আন্তর্জাতিক ডেস্ক : নারী হয়েও পুরুষদের অধিকারের লড়াই করছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নন্দিনী ভট্টাচার্য। তিনি অল বেঙ্গল মেনস্ ফোরামের প্রধান। নন্দিনীর মতো বিভিন্ন দেশের ১৪জন নারীকে বিশ্ব পুরুষ দিবসের ‘দূত’ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক জেরোম তিলকসিং-এর বরাতে এ খবর জানিয়েছে বিবিসি।
অধ্যাপক তিলকসিংয়ের উদ্যোগে ১৯৯৯ সাল থেকে ১৯ নভেম্বর দিনটি ‘বিশ্ব পুরুষ দিবস’ হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। সারা বিশ্বে পুরুষদের অধিকার আন্দোলনের অভিভাবক হিসেবে মনে করা হয় এই অধ্যাপককে।
অধ্যাপক তিলকসিং বলছিলেন, ‘গত ২৫ বছর ধরে বিশ্ব পুরুষ দিবস চেষ্টা করে আসছে পুরুষরা যাতে বিভিন্ন ধরনের বাধা অতিক্রম করতে পারেন, মানসিক আঘাত সামলিয়ে উঠতে পারেন। যে সব পুরুষ একা বা প্রান্তিক বোধ করেন, তাদের পাশে আমরা নানাভাবে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে থাকি।’
তিনি বলেন, দুঃখজনক হলেও এটা ঘটনা যে বিশ্ব পুরুষ দিবসটি কিন্তু জাতিসংঘের কোনো স্বীকৃতি পায়নি। আমরা একাধিকবার চেষ্টা করেছি। বিশ্ব নারী দিবস স্বীকৃতি পেলেও আমরা কোনো স্বীকৃতি পাইনি।’
তবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নারীও ‘পুরুষ-অধিকার’ আন্দোলনে সরব হয়েছেন।
আফ্রিকার রোজম্যারি
কেনিয়ার পুরুষ অধিকার আন্দোলনের অন্যতম মুখ রোজম্যারি মুথোনি কিনুথিয়া। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আফ্রিকান বয় চাইল্ড নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক তিনি।
নাইরোবি থেকে কিনুথিয়া বলছিলেন, ‘আমার ছোটবেলা কেটেছে বাবা আর দুই ভাইয়ের সান্নিধ্যে। মা অন্য জায়গায় থাকতেন। যে অঞ্চলে আমি বড় হয়েছি, সেটা নানা ধরণের অপরাধমূলক কাজের জন্য কুখ্যাত ছিল।’
তিনি বলেন, ‘আমার বাবা মারা যান ২০১৬ সালে। কাজ থেকে অবসর নেওয়ার পরে তাকে যে মানসিক অশান্তির মধ্যে দিয়ে হয়েছে, সেটা আমি দেখেছি কাছ থেকে। আফ্রিকায় পুরুষরা তো কখনও মুখ ফুটে বলে না তাদের মানসিক যন্ত্রণার কথা। তাই বাবা চলে যাওয়ার বছরেই আমি ঠিক করি যে পুরুষদের জন্য কিছু করতে হবে আমাকে। চাকরি ছেড়ে দিই আমি।’
দিল্লির দীপিকা
দিল্লির বাসিন্দা দীপিকা নারায়ণ ভরদ্বাজ একজন সাংবাদিক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা। পুরুষ অধিকার আন্দোলনে তার জড়িয়ে পড়া একটা ব্যক্তিগত ঘটনার মাধ্যমে। এক কাজিনের বিয়ে ভেঙে যায় মাত্র মাস তিনেকের মধ্যে। তার সেই প্রাক্তন স্ত্রী দীপিকার পরিবারের বিরুদ্ধে নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেন। এমনকি দীপিকাও নাকি তাকে নিয়মিত মারধর করতেন, এরকম মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করা হয়।
দীপিকা বলেন, ‘আদালতের বাইরে অনেক অর্থ দিয়ে সেই বিষয়টি আমরা মিটিয়ে নিই। ওই মামলার ব্যাপারেই আমি যখন নানা জায়গায় যাতায়াত করি, তখনই বুঝতে পারি যে পুরুষরা যখন নির্যাতনের শিকার হবেন, তাদের জন্য সেরকম কোনো আইনি সুরক্ষা নেই। সেই থেকেই আমার কাজের শুরু। ‘মার্টার্স অব ম্যারেজ’ (বিবাহের শহীদ) নামে আমি একটি তথ্যচিত্র তৈরি করি। সেখানে স্ত্রী-নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগে কীভাবে বহু পুরুষের জীবন শেষ হয়ে গেছে, সেই কাহিনী তুলে ধরেছিলাম।’
কলকাতার নন্দিনী
অল বেঙ্গল মেনস্ ফোরামের প্রধান নন্দিনী ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘আমার চারপাশে সব সময়ে নানা ঘটনা দেখতাম যা থেকে আমার মনে হত যে পুরুষদের অবস্থাটা বেশ সঙ্গিন। প্রথমে তারা তো মা এবং স্ত্রীর চাপে একটা খুব দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় থাকেন। এরপর তার যদি পুত্র সন্তান থাকে, তার বিয়ের পরে যখন সেই পুরুষটি শ্বশুর হন, তখন নিজের স্ত্রী এবং পুত্রবধূর চাপ পড়ে পরিবারের প্রধান পুরুষটির ওপরে।’
নন্দিনী বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই যেন বিনা দোষে দোষী বলে দাগিয়ে দেওয়া হয় পুরুষদের। যেমন ভিড় বাসে যদি ঝাঁকুনির কারণেও কোনো নারীর গায়ে ছোঁয়া লাগে, তাহলে তিনি ভেবে নেবেন যে পুরুষটি তার শরীর ছুঁতে চাইছেন। অফিসে কোনো নারীকে যদি কিছু বলেন আমি এটাই দেখে এসেছি যে পুরুষটি জনরোষের শিকার হয়ে যান। ভীষণ একপেশে মনে হত ব্যাপারটা। সমাজে, চারপাশে এগুলো দেখতে দেখতেই আমার পুরুষ অধিকার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া।’
নারী হয়েও কেন পুরুষদের জন্য লড়াই?
তথ্যচিত্র নির্মাতা ও ভারতে পুরুষ অধিকার আন্দোলনের অন্যতম মুখ দীপিকা নারায়ণ ভরদ্বাজ বলছিলেন, ‘আমি ২০১২ সালে প্রথম কাজ করতে শুরু করি পুরুষদের অধিকার নিয়ে, তখন অনেকেই আমাকে এই কথাটা জিজ্ঞাসা করতেন যে একজন নারী হয়ে আমি কেন পুরুষদের হয়ে লড়ছি। এখন অবস্থাটা অনেকটা বদলেছে। কিন্তু এখনও আমার মতো কেউ পুরুষদের অধিকার নিয়ে কথা বলছে, এমন নারীর সংখ্যা আপনি হাতে গুনতে পারবেন।’
তবে তিনি এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে বহু পুরুষও কিন্তু দশকের পর দশক ধরে নারী-অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন, আন্দোলনে নেমেছেন।
তিনি বলেন, ‘কোনো নারীর ওপরে নির্যাতন হলে যেমন বহু পুরুষ এগিয়ে এসেছেন, তেমনই কোনো পুরুষের ওপরে নির্যাতন হলে এগিয়ে আসা, প্রতিবাদ করা তো নারী হিসাবে আমাদেরও কর্তব্য।’
কেনিয়ার রোজম্যারি কিনুথিয়া বলেন, ‘এ বছরের বিশ্ব পুরুষ দিবস উপলক্ষে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার একটা ভাষণ আছে ১৯ নভেম্বর। সেটার পোস্টার আমি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করতেই নারীবাদীরা আমাকে সাংঘাতিক ট্রল করতে শুরু করলেন। তারা প্রশ্ন তুললেন যে একজন নারী হয়ে আমি কীভাবে পুরুষদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারি। পুরুষদের ব্যাপারে আমি কীইবা বুঝি। অথচ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীরা নন, পুরুষরাই আমাকে ভাষণ দেওয়ার জন্য ডেকে নিয়েছিলেন।’
বিশ্ব পুরুষ আন্দোলনের প্রধান অভিভাবক অধ্যাপক জেরোম তিলকসিং বলছিলেন, ‘আমাদের সঙ্গে নারীদের তো কোনো বিরোধ নেই। নারী-পুরুষ মিলেই তো একটা পরিবার। ক্যান্সার আক্রান্ত কোনো পুরুষকে তো তার স্ত্রী বা বোনই কেমোথেরাপি দিতে নিয়ে যান। আবার তীব্র মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটানো পুরুষকে তো তার স্ত্রী অথবা বান্ধবী যে কেউ হতে পারেন, তিনিই তো সঙ্গ দেন।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।