জুমবাংলা ডেস্ক : বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। চলমান তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাস্তার বিটুমিন বা পিচ নরম হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। কেন এমন হচ্ছে? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, সড়ক তৈরিতে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের পাশাপাশি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং ওভারলোড বা অতিরিক্ত মালবাহী যানবাহন চলাচলের কারণেই পিচ নরম হয়ে যাচ্ছে।
যদিও সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর কর্মকর্তাদের ভাষ্য, সড়ক নির্মাণে ব্যবহৃত অন্যতম উপাদান বিটুমিনের যথাযথ গুণগত মান নিশ্চিত করার পরও অতিরিক্ত তাপে পিচ নরম হয়ে সড়ক নষ্ট হচ্ছে। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। সেগুলো হলো—পিচ কালো রঙের হওয়ায় সূর্যের তাপ শোষণ করে বেশি উত্তপ্ত হচ্ছে সড়ক। এছাড়া গাড়ির চাকার ঘর্ষণ এবং অতিরিক্ত মালবাহী গাড়ি চলাচলের কারণে উৎপন্ন তাপে সড়কের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। বাতাসের আর্দ্রতা কম হওয়ায় এবং টানা তাপপ্রবাহের কারণে বাইরের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি হলেও পিচের অভ্যন্তরে তাপমাত্রা ৫০ থেকে ৫৫ ডিগ্রি হয়ে যায়। ফলে পিচ গলে যাচ্ছে।
তাহলে দেশের বেশির ভাগ সড়কের পিচ কেন গলছে না, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
যোগাযোগ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, তাপপ্রবাহ যদি টানা ৭ দিনের বেশি সময় থাকে তাহলে বাইরের তাপমাত্রার চেয়ে বিটুমিনের ভেতরের তাপমাত্রা অন্তত ১০ ডিগ্রি বেড়ে যায়। সেই হিসেবে বিটুমিনের সহনশীল যে তাপমাত্রা তার কাছাকাছি অথবা পেরিয়ে গেছে। তবে প্রশ্ন হলো- প্রায় সারাদেশ জুড়ে যেখানে তাপপ্রবাহ চলছে, সেখানে কেন সামান্য কিছু জায়গায় বিটুমিন গলে যাবে? এটা পরীক্ষা ও তদন্ত করা দরকার।
তিনি বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত মুনাফা এবং বিভিন্ন ধাপে কমিশন বাণিজ্যের কারণে সড়কে সঠিক গুণগত মান সাধারণত রক্ষা হয় না। গরমের সঙ্গে অতিরিক্ত লোড বা ভারী যানবাহন চলাচল সড়কের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। রাতারাতি নতুন সড়ক নির্মাণ করা না গেলেও ওভারলোড নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এজন্য দরকার সদিচ্ছা। এই কাজটাও যদি এই গরমে করা যায় তাহলেও কিন্তু সড়ক অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত হবে। না হলে কিছুদিন পর বর্ষায় বৃষ্টি শুরু হলে তখন কিন্তু এই ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে বহুগুণ।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে আগামীতে তাপমাত্রা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেজন্য ভবিষ্যতে সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন ব্যবহার করা উচিত। যেটি ৮০-৮৪ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপ সহ্য করতে পারে। তাছাড়া ভবিষ্যতে টেকসই, লাগসই সড়ক নির্মাণ সম্ভব না। আবার অনেকের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে, সড়ক যত দ্রত ক্ষতিগ্রস্ত হবে ততই তাদের লাভ। এই অবস্থা থেকে বের হতে হবে।
অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধনের পর উপজাত হিসেবে সাধারণত বিটুমিন পাওয়া যায়। যেটিকে সড়ক নির্মাণ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে যেসব সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে, সেগুলোতে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করার নিয়ম রয়েছে। এর আগে অবশ্য ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিনও ব্যবহার হয়েছে, যেগুলো তুলনামূলক কম তাপ সহ্য করতে পারে।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. লোকমান বলেন, ‘জ্বালানি তেল পরিশোধনের সময় তাদের পরিশোধনাগারে উন্নত মানের বিটুমিন তৈরি হয়। এখানকার ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন ৪৯ থেকে ৫৬ ডিগ্রি সেলসিয়াম তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। এর বেশি হলেই এটি গলতে শুরু করে। সরকারি এই বিটুমিনের চাহিদা অনেক বেশি হলেও উৎপাদন সক্ষমতা অনেক কম।
৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিনের বাইরে আরও উন্নতমানের পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন (পিএমবি) এর গলনাঙ্ক ৮০ ডিগ্রির কাছাকাছি। সাধারণ বিটুমিনের সঙ্গে পলিমার মিশ্রিত করে এই বিটুমিন তৈরি হয়। বিমান বন্দরের রানওয়ে, বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) এবং এলেঙ্গা-রংপুরসহ কিছু সড়ক-মহাসড়কে পিএমবি ব্যবহার করা হয়েছে। এসব রাস্তায় পিচ গলছে না।
চলমান তাপপ্রবাহে ঢাকা, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোতে প্রায়ই তাপমাত্রা ৪০-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তীব্র গরমে চুয়াডাঙ্গা-কালীগঞ্জ এবং চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ সড়কের কয়েকটি স্থানে পিচ গলে গাড়ির চাকা বা পথচারীর জুতার সঙ্গে উঠে আসছে। পিচ গলে অনেকটা কাদার মতো হয়ে গেছে যশোর-নড়াইল মহাসড়কে। ওই মহাসড়কের নীলগঞ্জ, হামিদপুর, দায়তলা, ফতেপুর, তারাগঞ্জ এবং নড়াইল সদরের মাদ্রাসা বাজার, সুলতান ব্রিজ, সীতারামপুরসহ বিভিন্ন স্থানে গরমে বিটুমিন গলছে।
গাজীপুরের কালিয়াকৈর-ফুলবাড়িয়া আঞ্চলিক সড়কের কাঞ্চনপুর, মেদিয়া শোলাই, মেদি বাজার, পাইকপাড়া, কতুবদিয়াসহ কমপক্ষে ১০ পয়েন্টে বিটুমিন গলে যাচ্ছে। এছাড়া শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়কের বালি বাড়ির মোড় থেকে নরসিংহপুর ফেরিঘাট, বাগেরহাট, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক-মহাসড়কের পিচ গলে যাওয়ায় খবর পাওয়া গেছে।
বিটুমিন গলে যাওয়ায় এসব সড়কে ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চালাচ্ছেন চালকরা। দুর্ঘটনা এড়াতে এর ওপর বালু দিচ্ছেন সওজের কর্মীরা। বিটুমিন গলে যাওয়ার ফলে সড়কের পাথর সরে গিয়ে এসব সড়ক দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
সওজের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান বলেন, সড়কের পিচ গলে যাচ্ছে কথাটা ঠিক নয়। গলতে হলে তো ১২০ ডিগ্রি তাপমাত্রা দরকার। আসলে এটা তাপে নরম হচ্ছে কোথাও কোথাও। স্বাভাবিক পরিবেশের তাপমাত্রার চেয়ে বিটুমিনের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা বেশি হয়। বিটুমিনের নির্দিষ্ট তাপ সহ্য করার ক্ষমতা রয়েছে। অতিরিক্ত তাপে কিছু জায়গায় বিটুমিন নরম হয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, ‘মান যাচাই করে সড়কে বিটুমিন ব্যবহার করা হয়। নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের সুযোগ নেই। নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার হলে তো সব রাস্তার পিচ নরম হয়ে যেত। আমরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, সারা দেশের প্রায় ২২ হাজার কিলোমিটার সড়কের মধ্যে মাত্র চার থেকে পাঁচশ মিটার সড়কের পিচ নরম হয়েছে। এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তবে তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে আগামীতে বিটুমিনের গ্রেড পরিবর্তন করার বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি মহাসড়কে পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রতিবছর দেশে বিটুমিনের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৮ থেকে ৯ লাখ টন। সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নের ফলে এই চাহিদা প্রতিবছরই বাড়ছে। বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) এর বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৭০ হাজার টন। কিন্তু গড়ে উৎপাদন হয় ৬০ হাজার টনের মতো। ইআরএল এর বিটুমিন তুলনামূলক মানসম্মত।
বৃহস্পতিবার সারা দেশে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকছে: শিক্ষামন্ত্রী
অভিযোগ রয়েছে, অনেক সময় নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে কারসাজির মাধ্যমে সরকারি বিটুমিন বরাদ্দ নিয়ে পরবর্তীতে এর সঙ্গে নিম্নমানের আমদানিকৃত বিটুমিন মিশিয়ে বেশি দামে বিক্রি করে। অনেকে আবার সংযুক্ত আরব আমিরাত, দুবাই থেকে উন্নত মানের বিটুমিন আমদানির কথা বলে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তবে বাস্তবে সেখানে বিটুমিন কারখানা নেই। একটি চক্র আমদানিকৃত বিটুমিনের নামে নিম্নমানের বিটুমিন বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। অভিযোগ রয়েছে অবাধেই দেশে নিম্নমানের ও ভেজাল বিটুমিন আমদানি করা হচ্ছে। কোনোরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই দেশের বাজারে ঢুকছে সড়ক অবকাঠামো নির্মাণে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই উপাদান। কেউ কেউ আবার ভালো মানের বিটুমিন আমদানি করলেও সেগুলো প্রয়োগের পূর্বে বিভিন্ন হাত বদলের সময় তাতে ভেজাল মেশানো হচ্ছে। এছাড়া বিটুমিন সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও যথাযথ নিয়ম মানা হয় না।
ইআরএল এর বাইরে সড়ক নির্মাণে উন্নত বিটুমিনের জোগান দিতে ‘রোড টু দ্য ফিউচার’ স্লোগানে ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো দেশে বেসরকারি বিটুমিন প্লাট চালু করে অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপ। সূত্র : দেশ রূপান্তর
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।