বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক যাবে প্রায় শুণ্য অভিবাসন ব্যয়ে বা বিনা টাকায়। শ্রমিক যাওয়ার সকল ব্যয় বহন করবে ওই দেশটির নিয়োগকর্তা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বন্ধু রাষ্ট্র মালয়েশিয়া সফর শেষে এরকম ইঙ্গিত দিয়েছেন জনশক্তি রফতানি সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার আইন মেনে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নেওয়ার একটি মডিউলও দাঁড় করানো হয়েছে। যার নাম দেয়া হয়েছে ইউনিভার্সেল রিক্রুটমেন্ট প্রসেস (ইউআরপি)। এর মাধ্যমে পরিচালিত হবে ডাইরেক্ট লেবার রিক্রুটমেন্ট (ডিএলআর) প্ল্যাটফর্ম। ইউআরপি ও ডিএলআর দুটোই পরিচালিত হবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)-এর মাধ্যমে। ফলে এই প্রক্রিয়ায় কোন ধরনের কারসাজির সুযোগ থাকবে না। ইতোমধ্যে মালয়েশিয়া সরকার মডিউলটি অনুমোদন করেছে। বাংলাদেশ সরকারেরও সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে এ বিষয়ে সম্মতি পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন শিগগিরিই ইউআরপি বাস্তবায়ন হবে এবং বাংলাদেশ থেকে প্রায় শুণ্য অভিবাসন ব্যয়ে শ্রমিক যাবে মালয়েশিয়ায়।বাংলাদেশি ফ্যাশন ট্রেন্ড
মালয়েশিয়ার কূটনৈতিক সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ায় বর্তমানে ১৫টি সোর্স কান্ট্রি থেকে শ্রমিক নিয়োগ করে থাকে। বিদেশি শ্রমিকের নিয়োগ, ভিসা, মেডিকেল, ইমিগ্রেশন ও নিরাপদ কর্মসংস্থানসহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয় ফরেন ওয়ার্কার সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজম্যান্ট সিস্টেমের (এফডব্লিউসিএমএস) মাধ্যমে। এই সফটওয়্যারটি বিদেশি শ্রমিকদের তথ্য নিবন্ধন, ভিসা আবেদন ও অনুমোদন, মেডিকেল চেকআপ রিপোর্ট সংরক্ষণ, ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত কার্যক্রম, নিয়োগকর্তা ও শ্রমিকের তথ্য সমন্বয় করে থাকে। এফডব্লিউসিএমএস নিয়ন্ত্রণ করে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট অব মালয়েশিয়া। এফডব্লিউসিএমএস সিস্টেমটি তৈরি, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান বেস্টিনেট এসএনডি.বিএইচডি। এই বেস্টিনেটের প্রতিষ্ঠাতা ও গ্রুপ প্রেসিডেন্ট দাতোশ্রী মো. আমিন বিন আব্দুল নূর। তিনি শুণ্য অভিবাসন ব্যয়ে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি ইউআরপি মডিউলটি তৈরি করেছেন। এই সফটওয়্যারটি বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন পেলে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ায় আলাদা অফিস স্থাপন করবে। পর্যায়ক্রমে প্রতিটি বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরে ইউআরপি অফিস স্থাপন করা হবে। ইউআরপির থাকবে বিশেষ অ্যাপস। ইউআরপির মাধ্যমে পরিচালিত হবে সরাসরি শ্রমিক নিয়োগ প্রক্রিয়া। এআই চালিত এসব মাধ্যমে অভিবাসন প্রত্যাশী বাংলাদেশের যে কোন শ্রমিক সম্পূর্ণ বিনা খরচে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন। তার যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী মালয়েশিয়ান নিয়োগকর্তা উড়োজাহাজ ভাড়া, মেডিকেল চেকআপ করানো থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করবে। শ্রমিক শুণ্য খরচে মালয়েশিয়া পৌঁছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কাজে যোগ দেওয়ার পর সার্ভিস চার্জ হিসেবে প্রথম মাসের বেতন কেটে নিতে পারবে ইউআরপি। মন্ত্রণালয়ের নিয়োগানুমতি, বিএমইটির ছাড়পত্রসহ যাবতীয় কাজ করবে সীমিত সংখ্যক রিক্রুটিং এজেন্সি। সার্ভিস চার্জের একটি অংশ তারা পাবে। স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যয়ও দেওয়া হবে সার্ভিস চার্জ থেকে। ফলে প্রায় শুণ্য অভিবাসন ব্যয়ে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিকরা মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ পাবেন।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, বাংলাদেশ থেকে যে প্রক্রিয়ায় শ্রমিক নেওয়া হয়, দুঃখজনকভাবে তা আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-র ‘ন্যায্য নিয়োগের সাধারণ নীতি ও কর্মপরিচালনা নির্দেশনা’র মূল নীতি হলো নিয়োগকর্তাই সব ব্যয় বহন করবে। অর্থাৎ, শ্রমিকের পাসপোর্ট করা থেকে শুরু করে ভিসা ফি, মেডিকেল চেকআপ, উড়োজাহাজের টিকিটসহ যাবতীয় খরচ নিয়োগকর্তাকে বহন করতে হবে। শ্রমিকের কাছ থেকে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কোনো খরচ আদায় করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আন্তর্জাতিক আইন মেনে নিয়োগকর্তার খরচে এরই মধ্যে থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া থেকে শ্রমিক নিচ্ছে মালয়েশিয়া। এ ছাড়া নেপাল ও ভারতও আংশিক এ সুবিধা পাচ্ছে। অর্থাৎ এসব দেশ থেকে যারা এই সুবিধায় মালয়েশিয়ায় যাচ্ছে, তাদের কোনো খরচ হচ্ছে না। নিয়োগকর্তা তাদের সব খরচ দিচ্ছে। ১৪টি সোর্স কান্ট্রির শীর্ষে থাকার পরও দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশ এখনো এ সুবিধা পায়নি। এমনকি এ সুবিধা এর আগে সরকারিভাবে দাবিও করা হয়নি।
মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি সংশ্লিষ্টরা বলেন, ডাইরেক্ট লেবার রিক্রুটমেন্ট বা ডিএলআর প্ল্যাটফর্ম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দ্বারা পরিচালিত ডিজিটাল সিস্টেম যা মধ্যস্বত্বভোগী এবং সিন্ডিকেট দ্বারা বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের শোষণ সম্পূর্ণরূপে দূর করবে। এটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলওর শ্রমিক নিয়োগ নীতিমালা অনুসরণ করে। যা আন্তর্জাতিক মানদ-ের সঙ্গে সম্মতিপূর্ণ একটি স্বচ্ছ এবং নীতিগত নিয়োগ নিশ্চিত করবে। এআই চালিত ডিএলআরের মূল বিষয়গুলো হচ্ছে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগে শূণ্য অভিবাসন ব্যয় নিশ্চিত করা। এটি বাস্তবায়িত হলে শ্রমিকদের অতিরিক্ত নিয়োগ ফি দিতে হবে না। বর্তমানে একজন শ্রমিক পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় সমস্ত নিয়োগব্যায় নিয়োগকর্তা বহন করবে। যার মধ্যে উড়োজাহাজ ভাড়া, ভিসা, চিকিৎসা, বীমা, প্রশিক্ষণ এবং সরকারি বিভিন্ন সুবিধাদি অন্তর্ভুক্ত থাকবে। নিয়োগকর্তা এবং কর্মীরা ডিএলআর প্ল্যাটফর্মের অধীনে এআইর মাধ্যমে ভাষাগত অনুবাদ সিস্টেমের মাধ্যমে সরাসরি নিজস্ব ভাষায় যোগাযোগ করতে পারবেন। একটি কাজের বিভিন্ন শর্ত, চুক্তি ও সুবিধা সম্পর্কে কোন ধরনের ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হবে না। এই প্রক্রিয়ায় কোন মধ্যস্থতাকারী বা দালালের স্থান থাকবে না। লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো শুধু আইনী ও প্রশাসনিক বিষয়গুলো দেখবে। এতে অবৈধ মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন হবে না। ডিএলআর প্রক্রিয়ায় সরাসরি দুর্নীতি, জালিয়াতি এবং কর্মী শোষণ কমিয়ে আনবে। ডিএলআর বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড (বিটিইবি) এবং কাক্সিক্ষত দেশের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ প্রশিক্ষণ পরিচালনা করবে। ডিএলআর কর্মীরা চাকরি প্রার্থীদের যোগ্যতা ও দক্ষতা আছে কিনা সেটা নিশ্চিত করবে। এই প্রক্রিয়ার আরো একটি সুবিধা হচ্ছে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। অভিবাসন ব্যয় কমানোর পাশাপাশি শ্রমিকরা আরো বেশি অর্থ পাঠাতে পারবে। এই স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া শুধু মালয়েশিয়া নয়, বিশ্বব্যাপী দক্ষ শ্রমিকদের জন্য একটি বিশ্বস্ত সোর্স কান্ট্রি হিসেবে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করবে।
এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটির) প্রচলিত প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এটি নিরাপদ এবং যাচাইকৃত নিয়োগের জন্য শ্রমিক নিয়োগকারী দেশগুলোর নিয়োগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে জেরবার অবস্থা। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে নিজেদের মধ্যে কয়েকটি মামলা করেছে তারা। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কয়েকজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অর্থ পাচার মামলা করা হয়। ঢালাও মামলার ফলে আন্তর্জাতিক মানব পাচার সূচক (টিআইপি) ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মালয়েশিয়া। টিআইপি র্যাংকিংয়ে মালয়েশিয়া বর্তমান টায়ার-২ ক্যাটাগরিতে রয়েছে। যা একেবারে তলানীতে বলা যায়। এসব অপ্রমাণিত অভিযোগ তদন্ত থেকে বাদ দেওয়া বা প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য মালশিয়ার সরকার বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দিয়েছে। যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির সভাতেও বিষয়গুলো নিয়ে পর্যালোচনা হয়েছে। পর্যালোচনা শেষে বাংলাদেশ সরকার এসব অপ্রমাণিত অভিযোগ ও মামলার তদন্ত এবং অনুসন্ধান প্রত্যাহার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু সেটা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা বলেন, কোন শ্রমিক মানবপাচার বা অর্থপাচারের মামলা করেনি। ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যে চার লাখ ৮০ হাজার শ্রমিক মালয়েশিয়া গিয়েছে তারা সবাই কাজ পেয়েছে। কারোর অভিযোগ নেই। তবে ব্যবসায়ীদের একটি অংশ নিজেদেরকে বঞ্চিত দাবী করে সাজানো অভিযোগে মামলা করেছে। তারা বিভিন্নভাবে মামলার তদন্তকে প্রভাবিত করেছে। ফলে এসব তদন্ত ও অনুসন্ধান মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার অন্তঃরায় হিসেবে দেখা দিয়েছে।
শুণ্য অভিবাসন ব্যয়ে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া সম্ভব কিনা জানতে চাইলে বেস্টিনেটের প্রতিষ্ঠাতা দাতোশ্রী মো. আমিন বিন আব্দুল নূর বলেন, আমি মালয়েশিয়ার নাগরিক হলেও বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি। অবৈধভাবে শ্রমিকরা এসে মালয়েশিয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করে। অনেক শ্রমিক ভিটেমাটি বিক্রে করে মধ্যসত্বভোগী বা দালালচক্রকে টাকা দেয়। শ্রমিকরা বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সির সাব এজেন্ট, উপ-এজেন্ট ও গ্রামের এজেন্ট বা দালালের মাধ্যমে বড় অংকের অর্থ ব্যয় করে। মধ্যসত্বভোগীরা বিপুল অর্থ নেওয়ার কারণে শ্রমিকরা নিঃস্ব হয়ে পড়ে। যখন কাজ প্রত্যাশী শ্রমিক ও নিয়োগকর্তার মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে তখনই এসব দালালের দৌরাত্ম্য বন্ধ হবে। আমাদের কাজ হলো অভিবাসন প্রত্যাশী শ্রমিক ও নিয়োগকর্তার মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করে দেওয়া বা যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দেওয়া। শ্রমিকদের শুণ্য খরচে নিরাপদ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। আমরা দেশের স্বার্থ ও শ্রমিকের স্বার্থ দেখতে চাই। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ায় প্রতিবছর দুই লাখ বা তারও বেশি শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ রয়েছে। ইউআরপি ও ডিএলআর বাস্তবায়ন করা গেলে শ্রমিকরা শুণ্য অভিবাসন ব্যয়ে নিরাপদ কর্মসংস্থান পাবে। এজন্য আমি বাংলাদেশ সরকারসহ সবপক্ষের সহযোগিতা চাই।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।