মাঝে মাঝেই এমন পরিস্থিতিতে তার ঘুমের ব্যাঘাত হতো।
আরেক রাতে তার একেবারে ভিন্ন ধরনের এক অভিজ্ঞতা হয়। ওই নারী বলছিলেন যে ঘুমের মধ্যে হঠাৎ তার দম বন্ধ হয়ে গেলে তার ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু তিনি অনুভবন করেন, বিছানায় শোয়া অবস্থা থেকে তার উঠে বসার এবং এমনকি কথা বলার শক্তি নেই।
বেশ কিছুটা সময় পর তার শ্বাস-প্রশ্বাস ফিরে এলে তিনি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হন। এরপর তিনি দুই বছর ধরে চিকিৎসা করাচ্ছেন। তিনি ব্রেন বা নিউরো সমস্যা থেকে অ্যাপনিয়ায় ভুগছেন – এমনটাই চিকিৎসক চিহ্নিত করেছেন। এখন তিনি নিয়মিত চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা ভালো আছেন। তবে তাকে আজীবন চিকিৎসা নিতে হবে।
অ্যাপনিয়া কত ধরনের হয়?
নাক কান গলা রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ জানিয়েছেন, অবস্ট্রাকশন বা শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হলে তাকে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া বলা হয়। গলায় টনসিল ফুলে গিয়ে এমনটা হতে পারে। শ্বাসনালী এবং গলার সংযোগস্থলে অনেক সময় মাংসপেশী ফুলে যায়, যেটাকে অ্যাডনয়েড বলা হয়। এছাড়া অনেক সময় নাকের ভেতরে মাংসপেশী বড় হয়ে যায়।
এই সমস্যাগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসে বাধা সৃষ্টি করে, যাকে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ওজন বেশি বা শরীরে মেদ বেশি রয়েছে, এমন বয়স্ক মানুষ ও শিশু এই অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ায় বেশি ভোগে।
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ জানিয়েছেন, হৃৎপিন্ড, ব্রেইন ও নিউরো সমস্যা থেকে একজনের শরীরের সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমে নানা ধরনের জটিলতা হয় এবং তখন ওই ব্যক্তি স্লিপ অ্যাপনিয়ায় ভুগতে পারেন। এই সমস্যা অনেক সময় জটিল ও গুরুতর হয়। তবে দুই ধরনের অ্যাপনিয়াতেই মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে।
নাক ডাকলেই তা স্লিপ অ্যাপনিয়া?
অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেছেন, ওজন বেশি হলে ঘুমের সময় শ্বাসনালীকে ঘিরে গলা এবং আশেপাশের জায়গাগুলো সরু হয়ে যায়। এছাড়া নাকের মাংসপেশী অনেক সময় বড় হয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে ঘুমের মধ্যে মুখ দিয়ে হা করে নিঃশ্বাস নিতে হয় এবং তখন নাক ডাকার শব্দ হয়। তাই নাক ডাকলেই তাকে স্লিপ অ্যাপনিয়া বলা যায় না। তবে স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্তরাও নাক ডাকে। তাদের ঘুমের মধ্যে সাধারণত জোরে জোরে শ্বাস নিতে হয় এবং দম আটকে আসায় ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে।
বুঝবেন কীভাবে?
অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ জানিয়েছেন, যেকোনো ধরনের স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির সমস্যাগুলো ঘুমের মধ্যে হয়, ফলে অনেকেই তা বুঝতে পারেন না। তবে ওই ব্যক্তির পাশে কেউ যদি ঘুমায়, তিনি হয়তো বুঝতে পারবেন। রোগীর পাশে ঘুমানো ব্যক্তি রোগীর লক্ষণগুলো খেয়াল করে তার সন্দেহের কথা জানালে তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার ব্যবস্থা করা উচিত।
পলিস মনোগ্রাফি বা স্লিপ টেস্ট করানোর মাধ্যমে বাংলাদেশেই এখন সঠিকভাবে অ্যাপনিয়া পরীক্ষা করা যায় বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। অধ্যাপক আব্দুল্লাহ বলেছেন, এই রোগের চিকিৎসা করা না হলে মস্তিষ্ক, হৃৎপিন্ড ও কিডনির ওপর চাপ পড়ে। তখন উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগসহ জটির সব রোগ দেখা দিতে পারে। আর আগে থেকে এসব রোগ থাকলে তা আরো খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করবে। এই রোগে রাতের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে, তাই আক্রান্ত ব্যক্তির দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বলে জানান এই চিকিৎসক।
চিকিৎসা কী আছে?
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে দেখা হয় যে শ্বাসনালীকে কেন্দ্র করে কোনো জায়গাগুলোতে বাধা আছে – পরে সেগুলো চিহ্নিত করে তা অপসারণ করতে হয়। এমন ক্ষেত্রে অল্প সময়ে এই সমস্যা থেকে মুক্তি মিলতে পারে। কিন্তু জটিল স্লিপ অ্যাপনিয়া যেহেতু শরীরের অন্যান্য অনেক গুরুতর সমস্যা থেকে হয়, তাই এর চিকিৎসা আজীবন চালাতে হতে পারে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
প্রতিরোধ করা কী সম্ভব?
চিকিৎসকরা মনে করেন যে সতর্ক থাকলে এই রোগ এড়ানো সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে কিছু ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়ে তাকেন তারা। প্রথমত, শরীরের উচ্চতা অনুযায়ী ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। আর তৃতীয়ত, সুষম খাদ্যাভাস করতে হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।