আন্তর্জাতিক ডেস্ক : কিছুদিন আগেই আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলেজিন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক মেশিন লার্নিং মডেল বা চ্যাটবট চ্যাটজিপিটি বানিয়ে প্রযুক্তির জগতে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন তথ্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ওপেন এআই, যার প্রধান নির্বাহী মেধাবী প্রযুক্তিবিদ স্যাম অল্টম্যান। এবার তিনি ফের আলোচনা এসেছেন ওয়ার্ল্ড কয়েন হিসেবে অভিহিত বায়োমেট্রিক ক্রিপ্টো কারেন্সি প্রকল্প চালু করে।
এই ওয়ার্ল্ড কয়েন তৈরির মূল উদ্দেশ্য বিশ্বজুড়ে একটি ব্লক চেইন ভিত্তিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক তৈরি। যেখানে সংরক্ষিত থাকবে একজন মানুষের ব্যক্তিগত পরিচয় যা তাকে আলাদা করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন বট এর থেকে। ওয়ার্ল্ড কয়েন নেটওয়ার্কে অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি ব্যক্তি পাবেন একটি স্বতন্ত্র ডিজিটাল পরিচিতি নম্বর, যাকে অভিহিত করা হচ্ছে ’ওয়ার্ল্ড আইডি’ হিসেবে। আর এই ডিজিটাল আইডি পেতে তাকে সাবস্ক্রিপশন করতে হবে চোখের মনি বা আইরিসের বায়োমেট্রিক স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে। যখন এই স্ক্যানিং মেশিন ওই ব্যক্তির পরিচয়ের সত্যতা নিশ্চিত করবে তখন থেকেই তার নামে বরাদ্দ হবে একটি বৈশ্বিক আইডি। এটি নিশ্চিত করবে যে ওই ব্যক্তি রোবট নন, একজন প্রকৃত মানুষ, যার আলাদা পরিচিতি রয়েছে। একই সঙ্গে তিনি নিজের স্মার্টফোনে পাবেন একটি ক্রিপ্টো ওয়ালেট, যা দিয়ে লেনদেন করতে পারবেন ক্রিপ্টোকারেন্সি।
বাজারে সাড়া ফেলেছে ওয়ার্ল্ড কয়েনের ক্রিপ্টোকারেন্সি ’ডব্লিউএলডি’
স্যাম অল্টম্যানের এই নতুন ক্রিপ্টোকারেন্সি ভিত্তিক প্রকল্পের পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো ও জার্মানির বার্লিন ভিত্তিক কোম্পানি ’টুলস ফর হিউম্যানিটি’। প্রায় দুই বছর আগে শুরু হয় ওয়ার্ল্ড কয়েনের এই স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে সাবস্ক্রিপশন কর্মসূচি। ইতোমধ্যেই এতে ২২ লাখেরও বেশি মানুষ অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্স।
এ ছাড়া বাজারে এসেছে ওয়ার্ল্ড কয়েনের নিজস্ব ক্রিপ্টোকারেন্সি ডব্লিউএলডি। গত ২৪ জুলাই চালু হওয়ার পর উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে এর দাম। বর্তমানে প্রতিটি ডব্লিউএলডির দাম ওঠানামা করছে দুই থেকে আড়াই ডলারের মধ্যে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ বাইন্যান্স ইতোমধ্যেই ওয়ার্ল্ড কয়েনকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
বিশ্বে ক্রিপ্টোকারেন্সির বাজার ট্র্যাক করা ওয়েবসাইট কয়েন গেকোর উদ্ধৃতি দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে গত সোমবার (৭ আগস্ট) পর্যন্ত বাজারে ছাড়া হয়েছে ১২ কোটি ডব্লিউএলডি টোকেন। তবে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে এই সংখ্যাকে ১০ বিলিয়নে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে ওয়ার্ল্ড কয়েনের।
ওয়ার্ল্ড কয়েনের বিরুদ্ধে সমালোচনা
তবে দ্রুত সাবস্ক্রিপশন বাড়াতে বায়োমেট্রিক স্ক্যানিংয়ে উৎসাহিত করতে আগ্রহীদের ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রলোভন দেখিয়ে প্রলুব্ধ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে ওয়ার্ল্ড কয়েনের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি লন্ডনে ওয়ার্ল্ড কয়েনের এ রকম একটি স্ক্যানিং পয়েন্টে গিয়েছিলেন বিবিসির প্রতিনিধি। সেখানে দেখা যায়, আইরিস বায়োমেট্রিক স্ক্যানিংয়ের বিনিময়ে মানুষের মাঝে ডিজিটাল মুদ্রা বিতরণ করা হচ্ছে।
যদিও ওয়ার্ল্ড কয়েনের উদ্যোক্তাদের দাবি, ভবিষ্যতের ডিজিটাল বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধি বট এর ভিড়ে ব্যক্তিগত পরিচয়ের সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে মানুষের। তবে নতুন এই প্রযুক্তির বিরুদ্ধে রয়েছে সন্দেহ ও অবিশ্বাসও। ইতোমধ্যেই জার্মানির আইনি কর্তৃপক্ষ ওয়ার্ল্ড কয়েনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। অপরদিকে গত সপ্তাহে জনগণের নিরাপত্তার ইস্যু দেখিয়ে ওয়ার্ল্ড কয়েনের বায়োমেট্রিক আইরিস স্ক্যান কর্মসূচি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে কেনিয়ার সরকার। অবশ্য ওয়ার্ল্ড কয়েন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের বায়েমেট্রিক আইডি সিস্টেম সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। এর মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হওয়ার ঝুঁকি নেই। পাশাপাশি যে কোনো আইনি কার্যক্রমে পরিপূর্ণ সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছে তারা।
ওয়ার্ল্ড কয়েন ডিজিটাল অর্থনীতির এক উচ্চভিলাষী প্রকল্প
মূলত ডিজিটাল মুদ্রাভিত্তিক ইউটোপিয়া নির্মাণের স্বপ্ন দেখছেন ওয়ার্ল্ড কয়েনের উদ্যোক্তা ও ওপেন এআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান। তার ভাষায়, ওয়ার্ল্ড কয়েন অর্থনৈতিক সুযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি ডিজিটাল দুনিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রোবটের থেকে আলাদাভাবে একজন মানুষের ব্যক্তিগত পরিচিতি নিশ্চিত করবে, একই সঙ্গে রক্ষা হবে তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তাও।
পাশাপাশি বিশ্বের সব মানুষের জন্য ‘ইউনিভার্সেল বেসিক ইনকাম’ হিসেবে অভিহিত একটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো বাস্তবায়নের আশাবাদ জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড কয়েন। তবে এর বাস্তবায়ন কীভাবে সম্ভব হবে সে ব্যাপারে এখনও কিছু পরিষ্কার করা হয়নি তাদের পক্ষে।
ওয়ার্ল্ড কয়েনের উদ্যোক্তা স্যাম অল্টম্যানের দাবি, এই প্রকল্পের মূল তত্ত্ব হলো ডিজিটাল বৈশ্বিক আইডি, যার মালিক হবেন শুধু একজন প্রকৃত ব্যবহারকারী এবং তাকে অবশ্যই একজন মানুষ হতে হবে।
এই ক্রিপ্টোকারেন্সি ভিত্তিক স্বপ্নরাজ্য বা ইউটোপিয়ায় নিজেকে অন্তর্ভুক্তের পথে একজন মানুষের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে বায়োমেট্রিক আইরিস স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে নিজেকে প্রমাণ করা যে তিনি একজন মানুষ, রোবট নন।
দুই বছর আগে শুরু হওয়া এই স্ক্যানিং কর্মসূচিতে ইতোমধ্যেই বিশ্বের ৩৩টি দেশের দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষ তাদের ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড কয়েন। সবচেয়ে বেশি সাইনআপ হয়েছে ইউরোপ, ভারত ও আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলোতে।
যেভাবে অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায় ওয়ার্ল্ড কয়েন প্রজেক্টে
এর কার্যক্রম শুরু হয় আগ্রহী ব্যক্তির চোখের মনি বা তারা স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে, যেন নিশ্চিত করা সম্ভব হয় ওই ব্যক্তি একজন মানুষ। স্ক্যানিংয়ের জন্য ওয়ার্ল্ড কয়েনের রয়েছে সিলভারের বলের আকৃতির একটি গোলক, যার মধ্যে বসানো রয়েছে একটি স্বয়ংক্রিয় স্ক্যানিং মেশিন। গোলকটিকে হাতে নিয়ে এর স্ক্যানিংয়ের অংশকে চোখের সামনে ধরে রাখতে হবে অন্তত ১০ সেকেন্ড । একটি বিপ শব্দের মাধ্যমে এটি স্ক্যানিং সম্পন্ন হওয়ার বার্তা দেবে।
আইরিস স্ক্যান সম্পন্ন হওয়ার পর ওই ব্যক্তিকে একটি ইউনিক নাম্বার দেয়া হবে যার সাহায্যে ওয়ার্ল্ড কয়েনের ডাটাবেজ থেকে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে ওই ব্যক্তির সাবস্ক্রিপশন সম্পন্ন হওয়ার বিষয়টি। যদি সব ঠিক থাকে তবে ওই গোলকটি পুনরায় বিপ শব্দের মাধ্যমে বার্তা দেবে। এর মাধ্যমে সম্পন্ন হবে ওয়ার্ল্ড কয়েন প্রজেক্টে ওই ব্যক্তির চূড়ান্তভাবে অন্তর্ভুক্তি।
বিবিসি জানিয়েছে, লন্ডনে ওয়ার্ল্ড কয়েনের একটি স্ক্যানিং বুথে সাবস্ক্রিপশন সম্পন্নের পর ওয়ার্ল্ড কয়েনের পক্ষ থেকে প্রণোদনা হিসেবে দেয়া হচ্ছে ২৫টি ওয়ার্ল্ড কয়েন টোকেন। বর্তমানে যার প্রতিটির মূল্য দুই থেকে আড়াই ডলার। দেখা গেছে ২০ থেকে ৩০ কোটায় বয়স এমন ব্যক্তিরাই বেশি আগ্রহী এই সাবস্ক্রিপশনে।
ওয়ার্ল্ড কয়েন নিয়ে আছে নানা বিতর্ক
তবে ওয়ার্ল্ড কয়েনের এই বায়োমেট্রিক স্ক্যানিং কার্যক্রম নিয়ে ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে নানা বিতর্ক। জানা গেছে, ওয়ার্ল্ড কয়েন স্ক্যানিংয়ের জন্য ব্যবহৃত গোলক এর অপারেটরদের মানুষের বায়োমেট্রিক স্ক্যানিং করানোর বিনিময়ে কমিশন দেয়। বেশি কমিশনের আশায় এই অপারেটররা মানুষকে ওয়ার্ল্ড কয়েনের কার্যক্রম সম্পর্কে সব তথ্য সঠিকভা না দিয়েই তাদের আর্থিকভাবে স্ক্যানিংয়ে প্রলুব্ধ করেন। পাশাপাশি দেখা গেছে বেশিরভাগ স্ক্যানিং সম্পন্ন হয়েছে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে।
অদ্ভুত বিষয় হলো যদিও ওয়ার্ল্ড কয়েনের সূত্রপাত যুক্তরাষ্ট্রে, তবে আইনগত বিধিনিষেধের কারণে এখনও মার্কিন নাগরিকরা এতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন না। এ ছাড়া কোনো আইরিস বায়োমেট্রিক স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে এভাবে কোনো ব্যক্তির থেকে সংগ্রহ করা স্পর্শকাতর তথ্য দুর্বৃত্ত ও অসাধুদের হাতে পড়তে পারে বলেও উদ্বেগ রয়েছে অনেকের। তবে ওয়ার্ল্ড কয়েনের উদ্যোক্তা স্যাম অল্টম্যান বলেছেন, সমালোচনা বরং তাদের আরও শক্তি যোগাচ্ছে। তবে তার এই প্রকল্প অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী বলেও স্বীকার করেছেন তিনি।
বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলেছে ওয়ার্ল্ড কয়েন প্রকল্প
ইতোমধ্যেই বিশ্বজুড়ে মনোযোগ আকর্ষণ করেছে এই ওয়ার্ল্ড কয়েন প্রকল্প। তবে তারা কতটা সফল হবে তা নিয়ে সন্দিহান অনেকেই। তাদের মধ্যে অন্যতম টুইটারের প্রতিষ্ঠাতা ও ক্রিপ্টোকারেন্সি অনুরাগী জ্যাক ডোরসি। ওয়ার্ল্ড কয়েনের মাধ্যমে পুরো বিশ্বকে একটি ডিজিটাল অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে আনার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাকে তিনি বর্ণনা করেছে ‘কিউট’ হিসেবে। তবে এর উদ্যোক্তা স্যাম অল্টম্যানের মতে, ওয়ার্ল্ড কয়েনের এই যাত্রা খুবই চ্যালেঞ্জিং এবং এর ফলাফল অনিশ্চিত হলেও ভবিষ্যতের জন্য নতুন প্রযুক্তির অনুসন্ধান ও এর প্রয়োগ প্রয়োজন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।