ধর্ম ডেস্ক : পৃথিবীর প্রভাবশালী ও বৃহৎ ভাষাগুলোর একটি আরবি। মুসলিমদের ধর্মীয় জীবনের অপরিহার্য অংশ হওয়ায় পৃথিবীজুড়ে আরবি ভাষার চর্চা আছে। ইসলাম আগমনের প্রায় পাঁচ শ বছর আগে আরবি ভাষা একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষার রূপ ধারণ করে। তবে আরবি আন্তর্জাতিক ভাষা হয়ে ওঠে বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নেতৃত্বে মুসলিমরা অধিষ্ঠিত হওয়ার পর।
তখন আরবি ভাষা বৈশ্বিক মর্যাদা লাভ করে। বিশ্বব্যাপী শুধু তার চর্চায় বাড়ে না; বরং তা স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করতে শুরু করে।
আরবি বর্ণমালা গ্রহণ
আরবি ভাষার প্রভাব বিস্তারের একটি দিক ছিল আরবি বর্ণে স্থানীয় ভাষাগুলো লেখা। নিম্নে এমন কিছু ভাষার বিবরণ দেওয়া হলো, যেগুলো আরবি বর্ণে লেখা হয়।
১. দারি (Dari) : আফগানিস্তানের সরকারি ভাষাগুলোর একটি দারি। দেশটির ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ মানুষ (২০ মিলিয়ন) দারি ভাষায় কথা বলে। ইরানেও দারি ভাষার প্রচলন আছে। এটি মূলত ফারসি ভাষার একটি বিবর্তিত রূপ। এটি আরবি-ফারসির মিশ্র বর্ণে লেখা হয়।
২. পশতু (Pashto) : আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের প্রায় ৬০ মিলিয়ন মানুষ পশতু ভাষায় কথা বলে। এটা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের রাষ্ট্র স্বীকৃত ভাষা। পশতু ভাষা আরবি বর্ণে লেখা হয়।
৩. আরউই (Arwi) : আরউইয়ের অপর নাম ‘আরাবু তামিল’। তামিল ভাষার একটি উপভাষা। ভারত ও শ্রীলঙ্কার তামিল জনগোষ্ঠীর ভেতর তা প্রচলিত। বিশেষত সংখ্যালঘু তামিল ও মুর মুসলিমরা আরউই ব্যবহার করে।
৪. আজারবাইজানি (Azerbaijani) : আজারবাইজান, ইরানের আজারবাইজান প্রদেশ ও রাশিয়ার দাগিস্তানের ভাষা আজারবাইজানি। এই ভাষায় প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষ কথা বলে। ১৯২৯ সালের আগ পর্যন্ত আজারবাইজানি আরবি বর্ণে লেখা হতো। বর্তমানে তা ল্যাটিন ও সিরিলীয় বা সিরিলিক বর্ণে লেখা হয়। তবে ইরানে এখনো আরবি-ফারসির মিশ্র বর্ণে লেখা হয়।
৫. বাহাসা মিলাউ (Bahasa Melayu) : এর অপর নাম মালয়। এটি মালাক্কা প্রণালির উভয় পার তথা মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ব্রুনাইয়ের ভাষা। এসব দেশের প্রায় ১৬ মিলিয়ন ‘বাহাসা মিলাউ’ ভাষায় কথা বলে। এটি মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের সরকারি ভাষাগুলোর একটি এবং পূর্ব তিমুরের ‘কর্মক্ষেত্রের’ ভাষা হিসেবেও স্বীকৃত। ‘অ্যারাবিক-জাভি’ বর্ণে তা লেখা হয়।
৬. বালুচি (Balochi) : ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ বালুচি ভাষায় কথা বলে। বিশ্বের প্রায় ৯ মিলিয়ন মানুষ বালুচি ভাষায় কথা বলে। এটি আরবি-ফারসির মিশ্র বর্ণে লেখা হয়।
৭. ব্রাহুই (Brahui) : পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরানের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী ব্রাহুই সম্প্রদায়ের ভাষা এটি। একে ব্রাভি ও ব্রাহু-ও বলা হয়। ২.৮ মিলিয়ন মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। এটি আরবি (প্রধানত) ও রোমান বর্ণে লেখা হয়ে থাকে।
৮. দোগরি (Dogri) : ভারতের জম্মু-কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, পাঞ্জাব প্রদেশ এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের চার মিলিয়ন মানুষ দোগরি ভাষায় কথা বলে। দোগরি ভারতের ২২টি দাপ্তরিক ভাষার একটি। দোগরি ভাষা আরবি-ফারসির মিশ্র বর্ণমালা নাস্তালিক বর্ণে এবং প্রাচীন ভারতীয় দেবনাগরি বর্ণে লেখা হয়।
৯. ফুলা (Fula) : পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার ১৮টি দেশের ৩০ মিলিয়ন মানুষ ফুলা ও তার বিভিন্ন উপভাষায় কথা বলে। এর মধ্যে ক্যামেরুন, ঘানা ও উত্তর নাইজেরিয়ার ফুলাভাষীরা আরবি বর্ণমালা ব্যবহার করে।
১০. হাউসা (Hausa) : নাইজার, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, বেনিন, ঘানা বিস্তৃত অঞ্চলসহ সুদান ও আইভরি কোস্টের ৫০ মিলিয়ন মানুষ হাউসা ভাষায় কথা বলে। এর মধ্যে উত্তর নাইজেরিয়া ও নাইজারের হাউসা ভাষাভাষীরা আরবি বর্ণের আজামি ধারায় তা লেখে।
১১. উর্দু (Urdu) : পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা উর্দু এবং ভারতের সংবিধান স্বীকৃত ভাষাগুলোর একটি উর্দু। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৬৯ মিলিয়ন মানুষ উর্দু ভাষা কথা বলে। এটি আরবি-ফারসির মিশ্র বর্ণে লেখা হয়।
১২. ফারসি (Persian) : ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানের রাষ্ট্রীয় ভাষা ফারসি। পৃথিবীর ৭০ মিলিয়ন মানুষ ফারসি ভাষার কথা বলে। ফারসি ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা আছে। তবে ভাষা বিজ্ঞানীরা মনে করে ফারসি বর্ণমালা আরবি বর্ণমালার বিবর্তিত রূপ।
১৩. কাশগরি (Kashgari) : চীনের জিংজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলিমদের ভাষা কাশগরি। চীনের নিয়ন্ত্রণমূলক শাসনের কারণে কাশগরি ভাষা ও ভাষাভাষী মানুষের অস্তিত্ব এখন হুমকির। কাশগরি ভাষা আরবি বর্ণে লেখা হয় এবং তা মূলত তুর্কি ভাষারই একটি উপজাত ভাষা।
১৪. কাশ্মীরি (Kashmiri): অখণ্ড কাশ্মীরের আঞ্চলিক ভাষা কাশ্মীরি বা কাসুর। কাসুর ভারতের ২২টি দাপ্তরিক ভাষার একটি। প্রায় সাত মিলিয়ন মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। কাশ্মীরি ভাষা আরবি-ফারসি মিশ্র বর্ণে লেখা হয়। এ ছাড়া দেবনাগরি ও সারাদা বর্ণেরও ব্যবহার আছে এই ভাষায়।
১৫. কিরগিজ (Kyrgyz) : কিরগিজস্তানের দাপ্তরিক ভাষা কিরগিজ। এ ছাড়া চীনের জিংজিয়াং প্রদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এই ভাষায় কথা বলে। বিশ্বের ৪.৫ মিলিয়ন মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পর থেকে কিরগিজস্তানে ভাষাটি সিরিলীয় বর্ণেই লেখা হয়। আগে শুধু আরবিতে লেখা হতো এবং এখনো চীনে তা আরবি বর্ণে লেখা হয়।
১৬. লাহান্দা (Lahnda) : পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে প্রচলিত ভাষা লাহান্দা। এ ছাড়া ভারতের পাঞ্জাব, অখণ্ড কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের খায়বার পাকতুন অঞ্চলেও লাহান্দা ভাষার লোক আছে। ভারত-পাকিস্তানের ৪২ মিলিয়ন লোক লাহান্দা ভাষায় কথা বলে। আরবি-ফারসির মিশ্র বর্ণে ভাষাটি লেখা হয়।
১৭. মালায়লাম (Malayalam) : ভারতের কেরালা, পুঞ্জচেরি, লাক্ষাদ্বীপের মালয়ালি জাতি-গোষ্ঠীর লোকেরা এই ভাষা ব্যবহার করে। পৃথিবীর ৩৫ মিলিয়ন মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। এটি ভারতের রাষ্ট্র স্বীকৃত ২২টি ভাষার একটি। বর্তমানে ব্রাহ্মী লিপিতেই ভাষাটি বেশি লেখা হয়। তবে ভারতের মুসলিমরা এবং সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মালায়লাম ভাষাভাষীরা তা আরবি বর্ণেই লেখে।
১৮. নাখো-দাগেস্তানিয়ান (Nakho–Dagestanian) : নাখো-দাগেস্তানিয়ান মূলত রাশিয়ার উত্তর-পূর্ব ককেশাস অঞ্চলের ভাষা। রাশিয়ার ইনগুশ ও চেচেনিয়ার ১.১ মিলিয়ন মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। ভাষাটি আরবি ও সিরিলীয় উভয় বর্ণে লেখা হয়।
১৯. পাঞ্জাবি (Punjabi) : ভারত ও পাকিস্তানের পাঞ্জাব অঞ্চলের ১১৩ মিলিয়ন মানুষ পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলে। এর মধ্যে ৮০.৫ মিলিয়ন পাকিস্তানে বাস করে। পাকিস্তানে পাঞ্জাবি ভাষা আরবি-ফারসি বর্ণের মিশ্রণে গড়ে ওঠা শাহমুখি বর্ণে এবং ভারতে গুরমুখি বর্ণে তা লেখা হয়।
২০. সারায়িকি (Saraiki) : পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল পাঞ্জাবে প্রচলিত একটি ভাষা সারায়িকি। প্রায় ২৬ মিলিয়ন মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। সারায়িকি ও এর উপভাষা মুলতানি আরবি-ফারসির মিশ্র বর্ণে লেখা হয়।
২১. শিনা (Shina) : পাকিস্তান ও ভারতে প্রচলিত এই ভাষায় প্রায় ১.৪ মিলিয়ন মানুষ কথা বলে।
২২. সিন্ধি (Sindhi) : পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের ৩০ মিলিয়ন মানুষ এবং ভারতের ১.৭ মিলিয়ন মানুষ সিন্ধি ভাষায় কথা বলে।
২৩. সোমালি (Somali) : সোমালি ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ার দাপ্তরিক ভাষা এবং জিবুতির জাতীয় ভাষা। আফ্রিকার প্রায় ২.১৮ মিলিয়ন মানুষ সোমালি ভাষায় কথা বলে। এটি ল্যাটিন ও আরবি বর্ণভিত্তিক ‘ওয়াদাদ’ বর্ণে লেখা হয়।
২৪. সোরানি (Sorani) : সোনারি কুর্দি ভাষার একটি উপভাষা। ইরাকের কুর্দিস্তানেই সোনারি ভাষা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। বিশ্বের আট মিলিয়ন মানুষ সোরানি ভাষায় কথা বলে।
২৫. সুন্দানিজ (Sundanese) : ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে বসবাসকারী সুন্দানিজ জাতি-গোষ্ঠীর ভাষা। প্রায় ৪২ মিলিয়ন মানুষ সুন্দানিজ ভাষা ব্যবহার করে। এটি ল্যাটিন ও আরবি বর্ণই ব্যবহার করা হয়।
২৬. সোয়াহিলি (Swahili) : সোয়াহিলি তানজানিয়া, কেনিয়া, মুজাম্বিকসহ আফ্রিকার একাধিক দেশের বহু প্রচলিত ভাষা এটি। পৃথিবীর প্রায় দুই শ মিলিয়ন মানুষ এই ভাষা ব্যবহার করে। যা আরবি ও রোমান বর্ণে লেখা হয়।
২৭. তাওসুগ (Tausug) : তাওসুগ ভাষাকে ‘বাহাসা সুগ’ও বলা হয়। এটি ফিলিপাইনের সুলু প্রদেশ ও মালয়েশিয়ার সাবা অঞ্চলের ভাষা। ১.২ মিলিয়ন মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। আরবি ও ল্যাটিন বর্ণে লেখা তা হয়।
২৮. তুর্কমিন (Turkmen) : তুর্কমিনিস্তান, ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের ১১ মিলিয়ন মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে আরবি বর্ণে এবং তুর্কমিনিস্তানে সিরিলীয় ও ল্যাটিন বর্ণে তা লেখা হয়।
২৯. উলুফ (Wolof) : উলুফ সেনেগাল, মৌরতানিয়া ও গাম্বিয়ায় বসবাসকারী উলুফ জাতি-গোষ্ঠীর ভাষা। পৃথিবীর ৫.৪ মিলিয়ন মানুষ উলুফ ভাষায় কথা বলে। উলুফ ভাষা আরবি ও ল্যাটিন বর্ণে লেখা হয়।
৩০. আরবি (Arabic) : ইংরেজি ও ফ্রেন্স ভাষার পর আরবি সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষা। আরবি জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষাগুলোর একটি। পৃথিবীর ২৬টি দেশের দাপ্তরিক ভাষা আরবি। পৃথিবীর ৩৬০ মিলিয়ন মানুষ আরবি ভাষা ব্যবহার করে। আরবি ভাষা আরবি বর্ণ ছাড়াও ল্যাটিন ও হিব্রু বর্ণে লেখা হয়।
তথ্যঋণ : ট্রান্সপারেন্ট ল্যাঙ্গুয়েজ ও উইকিপিডিয়া
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।