বিজ্ঞান ও প্রযক্তি ডেস্ক : চিজবার্গার আমার প্রিয় খাবার। কিন্তু পরিবেশের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় প্রিয় না হলেই ভালো হতো। আমি সেরা মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্য দিয়ে এর প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করে দেখেছি। কিছু ক্ষেত্রে দারুণ ফল পেলেও তা এমন নয় যে, তা কোনো বার্গার প্রেমিককে বোকা বানাতে পারে। এমনকি কাছাকাছি স্বাদের কিছু তৈরি করা গেলেও সেখানে কিছু একটার অভাব যেন থেকেই যায়। তা হলো থকথকে চর্বি ও তৈলাক্ত স্তর, যা একটি আদর্শ স্যান্ডউইচের দুভাগকে একত্রিত করে, যা একে করে তোলে এতটাই উপাদেয়, যার বিকল্প তৈরি খুবই কঠিন।
এ খাবারের গোপন উপাদান পশু–চর্বি। এটিই অনেক খাবারকে সুস্বাদু ও রসালো করে; গলে যায়; জিভে অনন্য অনুভূতি দেয় এবং সামগ্রিকভাবে স্বাদ বাড়ায়। এটিই আসলে মার্জারিন থেকে মাখন, উদ্ভিজ হিমায়িত ডেজার্ট থেকে দুধজাত আইসক্রিম এবং সয়া প্রোটিন বা মটর দিয়ে তৈরি বার্গার থেকে আসল ও দুর্দান্ত বার্গারকে আলাদা করে। দুর্ভাগ্যক্রমে, এটি জলবায়ুর জন্যও একটি বিপর্যয়। বিশ্বে প্রতি বছর ৫১ বিলিয়ন টন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়। প্রাণী ও উদ্ভিদ থেকে যে চর্বি ও তেল উৎপাদন হয়, তা মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমণের সাত শতাংশের জন্য দায়ী। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমাদের এই সংখ্যা শূন্যে নামাতে হবে।
আমাদের পরিকল্পনাটি এত সরল না যে, লোকেরা তাদের পছন্দের খাবারগুলো ছেড়ে দেবে। সর্বোপরি, মানুষ একটি কারণে পশুর চর্বি চায়, কারণ তা সবচেয়ে পুষ্টিকর এবং ক্যালোরি-ঘন ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট। ঠিক যেজন্য আমরা তাৎক্ষণিক শক্তির প্রয়োজনে চিনিযুক্ত খাবার চাই। আমাদের যা দরকার তা হলো—প্রাণীদের দুর্ভোগ, ক্ষতিকর রাসায়নিক ও গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন ছাড়াই প্রাণীজ পণ্যগুলোতে থাকা চর্বির সন্ধান পাওয়া। আর সেগুলোকে হতে হবে প্রত্যেকের জন্য সাশ্রয়ী।
এটি একটি দীর্ঘ স্বপ্নের মতো শোনাতে পারে। কিন্তু সেভর নামের একটি কোম্পানি (যেখানে আমি বিনিয়োগ করেছি) এই কাজটি শুরু করেছে। তারা এই সত্য দিয়ে শুরু করেছিল যে, সব চর্বিই কার্বন ও হাইড্রোজেন পরমাণুতে তৈরি অণুর বিভিন্ন প্রকারভেদ। তারপরে তারা সেই একই কার্বন ও হাইড্রোজেন চেইন তৈরির কাজ শুরু করে প্রাণী বা উদ্ভিদের সাহায্য না নিয়েই। তারা শেষ পর্যন্ত একটি পদ্ধতি তৈরি করতে সমর্থ হয়, যার মধ্যে রয়েছে বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং পানি থেকে হাইড্রোজেন নিয়ে তাদের গরম করে ফ্যাটি অ্যাসিড বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে চর্বি তৈরি। ফলাফল হলো—এটি আসল চর্বির অণুর মতোই হলো, যা আমরা দুধ, পনির, গরুর মাংস এবং উদ্ভিজ্জ তেল থেকে পাই। এই প্রক্রিয়ায় কোনো গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে না এবং এর জন্য কোনো কৃষিজমি ব্যবহার করতে হয় না। একই সাথে এটি উৎপাদনে চিরাচরিত কৃষিকাজের এক হাজার ভাগেরও কম পানি লাগে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—এটির স্বাদ সত্যিই ভালো, একেবারে আসল জিনিসের মতো। কারণ রাসায়নিকভাবে এটি তেমনই।
আমি সেভারের পণ্যের স্বাদ নিয়েছি। আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি যে, আমি সত্যিকারের মাখন খাচ্ছি না। (এটি দিয়ে তৈরি বার্গারটিও ছিল আসল স্বাদের কাছাকাছি।) এর বড় চ্যালেঞ্জ হলো দাম কমিয়ে আনা, যাতে সেভরের তৈরি পণ্যগুলো সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে পড়ে। হয় একে হতে হবে পশুর চর্বি দিয়ে বানানো প্রচলিত বার্গারের দামের সমান, অথবা কম। সেভারের এখানে সফল হওয়ার ভালো সুযোগ রয়েছে। কারণ, তাদের ফ্যাট-উৎপাদন প্রক্রিয়ার মূল ধাপগুলো ইতিমধ্যে অন্যান্য শিল্পে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
প্রাণীজ চর্বির ব্যাপারে অগ্রাধিকারের কারণ তারা জলবায়ুর ওপর একটি বড় প্রভাব ফেলে। এবং আমাদের অনেক প্রিয় খাবার তৈরিতেও এর বড় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এমনকি যদি আমরা রাতারাতি সমস্ত প্রাণীর চর্বি উৎপাদনের কারণে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন শূন্যে নামিয়ে আনতে পারি, তবুও আমাদের একটি চ্যালেঞ্জ থাকবে। কারণ কিছু উদ্ভিদজ্জ চর্বি ও তেলও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দায় পাম তেলের।
পাম তেল বিশ্বের সবচেয়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত উদ্ভিজ্জ তেল। পিনাট বাটার, কুকিজ, ইনস্ট্যান্ট রামেন, কফি ক্রিমার ও হিমায়িত খাদ্য থেকে শুরু করে মেকআপ, বডি ওয়াশ, টুথপেস্ট, কাপড় ধোয়ার সাবান, সুগন্ধী থেকে মোমবাতি, বিড়ালের খাবারসহ সব প্যাকেটজাত পণ্যের অর্ধেকেই এটি ব্যবহৃত হয়। এমনকি এটি ডিজেল-চালিত ইঞ্জিনের জন্য জৈব জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
পাম তেলের সমস্যাটি অবশ্য এর ব্যবহার নিয়ে নয়, এর উৎপাদন নিয়ে। কারণ, তেল উৎপাদনকারী পাম শ্রেণিভুক্ত গাছটির আদি নিবাস মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকা হলেও এটি সর্বত্র জন্মায় না। আসলে পাম গাছ বিষুব রেখার পাঁচ থেকে দশ ডিগ্রি এলাকার মধ্যে ভালোভাবে বেড়ে ওঠে। ফলে অর্থকরী পাম তেল উৎপাদনের লক্ষ্যে সারা বিশ্বে নিরক্ষীয় অঞ্চলের রেইন ফরেস্টের বন উজাড় ও পুড়িয়ে ফেলে তাকে পাম বাগানে রূপান্তর করা হচ্ছে।
এই প্রক্রিয়াটি জীববৈচিত্র্যের জন্য খারাপ, যা সমগ্র বাস্তুতন্ত্রকে ঝুঁকিতে ফেলছে। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রভাবকের ভূমিকাও পালন করছে। বন পোড়ানোর মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে প্রচুর গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়। একই সঙ্গে ধ্বংস হয় ওই অঞ্চলের জলাভূমিগুলোও। ফলে সেখানে সঞ্চিত কার্বনও প্রকৃতিতে মুক্ত হয়। ২০১৮ সালে শুধু মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় হওয়া ধ্বংসযজ্ঞ বিশ্বব্যাপী কার্বণ নির্গমনের ১ দশমিক ৪ শতাংশের সমান—যা গোটা ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের চেয়ে বেশি এবং বিশ্বব্যাপী বিমান চলাচল শিল্পের কারণে হওয়া নির্গমনের প্রায় সমান।
দুর্ভাগ্য হলো, পাম তেল প্রতিস্থাপন করা কঠিন। এটি সস্তা, গন্ধহীন ও প্রচুর হয়। যদিও বেশির ভাগ উদ্ভিজ্জ তেল সাধারণ তাপমাত্রায় তরল থাকে, পাম তেল আধা-কঠিন, ঘণ ও সহজে আলাদা করা যায়। যেহেতু এটি একটি প্রাকৃতিক সংরক্ষণকারী হিসেবে কাজ করে, তাই এর আয়ুষ্কালও (শেলফ–লাইফ) অনেক বেশি। (এটি আসলে আইসক্রিমের গলনাঙ্ক বাড়ায়।) এটিই একমাত্র উদ্ভিজ্জ তেল, যার মধ্যে সম্পৃক্ত ও অসম্পৃক্ত চর্বিগুলোর মোটামুটি একটা ভারসাম্য রয়েছে। যে কারণে এটি এত বহুমুখী। যদি পশুর চর্বি কিছু খাবারের ক্ষেত্রে সুপারস্টার হয়, তাহলে পাম তেল হলো সেই টিম প্লেয়ার, যেটি প্রায় সব খাবার ও ভোজ্য পণ্য এবং অভোজ্য পণ্যও আরও ভালো করতে কাজে লাগে।
এই কারণে সি সিক্সটিন (C16) বায়োসায়েন্সের মতো কোম্পানিগুলো পাম তেলের বিকল্পের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে। ২০১৭ সাল থেকে সি সিক্সটিন (যেটিতে আমি বিনিয়োগ করেছি) একটি ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়া ব্যবহার করে একটি বন্য খামির জীবাণু থেকে একটি পণ্য তৈরি করছে, যা কোনো কার্বন নির্গমন ছাড়াই উৎপন্ন হয়। যদিও এটি রাসায়নিকভাবে প্রচলিত পাম তেল থেকে আলাদা। সি সিক্সটিনের তেলে একই ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে, যার মানে এটি একই কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। এবং এটি পাম তেলের মতো ‘প্রাকৃতিক’, যা গাছের পরিবর্তে ছত্রাকের ওপর জন্মায়। সেভরের মতো সি সিক্সটিনের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে চাষাবাদমুক্ত। এর ‘খামার’ হলো ম্যানহাটনের কেন্দ্রস্থলের একটি ল্যাব।
গত বছর কোম্পানিটি তাদের প্রথম পণ্য বাজারে ছেড়েছে। তাদের লক্ষ্য, প্রথমে সৌন্দর্যচর্চা ও প্রসাধন খাতে এবং পরে খাদ্যে নিজেদের আরও পণ্য নিয়ে আসার পাশাপাশি বিদ্যমান ব্র্যান্ড নিয়ে আরও কাজ করা, যাতে বিভিন্ন পণ্যে পাম তেলের ব্যবহার কমিয়ে আনা যায়। আমি বাজি ধরে বলতে পারি—সি সিক্সটিন সফল হবে।
আমি আশা করি তারা করবে। ল্যাবে-তৈরি চর্বি ও তেল ব্যবহারে যাওয়ার ধারণাটি প্রথমে অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের কার্বন নির্গমণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করার ব্যাপারে তাদের সম্ভাবনা অপরিসীম। প্রমাণিত প্রযুক্তি ও প্রক্রিয়াগুলোকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে আমরা আমাদের জলবায়ুবিষয়ক লক্ষ্য অর্জনের এক ধাপ কাছে চলে এসেছি।
*মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস তাঁর নিজস্ব ব্লগ গেটস নোটস-এ গত ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ লেখাটি প্রকাশ করেছেন। লেখাটি অল্প সংক্ষেপিত
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।