আন্তর্জাতিক ডেস্ক : কয়েক মাসের মধ্যেই সুইডেনে কোরআন অবমাননার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেছে। গতকাল বৃহস্পতিবারও (২০ জুলাই) সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ইরাকি দূতাবাসের সামনে দুই ব্যক্তির এক কর্মসূচিতে ইরাকি এক ব্যক্তি একটি কোরআন শরিফে লাথি মেরেছেন।
সুইডিশ পুলিশ তাঁর এমন কর্মকাণ্ডের অনুমতি দিয়েছিল এবং দূরে দাঁড়িয়ে কোরআন শরিফ অবমাননার বিরুদ্ধে যাঁরা প্রতিবাদ করছিলেন তাঁরা যেন ওই ব্যক্তির ওপর চড়াও না হন সে জন্য পাহারাও দিচ্ছিল। একই ব্যক্তি গত ঈদুল আজহায় স্টকহোমের সবচেয়ে বড় মসজিদের সামনে একটি কোরআন শরিফের কয়েকটি পাতা পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।
শুধু এ দুটি ঘটনাই নয়, চলতি বছরের শুরুর দিকে স্টকহোমে অবস্থিত তুর্কি দূতাবাসের সামনে কোরআন অবমাননার কর্মসূচি পালন করেছিলেন ডেনিশ বংশোদ্ভূত আরেক ব্যক্তি।
সাম্প্রতিক এসব ঘটনায় সুইডিশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তীব্র সমালোচনাসহ সাধারণ মানুষের বিক্ষোভও অনুষ্ঠিত হয়েছে দেশে দেশে। প্রশ্ন উঠেছে, এত সমালোচনা, এত বিক্ষোভ ও নিন্দা জানানোর পরও সুইডিশ কর্তৃপক্ষ কেন বারবার কোরআন অবমাননার মতো বিষয়গুলোকে অনুমোদন দেয়।
কোরআনের অপমান কি তবে সুইডেনে বৈধ?
প্রথম কথা হলো, কোরআন কিংবা অন্য যে কোনো ধর্মগ্রন্থ পোড়ানো কিংবা অবমাননার ক্ষেত্রে সুইডেনে কোনো আইনি নিষেধাজ্ঞা নেই। বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশের মতো সুইডেনে কোনো ‘ধর্মদ্রোহ’ বিরোধী আইন নেই। তবে এর মানে এই নয় যে দেশটিতে কখনোই এই আইন ছিল না।
ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকেও সুইডেনে ধর্মদ্রোহ ছিল একটি মারাত্মক অপরাধ। এর জন্য মৃত্যুই ছিল একমাত্র শাস্তি। তবে ধীরে ধীরে দেশটিতে ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটতে থাকে। ফলে ধর্মদ্রোহ বিরোধী আইনটিও দুর্বল হতে শুরু করে। সর্বশেষ ১৯৭০ সালে এই আইনটিকে পুরোপুরিভাবে বাতিল করে দেয় দেশটির সরকার।
এ ধরনের কাজ সুইডিশ কর্তৃপক্ষ কি থামাতে পারেন না?
সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহেই দেখা গেছে, পৃথিবীর অনেক দেশ কোরআনসহ অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থের অবমাননা থামানোর জন্য দেশটির কর্তৃপক্ষকে বারবার আহ্বান জানিয়েছে। তবে সুইডেনে বিষয়টি সরকার নয়, পুলিশই এ ধরনের আন্দোলন এবং কর্মসূচির অনুমোদন দিয়ে থাকে। কারণ, সুইডেনের সংবিধান অনুসারে নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে এবং এটিকে খুব গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।
নাগরিকদের যেকোনো কর্মসূচিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ক্ষেত্রে দেশটির পুলিশকে সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে—কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে নাগরিকেরা কোনো ঝুঁকিতে পড়বেন কি না।
স্টকহোমের পুলিশ গত ফেব্রুয়ারিতেই দুটি কোরআন পোড়ানো কর্মসূচির আবেদনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছিল—এতে সন্ত্রাসী হামলার জেরে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। কিন্তু পরে সুইডেনের আদালত তাঁদের এই নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে দেন এই অজুহাতে যে সন্ত্রাসী হামলা হওয়ার সুনিশ্চিত কোনো তথ্য দিতে পারেনি পুলিশ বিভাগ।
কোরআন পোড়ানোকে ‘ঘৃণাত্মক কাজ’ মনে করে না কেন দেশটি?
আইন অনুযায়ী—সুইডেনে জাতিগত, ধর্মীয় গোষ্ঠী, লিঙ্গান্তর এবং লিঙ্গবৈষম্য বিরোধী বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ। তাই অনেকেই মত দেন, কোরআন পোড়ানো একটি মুসলিমবিরোধী কাজ, তাই এটিকে ঘৃণাত্মক কাজ হিসেবে নিষিদ্ধ করা উচিত। তবে এ বিষয়ে দেশটিতে মতভেদ রয়েছে। অন্য আরেকটি শ্রেণি মত দেন—কোরআন পোড়ানোর মতো কর্মকাণ্ড দিয়ে ইসলাম ধর্মকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়, কোনোভাবেই এই ধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করা হয় না। অনেকে গর্হিত কাজ মনে করলেও দেশটিতে যেকোনো ধর্মের সমালোচনা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অংশ।
বিষয়টির আইনি সমাধানের জন্য দেশটির পুলিশ ইতিপূর্বে কোরআন পোড়ানো এবং পবিত্র এই গ্রন্থটিকে লাথি মারার দুটি ঘটনায়ই প্রাথমিকভাবে ঘৃণাত্মক অপরাধ হিসেবে অভিযোগ নথিভুক্ত করেছে। এ বিষয়ে পরবর্তী সময় বিচারকেরাই সিদ্ধান্ত দেবেন।
সুইডিশ কর্তৃপক্ষ কি মুসলিম এবং কোরআনকে আলাদা মনে করে?
কোরআন অবমাননার ঘটনায় সুইডেনে বসবাস করা মুসলিমরা খুবই দুঃখ পেয়েছেন। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, পুলিশ কি অন্য ধর্মগ্রন্থ পোড়ানোর ক্ষেত্রেও এভাবে অনুমতি দেবে?
শুধু তা-ই নয়, সম্প্রতি এক মুসলিম যুবক সিদ্ধান্ত নেন স্টকহোমে অবস্থিত ইসরায়েলি দূতাবাসের সামনে তিনি ইহুদিদের পবিত্র গ্রন্থ তোরাহ ও খ্রিষ্টধর্মগ্রন্থ বাইবেল পোড়াবেন। এ অবস্থায় ইসরায়েলসহ বিভিন্ন ইহুদি সংগঠন এ ব্যক্তিত্ব এই কর্মসূচিটি ঠেকানোর জন্য সুইডিশ কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। তারপরও দেশটির পুলিশ ওই কর্মসূচি পালনের অনুমতি দেয়। যদিও নির্ধারিত দিনে একটি কোরআন শরিফ হাতে নিয়ে ইসরায়েলের দূতাবাসের সামনে গিয়ে হাজির হন ওই যুবক এবং বলেন, ‘আমি কখনোই কোনো ধর্মগ্রন্থ পোড়াব না।’
ধর্মদ্রোহিতাকে অন্যান্য দেশে কীভাবে দেখা হয়?
ধর্মদ্রোহিতাকে অনেক দেশেই অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। ২০১৯ সালে পিউ রিসার্চের একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১৯৮টির মধ্যে ৭৯টি দেশ এবং অঞ্চলে ধর্মদ্রোহকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে আইন চালু আছে। এই আইন অনুযায়ী—কোনো ধর্ম, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বা বস্তুর অবমাননা করলে তা ধর্মদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত হবে।
এসব দেশের মধ্যে অন্তত সাতটি দেশ—আফগানিস্তান, ব্রুনেই, ইরান, মৌরিতানিয়া, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান ও সৌদি আরবে এ ধরনের অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিধান রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় অধ্যয়ন করা ২০টি দেশের মধ্যে ১৮টি দেশে ধর্মদ্রোহকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আইন চালু আছে। তবে বেশির ভাগ দেশেই এই অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই।
ইরাকে যদি কোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব কিংবা বস্তুকে প্রকাশ্যে কেউ অপমান করেন, তবে তাঁর তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
একইভাবে ধর্মীয়ভাবে বৈচিত্র্যময় লেবানন, যেখানে সাম্প্রদায়িক বিভাজনগুলো ১৯৭৯ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত টানা ১৫ বছর ধরে নৃশংস গৃহযুদ্ধের উসকানি দিয়েছিল। এই দেশটিতেও ‘সাম্প্রদায়িক বিবাদ’ উসকে দেওয়া একটি অপরাধ এবং এর জন্য কোনো ব্যক্তির তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
আল-আরাবিয়া
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।